শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৯ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

জন্মরোধে নিষ্ঠুর কর্মীরা এখন শিশু পরিচর্যায়

প্রকাশের সময় : ১১ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : তারা কোটি কোটি মানুষের মধ্যে মর্মবেদনা সৃষ্টি করেছে। অনেক বছর ধরে তাদের কাজ ছিল চীনের ‘এক সন্তান নীতি’ নিষ্ঠুরভাবে বাস্তবায়ন করা। এক সন্তানের পর ফের গর্ভধারণ করলে সেই পরিবারকে তারা গর্ভপাত ঘটাতে বাধ্য করত অথবা বিপুল অর্থ জরিমানা করত যা মেটাতে লোকজন একেবারে নিঃস্ব হয়ে যেত। এখন চীনের ঘৃণিত সেই ‘পপুলেশন পুলিশের’ একটি অংশকে নতুন কাজে নিয়োগ করা হচ্ছে। সেনাবাহিনীর পরিবার পরিকল্পনা কর্মীদের এখন শিশু পরিচর্যার নতুন দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
দুই বছরের লিউ সিকি তার দাদীর কোলে গুটিসুটি মেরে আছে। বাচ্চাটির পেট ব্যথা করছে বলে দাদী জানালেন। এক ব্যক্তি বাচ্চাটিকে শান্ত করতে আওয়াজ করতে পারে এমন প্লাস্টিকের একটি হাঁস দেখিয়ে তাকে আনন্দ দেয়ার চেষ্টা করছে।
আস্তে আস্তে বাচ্চাটির মুড বদলাতে থাকে। বাচ্চাটি মিটিমিটি হাসতে শুরু করে এবং লোকটি তার সঙ্গে একটি নার্সারি ছড়া গাইতে বাচ্চাটিকে উদ্বুদ্ধ করে। চীনা সেনাবাহিনীর এই পরিবার পরিকল্পনা অফিসারকে শিশুটি আংকেল লি নামে ডাকে এবং তাকে খুব পছন্দ করে। বিগত ৩৫ বছরে চীনের প্রতিটি শহর ও গ্রামে মোতায়েন এই বাহিনীর সদস্যদের কাছ ছিল সরকারের ‘এক সন্তান নীতি’ ভঙ্গকারীদের খুঁজে বের করা। কোন দম্পতির কত সন্তান রয়েছে তা বের করা। আজ তাদের কাজের রূপ বদলেছে। শিশুর জন্মরোধে যারা একসময় ব্যস্ত ছিল আজ তারা শিশুদের পরিচর্যা ও আনন্দ দিতে ব্যস্ত।
এ বছরের শুরুতে এক সন্তান নীতি বাতিলের মধ্যদিয়ে লি বো’র মতো কর্মীরা এখন ভিন্ন ভ’মিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। এখন লি বো চৈনিক ফাদার ক্রিসমাসে খেলনা ও ছবির বই ভর্তি ব্যাগ নিয়ে পার্বত্য প্রদেশ শাংশির প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে ছুটে যান।
শাংশি নর্মাল ইউনিভার্সিটি এবং স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির রুরাল এডুকেশন অ্যাকশন প্রোগ্রামের একটি পাইলট প্রকল্পে জড়িত লি বো। তার ৬৮ জন কলিগও এই কর্মসূচীতে নিয়োজিত। তাদের নতুন কাজ হচ্ছে কথা বলা, গান গাওয়া এবং বই পড়ানোর সহজ কৌশলের মাধ্যমে শিশুদের মানসিক বিকাশ সম্পর্কে পিতা-মাতা ও দাদা-দাদীদের শিক্ষা দেয়া।
লি বোর কাজ রাজধানী বেইজিং থেকে ৭০০ মাইল দূরে ডেংফেং কাউন্টিতে। এলাকাটি দরিদ্র অঞ্চল। সেখানকার কাজের উপযোগী বয়সের অর্ধেকের বেশী মানুষ কাজের জন্য বিভিন্ন শহরে চলে গেছে।
লিউ সিকি ৬ কোটি ১০ লাখ শিশুরই একজন যাদের মা বাবা কাজের জন্য বেশীর সময় বাইরে থাকেন। তাই তাকে লালন পালন করছেন তার দাদা-দাদী। তার মা একটি নুডুল কারখানায় কাজ করেন সেখানে যেতে গাড়িতে চার ঘণ্টা সময় লাগে। যে কারণে তিনি ঘনঘন বাড়িতে আসতে পারেন না। পিতার কাজ অনেক দূরের এক খনিতে। বছরে মাত্র দুইবার তিনি বাড়ি আসতে পারেন।
প্রথমে তার দাদী চেন হুয়াফেন এত ছোট বাচ্চার পড়াশোনা সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন। একগাল হেসে তিনি বললেন, আগে মনে করতাম এটা সময়ের অপচয়। তবে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম যে লিউ সিকি গল্প শুনতে ভালবাসে এবং আরো আশ্চর্যের ব্যাপার যে এসব গল্পের অধিকাংশই সে মনেও রাখতে পারে।
১৯৭৯ সালে যখন এক সন্তান নীতি চালু করা হয় তখন দাদী চেন ছিলেন একজন কিশোরী।
সাহায্য করতে লি আসাতে দাদী এখন অনেকটা স্বস্তিতে আছেন। তবে পরিবার পরিকল্পনা কর্মীদের সম্পর্কে তার নিজের অভিজ্ঞতাও খুবই তিক্তকর। গোটা গ্রামই তাদের ঘৃণা করে। যেসব পরিবার একাধিক সন্তানের জন্য জরিমানার অর্থ পরিশোধ করতে পারতোনা এসব কর্মী তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতো। তারা রাতের বেলায় আসতো এবং একাধিক সন্তানের পরিবারের বাইসাইকেল, সেলাই মেশিন থেকে শুরু করে জামা কাপড় পর্যন্ত নিয়ে নিতো। এমনকি তারা মানুষের গরু বাছুর ও শুকর পর্যন্ত নিয়ে যেত।
চেন পরিবার পরিকল্পনা কর্মীদের খুবই ঘৃণা করতো। যদিও প্রত্যন্ত পল্লীতে প্রথম সন্তান মেয়ে হলে দ্বিতীয় সন্তানের অনুমতি দেয়া হতো। চেনের প্রথম সন্তান ছেলে হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তিনি দ্বিতীয় সন্তান নিতে পারেননি। ফের গর্ভবতী হয়ে পড়লে তাকে গর্ভপাত ঘটাতে বাধ্য করা হয়েছিল। পরে যখন আবার তিনি গর্ভবতী হলেন তখন তিনি গোপন স্থানে লুকিয়ে পড়েন এবং সেখানে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। আইন ভাঙ্গার জন্য জরিমানা নিয়ে তিনি সবসময়ই শংকার মধ্যে থাকতেন এবং সেই মেয়ে সন্তানটি লোকচক্ষুর আড়ালেই বড় হয়ে ওঠে। তিনি নিজের মর্মবেদনা বর্ণনাকালে বললেন, ‘সামাজিক রক্ষণাবেক্ষণ ফি’ নামের এই জারিমানার অর্থ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্রের চোখে তোমার সন্তানের কোন অস্তিত্বই নেই। এর অর্থ হচ্ছে সে স্কুলে যেতে পারতো না, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সুবিধা পেত না এমনকি ট্রেনের টিকিট কেনার কোন অধিকারও তার ছিল না।
অতীতের স্মৃতিচারণ করে চেন বললেন, আমার সেই সন্তানটি আমার মায়ের সঙ্গে ১২ বছর পাহাড়ে কাটিয়েছে। ১২ বছর পর কোনোমতে তার নিবন্ধন করার পর সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।
চলতি বছরের শুরু থেকে সকল চীনা দম্পতিকে দুই সন্তান গ্রহনের অনুমতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর বেশী নয়। তবে জাতিগত সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে এই নীতি কিছুটা শিথিল। তাই লি বো এখনও তার সময়ের কিছুটা ব্যয় করেন জন্ম নিয়ন্ত্রণ অফিসার হিসেবে কাজ করার ক্ষেত্রে। শহরের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে স্থানীয় মহিলাদের পরীক্ষায় তিনি বেশ কিছুটা সময় ব্যস্ত থাকেন।
চীনে আইন অনুযায়ী সন্তান ধারণে সক্ষম সকল মহিলাকে বছরে চারবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক। তাদের স্বাস্থ্য ঠিক আছে এবং সরকারের অনুমতি ছাড়া তারা গর্ভধারণ করেননি এটা নিশ্চিত করতেই এই পরীক্ষা। কোন দম্পতি সন্তান নিতে চাইলে গর্ভধারণের আগে তাদের সরকারী অনুমোদন নিতে হয়। প্রতিটি মহিলার মেডিকেল হিস্ট্রি একটি বইতে লিপিবদ্ধ থাকে। সন্তানের সংখ্যা, জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহন এবং গর্ভপাত ঘটানোর সকল তথ্যই এই বইতে রাখা হয়।
সরকারের সন্তান নীতি নিয়ে চীনের নাগরিক সমাজে অসন্তোষ থাকলেও লি বো কমিউনিস্ট পার্টির স্থানীয় কমিটির একজন কর্মকর্তা হিসেবে তিনি মনে করেন যে ব্যক্তির সুবিধার চেয়ে সমাজের বৃহত্তর সুবিধার বিষয়টি রাষ্ট্রই ভালো জানে। পার্টি এবং সরকারের নির্দেশ অনুযায়ীই তাকে এ ধরণের অজনপ্রিয় কাজ করতে হয়। তিনি বললেন, বিপুল জনসংখ্যা নিয়ে চীন গুরুতর সসম্যার মধ্যে রয়েছে। তাই আমরা দম্পতিদের বলছি যে একাধিক সন্তানের জন্ম হলে জীবনমান নেমে যাবে যা সন্তানের জন্যও ভালো হবে না।
প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে যেখানে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ শিথিল সেখানে লোকজন পরিবার পরিকল্পনা কর্মীদের উপর চড়াও হওয়ার ঘটনাও ঘটে। বো নিজেও স্বীকার করলেন যে গ্রামে লোকজন তাদের গাড়িতে পর্যন্ত হামলা চালায়।
চীন সরকার বলছে, ১৯৭৯ সালে এক সন্তান নীতি চালু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৪০ কোটি শিশুর জন্ম ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। তবে এই নীতির এত বিপুল প্রভাব নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এক সন্তান নীতির কারণে সেখানে নারী-পুরুষের মধ্যে সংখ্যা সাম্যে ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে। হিসাব অনুযায়ী চীনে এখন নারীর চেয়ে পুরুষের সংখ্যা ৩ কোটি ৩০ লাখ বেশী। ২০৫০ সাল নাগাদ চীনের জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশের বয়স ৬৫ বছর বা তার উপরে হবে বলে জনসংখ্যা রিপোর্টে আভাস দেয়া হয়েছে। এক সন্তান নীতি কার্যকর করতে গিয়ে দম্পতিদের ওপর নিষ্ঠুরতা চালানো হতো। গর্ভধারণের প্রাথমিক অবস্থায় জানা গেলে তাদের গর্ভপাতে বাধ্য করা হতো। অনেকে প্রাথমিক সময়ে এটা গোপন রাখতো এবং পরে গর্ভপাত ঘটানোর সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর সরকারকে জানাতো। তখন তাদের উপর নেমে আসতে বিপুল অর্থের জরিমানা। অনেক সময় দম্পতিদের আত্মীয়স্বজনকেও আটক করা হতো। এখন এক সন্তান নীতি পরিবর্তন করা হলেও যাতে সন্তানের সংখ্যা দুইয়ের বেশী না হয় সেদিকে কড়া নজর রাখা হচ্ছে।
এক সন্তান নীতি চীনের কোটি কোটি পরিবারের জীবনে দুর্ভোগ ডেকে এনেছে। তারা এজন্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মীদের ঘৃণা করে। এই নীতি চীনে কি আদৌ কোন সুফল বয়ে এনেছে তা এক বিরাট প্রশ্ন। চরম সত্য হচ্ছে যে চীনে আজ অতিরিক্ত জনসংখ্যা কোনো সমস্যা নয় বরং সমস্যা হচ্ছে এর ফলে শ্রমশক্তি সংকুচিত হচ্ছে যা ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধিতে হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। সূত্র : বিবিসি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন