আফজাল বারী : গতি পাচ্ছে না বিএনপির কমিটি গঠন প্রক্রিয়া। চাউর আছে, সিন্ডিকেটে আটকে গেছে বিএনপির নির্বাহী কমিটি। কাউন্সিলের পর ৫০ দিন পার হলেও ৫০ নেতার নাম সিলেক্ট করতে পারেননি দায়িত্ব প্রাপ্তরা। অনিয়ন, স্বজনপ্রীতিসহ বিতর্কিত কিছু ঘটনার জন্য দলের ভেতরে-বাইরে বড় ধরনের রাজনৈতিক ঝড় বয়ে যেতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছেন নেতা-কর্মীরা।
নির্ভরযোগ্য সূত্রের খবর- এবারের কমিটি হবে অন্তত ৫শ’ সদস্যের। কিন্তু এখন পর্যন্ত মেগা কমিটির খসড়াটি প্রস্তুত করে খালেদা জিয়ার হাতে দিতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা। এ নিয়ে গত কয়দিন আগে উষ্মা প্রকাশ করেছেন চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া।
এদিকে কমিটি গঠনের বেলায় বিএনপির আগামীর কা-ারী ও সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মতামত প্রাধান্য পাবার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। বিভিন্ন পদের নির্বাচনের জন্য লন্ডন থেকে তার পাঠানো তালিকা গুরুত্বই পাচ্ছে না সিন্ডিকেটের কাছে।
সমালোচনা হচ্ছে, ‘দুর্নীতি হবেই শেষ, গণতন্ত্রের বাংলাদেশ’ গত কাউন্সিলের মূল শ্লোগান হলেও বাস্তবে বিএনপিতে ঘটছে তা উল্টোটা। গুরুত্বহীন ব্যক্তিকে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ দিয়ে মোটা অঙ্ক লেনদেনের তথ্য-উপাত্ত এখন নেতাকর্মীদের হাতে হাতে। দুর্নীতির অভিযোগে গুলশান অফিসের নির্বাহী কর্মকর্তা জসিমকে আপাতত সরানো হয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করলেও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তৃণমূলে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতাদের কপালে দলীয় টিকিট জুটছে না। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের দায়িত্ব পালনকারী মোহাম্মদ শাহজাহানকে আপাতত সরানো হয়েছে। পরোক্ষভাবে অভিযুক্ত এই নেতা চিকিৎসার অজুহাতে এখন বিদেশে। ক্যাশিয়ার খ্যাত কয়েকজন আপাতত গুলশানে আসছেন না। আরো কয়েকজনকে সরানো হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।
সুবিধাবাদীদের দিয়ে সৃষ্ট বৃত্তে আবদ্ধ চেয়ারপার্সন এখন হিমশিম অবস্থায় আছেন। আগামী ধাপে কমিটিতে ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন না হলে গুলশান ও নয়া পল্টন কার্যালয়ে অবস্থান নেবে সারা দেশের নেতাকর্মীরা। আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে তারা। গত কমিটির দুই যুগ্মমহাসচিব ও কয়েকজন সম্পাদক এই বিষয়ে ওয়ার্ক করছেন। অপেক্ষায় আছেন পরবর্তী ঘোষণার জন্য।
আংশিক কমিটি গঠন এবং মনোনয়ন সংক্রান্ত অপ্রত্যাশিত ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করে খোদ বিএনপিপন্থী বোদ্ধারা ইনকিলাবের কাছে বলেছেন, শীর্ষ নেতা আরো কঠোর না হলে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে যেমন নেতারা নিষ্ক্রিয় হবে, তেমনি তৃণমূলে লাখো ত্যাগী নেতারা আরেক দফায় ঝরে পড়বে।
গত ১৯ মার্চ কাউন্সিলের পর এ পর্যন্ত তিন দফায় মহাসচিব, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, ৭ যুগ্ম মহাসচিব, ১০ সাংগঠনিক সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ ও ২০ সহ সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নেতা মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। প্রথম দফার ঘোষিত কমিটি নিয়ে বিএনপির অভ্যন্তরে তেমন একটা প্রতিক্রিয়া হয়নি। তবে যুগ্ম-মহাসচিব, সাংগঠনিক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদক পদ ঘোষণার পর নেতাদের একটি অংশ নেতৃত্বের ভারসাম্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন নেতারা। তারা বলেন, একটি সিন্ডিকেট খালেদা জিয়াকে ভুল বুঝিয়েছে। সিনিয়র-জুনিয়রের সমন্বয় এক্ষেত্রে রক্ষা করা হয়নি। দায়িত্বপ্রাপ্তরা তাদের নিজের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছেন। এসব কারণ উল্লেখ করে কেউ কেউ পদ পেয়েও হতাশাগ্রস্ত হন। কেউ মোবাইল ফোন বন্ধ রাখেন, অপ্রত্যাশিত ঘটনা সহ্য করতে না পেরে কেউ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।
সূত্র মতে, নবগঠিত কমিটির যুগ্মমহাসচিব পদে নেতা নির্বাচনের জন্য লন্ডন থেকে তারেক রহমানের তালিকায় ছিলেন ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ইলিয়াস আলী, ড. আসাদুজ্জামান রিপন ও বিএনপির স্বনির্ভর বিষয়ক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর নাম। তাদের কাউকেই ওই পদে রাখা হয়নি। তবে দুলুকে রাজশাহী বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, ইলিয়াস আলীর বিষয়টি আপাতত না হলেও বরিশাল অঞ্চলের দুই যুগ্ম-মহাসচিবের মধ্যে জুনিয়রজনকে বাদ দিয়ে রিপনকে যুগ্মমহাসচিব করার প্রস্তাব দিয়েছেন তারেক রহমান।
সাংগঠনিক সম্পাদকের পদে নেতা নির্বাচনের বেলায় তারেক রহমান চেয়েছিলেন কিশোরগঞ্জের শরিফুল আলমকে ঢাকা বিভাগে এবং শেখ ফরিদ উদ্দিন মানিককে কুমিল্লা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। তার পছন্দের প্রতিফলন ঘটেনি। শরিফুল আলম ময়মনসিংহ বিভাগের বাসিন্দা না হলেও তাকে ওই বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ময়মনসিংহ বিভাগের নেতারা তাকে মেনে নিতে চাইছেন না। ফলে প্রাপ্ত পদ এখন ‘গলার কাঁটা’ হয়েছে শরিফুল আলমের।
এদিকে চট্টগ্রামের লায়ন আসলাম চৌধুরীকে ওই পদে দেখতে চাননি তারেক রহমানসহ চট্টগ্রামের সিনিয়র নেতারাই। আসলাম গত কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন, ত্যাগও রয়েছে। তবে যুগ্মমহাসচিব পদ পাবার যোগ্য নয়। ‘কোটি টাকায় কেনা’ ছবির মতোই আসলামের ওই পদ বলে ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের অভিযোগ। ওই বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়েছে সাবেক ছাত্র নেতা ডা. শাহাদাৎ হোসেনকে। তার চাওয়া ছিলো চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি। কিন্তু চাওয়ার চেয়ে পাওয়া বেশি হয়েছে তার। তবে মহানগর বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পাবার জন্য তার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। প্রত্যাশার বাস্তবায়ন ঘটবে বলে ঘনিষ্ঠজনদের সাথে শেয়ার করেছেন ডা. শাহাদাৎ। ফরিদপুর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত শ্যামা ওবায়েদের বেলায় ঘটেছে ডা. শাহাদাতের মতো ঘটনা। ঢাকা বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকের পদপ্রাপ্ত শহিদুল ইসলাম বাবুলের চাওয়া ছিলো দফতরের কোন এক পদ। তার ঘনিষ্ঠজনদের ভাষ্য-দফতরের ঝামেলা এড়াতে বাবুলকে ফরিদপুর বিভাগ থেকে ঢাকা বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে।
দেশজুড়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে সমালোচনার ঝড়ের মধ্যে গত ২৩ এপ্রিল শনিবার স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য সাবেক মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন গুলশান কার্যালয়ে ঘোষিত কমিটির ব্যাপারে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেছেন, তার বিভাগের নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি কিছুই জানেন না। কুমিল্লা বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ঢাকা কলেজ ছাত্রদল নেতা আব্দুুল আউয়াল খানের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব লোককে কারা কীভাবে মনোনয়ন দিয়েছেন তা জানা দরকার। আউয়াল খান গত উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
এর একদিন আগে বরিশাল বিভাগে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে বিলকিস শিরিনকে ও ফরিদপুর বিভাগে শামা ওবায়েদকে মনোনয়ন দেওয়ার ঘটনায় চেয়ারপার্সনের কাছে গিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন মহিলা দলের নেত্রী শিরিন সুলতানা ও সাবেক এমপি রেহেনা আক্তার রানু। খালেদা জিয়া তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেও পারেননি। রানুকে ফেনীতে তার নিজের আসন থেকে নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার কথা বলে থামানোর চেষ্টা করেন খালেদা জিয়া। কিন্তু রানু তাতে খুশি হননি। দুই নেত্রীকেই ‘না’ বলে দিয়েছেন চেয়ারপার্সন। এ ঘটনার পর থেকে খালেদা জিয়া সহচর হিসেবে হাত ধরার জন্য মহিলা দলের আরেক নেত্রী সুলতানা আহমেদকে ডেকে আনেন, এতদিন যে কাজটি করতেন শিরিন সুলতানা।
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ বলেছেন, যেসব অভিযোগ উঠেছে তার সঠিক তদন্ত এবং সাংগঠনিকভাবে বিচার হওয়া দরকার। নইলে নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা দেখা দেবে। অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার কারণে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক টিপু সুলতান এবং একই উপজেলার দিঘলিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ইউছুফ আলীকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কমিটির খসড়া করতে স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম খানের সহযোগিতা নিতেন চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। এবার ওই দায়িত্ব পালন করছেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস ও বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহম্মেদ। আর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থী মনোনয়নের দায়িত্ব পালন করছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তাকে সহযোগিতা করছেন ময়মনসিংহ বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স।
তৃণমূলে নির্বাচিত হলেও কেন্দ্রের মনোনয়ন মিলছে না :
পাবনার হান্ডিয়াল ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আবু হানিফ। গত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এবারও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী। তিনি দীর্ঘ দিন ধরে ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন পেতে কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক, উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ মোট পাঁচ জনের সুপারিশ লাগে। এর সবই মিলেছে তার পক্ষে। কিন্তু বাধা চেয়ারপার্সনের বিশেষ সহকারী। এবার তার পছন্দের প্রার্থী বিদেশ ফেরত সোহেল রানা। ফলে হানিফের পক্ষে তৃণমূলের সমর্থনেও ধানের শীষ মিলছে না। গত ইউপি নির্বাচনেও হানিফের বিরুদ্ধে মো: এহিয়াকে সমর্থন দেন বিশেষ সহকারী। এহিয়া ভোট পান ১৩শ’ ৫০। যার ফলে হানিফ মাত্র শ’দেড়েক ভোটের ব্যাবধানে পরাজিত হন। সেই এহিয়া এবার নৌকা প্রতীকে ধানের শীষের প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন।
দেওয়ানগঞ্জের পাররামরামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি এমদাদুল হক মিলন। আরেক প্রার্থী মো. আমিনুল ইসলাম। একাধিক প্রার্থী থাকায় নির্বাচন দেয়া হয়। ভোট গ্রহণ করেন উপজেলা বিএনপির নেতৃবৃন্দ। এমদাদুল হক মিলন পান ১৭ ভোট আর আমিনুল ৯ ভোট। কেন্দ্রে এই ফলাফলও পাঠানো হয়। ধানের শীষ মনোনয়ন মিলেছে আমিনুলের হাতে। উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শ্যামল চন্দ বিএনপি চেয়ারপার্সনের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। তবে মহাসচিবের দায়িত্ব পাবার খবরে হতাশাগ্রস্তদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন