শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

নতুন প্রযুক্তির কার্ড

ভারতে চালু হলেও পিছিয়ে বাংলাদেশ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০২ এএম

প্রচলিত ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ অর্থাৎ পুরানো প্রযুক্তির ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড বাদ দিয়ে নতুন ইএমভি প্রযুক্তির কার্ড চালু করেছে ভারত। এই কার্ডে ডেটা চিপ থাকে বলে তা ক্লোন করে জালিয়াতি করা কঠিন। গতকাল মঙ্গলবার ১ জানুয়ারি থেকে পার্শ্ববর্তী দেশটিতে পুরাতন ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ কার্ড বিকল হয়ে গেছে। ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া জালিয়াতি রোধ এবং লেনদেনকে নিরাপদ করতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এদিকে ভারতে পুরানো কার্ড বাতিল হওয়ায় বিপাকে পড়তে যাচ্ছে ভ্রমন পিপাসু ও চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়া বাংলাদেশীরা। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ভারতে ভ্রমন করে প্রায় ২ লাখ বাংলাদেশী নাগরিক। যারা ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করে। আর বাংলাদেশে এখনও অনেক ব্যাংক ম্যাগনেটিক স্ট্রিপযুক্ত পুরানো কার্ড ব্যবহার করছে। যা ভারতে কোন কাজে আসবে না। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক গত ২৬ নভেম্বর লেনদেনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডে নতুন প্রযুক্তি সংযোজনের নির্দেশ দিয়েছে।
এটিএম কার্ড জালিয়াতি রোধে সকল ব্যাংককে নতুন প্রযুক্তির কার্ড ব্যবহারের তাগিদ দিয়েছেন আর্থিক এবং আইটি খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা আশঙ্কা করছেন, এখনই ব্যবস্থা না নিলে আবারও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরি ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। আর তাই ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি রোধে নিরাপত্তার জন্য প্রাধান্য দিতে হবে ইএমভিকে।
সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে প্রচলিত ম্যাগনেটিক স্ট্রিপযুক্ত কার্ডের তুলনায় চিপযুক্ত কার্ড বেশি নিরাপদ। ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ কার্ডের পেছনে কালো রঙের যে ফিতা বা ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ থাকে, তাতে গোপনীয় তথ্য সংরক্ষিত থাকে। প্রতারকরা স্কিমিং ডিভাইসের মাধ্যমে এ ধরনের কার্ডের তথ্য চুরি এবং তা দিয়ে নকল কার্ড তৈরি করে এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলতে পারে। আর চিপযুক্ত কার্ডের তথ্য সংরক্ষিত থাকে কম্পিউটার মাইক্রো চিপে। স্কিমিং ডিভাইস কোনোভাবে এ ধরনের কার্ড থেকে তথ্য চুরি করতে পারে না। যে কারণে বিশ্বব্যাপী এখন চিপভিত্তিক কার্ডের ব্যবহার বাড়ছে।
সূত্র মতে, বিশ্বব্যাপী এটিএম জালিয়াতির কারণে ইউরো পে, মাস্টারকার্ড ও ভিসা-এ তিনটি প্রতিষ্ঠান এক হয়ে একটি গবেষণা করে। এর ফলাফল হিসেবে ১৯৯৩ সালে তারা চিপযুক্ত ইএমভি কার্ডের প্রচলনের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে খরচ বেশি হওয়ার কারণে সব দেশে এখনো তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। বাংলাদেশে ও কিছু ব্যাংক ইএমভি কার্ড চালু করলেও বেশির ভাগ বুথই এখনো ইএমভি গ্রহণের অযোগ্য। এখানে ম্যাগনেটিক স্ট্রাইপ কার্ডের প্রচলনই বেশি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস ডিপার্টমেন্টের এক কর্মকর্তা জানান, দেশের কিছু ব্যাংকের এখনও পুরানো প্রযুক্তির ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড চালু আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ইতোমধ্যে নতুন প্রযুক্তির ইএমভি কার্ড ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছে। এর আগেও গত বছরের জুনের মধ্যে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সব ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড চিপ ও পিনযুক্ত তথা দুই স্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তা করার নির্দেশনা থাকলেও তা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয় অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান। এ কারণে নতুন করে আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই সময়ের মধ্যে নির্দেশনা বাস্তবায়ন না করলে ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এর আগে কার্ডভিত্তিক লেনদেনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নির্দেশনা দেয়। ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ইস্যু করা সব ব্র্যান্ডের কার্ড চিপ ও পিনযুক্ত হতে হবে। ম্যাগনেটিক স্ট্রিপযুক্ত সব কার্ড ২০১৮ সালের ৩০ জুনের মধ্যে চিপভিত্তিক করতে হবে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে সব কার্ডের লেনদেন অবকাঠামো আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পিসিআই ডাটা সিকিউরিটি স্ট্যান্ডার্ড সার্টিফাইড করতে বলা হয়। এ ছাড়া কার্ডভিত্তিক সব ধরনের লেনদেনের তথ্য এসএমএসের মাধ্যমে জানাতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়। আর এজন্য নতুনভাবে স্থাপিত সব এটিএম বুথ বাধ্যতামূলকভাবে চিপ কার্ড পরিচালনার প্রযুক্তি, এন্টি স্কিমিং প্রযুক্তি, পিন গার্ড এবং এনক্রিপ্টেড পিন প্যাড সংবলিত করার নির্দেশনা দেয়া হয়। আগে স্থাপিত এটিএম বুথ এসব প্রযুক্তি সংবলিত করার জন্য ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে অনেক ব্যাংক এখনও আগের এটিএম বুথ সরিয়ে নতুন প্রযুক্তির বুথ বসাতে সক্ষম হয়নি। যে কারণে চিপ প্রযুক্তির কার্ড সরবরাহ করতে পারেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোতে মোট কার্ডের সংখ্যা এক কোটি ৪২ লাখ ৬১ হাজার। এর মধ্যে এক কোটি ৩০ লাখ ৫৫ হাজার ডেবিট কার্ড। ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক রয়েছে ১০ লাখ ৩২ হাজার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী আগামী মার্চের মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকও নতুন প্রযুক্তির কার্ড নিয়ে আসছে উল্লেখ করেছেন ব্যাংকটির এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মাহফুজুর রহমান। তিনি জানান, ইতোমধ্যে এ বিষয়ে সার্বিক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তবে এখন যারা ভারতে ভ্রমন করবেন তাদের বিষয়ে কোন নির্দেশনা ব্যাংক থেকে আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভারতে পুরাতন কার্ড বাতিল করেছে কিনা আমার জানা নেই। তবে এটা হলে খুব শিগগিরই গ্রাহকদের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হবে।
চতুর্থ প্রজন্মের এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ইমরোজ মাহমুদ ইনকিলাবকে বলেন, বিশ্বব্যাপিই নতুন প্রযুক্তির কার্ডের ব্যবহার হচ্ছে। ইউরো পে, মাস্টারকার্ড ও ভিসা আগেই নতুন প্রযুক্তির বিষয়ে বলেছে। ভারতের বিষয়টিও আমাদেরকে জানানো হয়েছে। তাই আমরা আগে থেকেই ইএমভি প্রযুক্তির চিপ কার্ড চালু করেছি। এনআরবিসি ব্যাংকে ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ কার্ড ২০১৮ সালের মে’ মাসের মধ্যে পরিবর্তন করা হয়েছে। এরপরও যারা এখনও পরিবর্তন করেননি তাদেরকে নতুন চিপ কার্ড দ্রুত পরিবর্তন করে নেওয়ার আহবান জানান ইমরোজ মাহমুদ।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরীন বলেন, লেনদেনের নিরাপত্তার জন্য প্রাধান্য দিতে হবে ইএমভিকে। অবশ্যই চিপ কার্ড করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রয়োজন অ্যান্টি স্কিমিং ডিভাইস।
সূত্র মতে, দেশের ৫৭ ব্যাংকের মধ্যে ৩৯টি ব্যাংক কার্ড সেবা দিচ্ছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) জরিপ বলছে, প্রযুক্তিভিত্তিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনো বেশ দুর্বল। বিআইবিএমের জরিপে অংশ নেয়া ৩৬ শতাংশ ব্যাংক মনে করে, যেকোনো মুহূর্তে তাদের তথ্য চুরি হতে পারে। এছাড়া ৩২ শতাংশ ব্যাংক কিছুটা কম ঝুঁকিতে রয়েছে। আর কম ঝুঁকিতে আছে ১২ শতাংশ ব্যাংক। এ অবস্থায় দেশের সব ব্যাংককে তাদের নিজ নিজ এটিএম, পস ও কার্ডগুলো ইএমভিতে রূপান্তরিত করতে ভারতের আদলে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও সক্রিয় হতে পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন