রফিকুল ইসলাম সেলিম : বৈশাখের তীব্র তাপদাহ আর সেই সাথে পানি বিদ্যুতের তীব্র সংকটে চট্টগ্রামে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। প্রচÐ গরমে বিদ্যুৎ ও পানির চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হওয়ায় সংকট চরমে উঠেছে। বিদ্যুতের অভাবে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানি কার্যক্রম বিঘিœত হচ্ছে। স্থবির হয়ে পড়েছে কল-কারখানায় উৎপাদনের চাকা।
বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও তার সুফল মিলছে না। সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, দেশের মানুষ লোডশেডিং ভুলতে বসেছে, কিন্তু বাস্তবে তার উল্টো। বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে এখন অসহনীয় লোডশেডিং চলছে। রাতের তুলনায় দিনের বেলায় বেশি লোডশেডিং দেয়া হচ্ছে। এতে করে কলকারখানায় উৎপাদন মারাত্মক বিঘিœত হচ্ছে। উৎপাদনের চাকা সচল রাখতে কারখানা মালিকেরা বিকল্প ব্যবস্থা করছে, তাতে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার কারণে সময় মতো উৎপাদন না হওয়ায় পণ্য শিপমেন্ট করতে পারছে না তৈরী পোশাক কারখানার মালিকেরা। এতে করে রফতানি আদেশ বাতিল হচ্ছে, ক্ষতির মুখে পড়ছেন কারখানা মালিকেরা। বিদ্যুৎ সংকটের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে ক্ষুদ্র শিল্প কারখানা মালিকেরা। তাদের ব্যবসা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
নগরীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রায় প্রতিটি এলাকায় রাতে দিনে কয়েক দফায় লোডশেডিং করা হচ্ছে। একবার বিদ্যুৎ গেলে এক ঘন্টারও বেশি সময় পুরো এলাকা বিদ্যুৎহীন থাকছে। লোডশেডিংয়ের পাশাপাশি সঞ্চালন ব্যবস্থার ত্রæটির কারণেও অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ বিপর্যয় হচ্ছে। তীব্র গরমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন থাকায় জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে।
নগরীর জুবিলি রোডের ব্যবসায়ী আবুল হাসনাত বলেন, এই এলাকায় দিনে অন্তত আট থেকে দশবার লোডশেডিং করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত তিনবার বিদ্যুৎ চলে গেছে। একবার বিদ্যুৎ চলে গেলে এক থেকে সোয়া এক ঘন্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ আসছে না। এতে করে এলাকার ব্যবসা বাণিজ্য মারাত্মক বিঘিœত হচ্ছে।
আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার একটি বেসরকারী প্রতিষ্টানের কর্মকর্তা কাজিম উদ্দিন বলেন, সকালে অফিস শুরু পর থেকে বিকেলে অফিস ছুটির আগ পর্যন্ত পুরো এলাকায় গড়ে ৫ থেকে ৬ বার করে লোডশেডিং করা হচ্ছে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় অফিস পাড়া বিশেষ করে ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনলাইন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। স্বাভাবিক কাজকর্ম বিঘিœত হওয়ায় আমদানি-রফতানি কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ছে। অন্তত এসব গুরুত্বপূর্ণ এলাকাকে লোডশেডিং মুক্ত রাখা দরকার বলে মনে করেন তিনি। রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত মহানগরীর জুবিলী রোডসহ অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না।
সরকারীভাবে বলা হচ্ছে সন্ধায় নগরীতে সর্বোচ্চ ১৩০ মেগাওয়াট লোডশেডিং দেয়া হচ্ছে। তবে বাস্তবে এর পরিমান আরও বেশি। দিনের বেলায় রাতের তুলনায় বেশি লোডশেডিং করা হলেও সেই হিসাবে পিডিবির কাছে নেই।
রাতে দিনে সমানে লোডশেডিং করা হচ্ছে। গ্যাসের অভাবে দুইটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ। কাপ্তাই হ্রদে পানি কমে যাওয়ায় চালানো যাচ্ছে না কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ মহাপ্রকল্পের দুটি ইউনিট। খরচ কমাতে দিনের বেলায় বন্ধ থাকছে ফার্নেস ওয়েল চালিত তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এতে করে এই অঞ্চলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে।
পিডিবি চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) মো. মনিরুজ্জামান বলেন, বর্তমানে চট্টগ্রামের বিদ্যুৎ চাহিদা প্রায় সাড়ে ৯শ মেগাওয়াট। পিক আওয়ারে বিদ্যুৎ সরবরাহ মিলছে প্রায় ৮শ মেগাওয়াট। বাকিটা লোডশেডিং করতে হচ্ছে। দিনের বেলায় লোডশেডিং আরও বেশি হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, দিনের বেলার হিসাবটা আমাদের কাছে নেই।
পিডিবি সূত্র জানায়, গ্যাসের অভাবে রাউজান তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ২১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি ইউনিট বন্ধ। একই কারণে বন্ধ শিকলবাহা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। গ্যাসের সরবরাহ কম হওয়ায় রাউজানের চালু ইউনিট থেকেও পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ মিলছে না। কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৫টি ইউনিটের ২টি পুরোপুরি বন্ধ। বাকি তিনটি পিকআওয়ারে সচল থাকছে।
আবার হাটহাজারী, জুলধা ও দোহাজারীতে প্রতিটি একশ মেগাওয়াট ক্ষমতার তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র শুধুমাত্র রাতে পিক আওয়ারে চালু করা হচ্ছে। খরচ কমাতে দিনের বেলায় তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ থাকে। বর্তমান সরকারের সময় চট্টগ্রামে সরকারি-বেসরকারি বেশ কয়েকটি নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করা হলেও এর সুফল মানুষ পাচ্ছে না। গত কয়েক বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন যেহারে বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি বেড়েছে চাহিদা।
বিদ্যুতের সাথে পাল্লা দিয়ে তীব্রতর হচ্ছে পানি সংকট। চট্টগ্রাম ওয়াসা নগরীর এক তৃতীয়াংশ পানির চাহিদা পূরণ করার ক্ষমতা রাখে। বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার কারণে ওয়াসার পানি উত্তোলণ, পরিশোধন ও সরবরাহ বিঘিœত হচ্ছে। একদিকে বিদ্যুৎ সংকট অন্যদিকে বৃষ্টিহীন গ্রীস্মের প্রচÐ গরমে পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়ায় ওয়াসার গভীর নলকূপগুলোতে পর্যাপ্ত পানি উঠছে না। এতে করে পানি উৎপাদন কমে গেছে।
এমনিতেই পানি সংকটের কারণে রেশনিং করে বিভিন্ন এলাকায় পানি সরবরাহ করে ওয়াসা। এখন উৎপাদন কমে যাওয়ায় সরবরাহও কমে গেছে। ওয়াসার সূত্র জানায়, সরবরাহ কমে যাওয়ায় পানির চাপ কমে গেছে। এরফলে নগরীর উচুঁ ও দূরবর্তী এলাকায় পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ওয়াসার গ্রাহকেরা রাত জেগেও পানি পাচ্ছে না। কোন কোন এলাকায় সপ্তাহে একদিনও ওয়াসার পানি পাওয়া যাচ্ছে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন