শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে দুর্বৃত্তদের হামলা : আনসার সদস্য নিহত

প্রকাশের সময় : ১৪ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৪৮ পিএম, ১৩ মে, ২০১৬

কক্সবাজার অফিস ও টেকনাফ সংবাদদাতা : কক্সবাজারের টেকনাফ নয়াপাড়া মোচনী নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের আনসার ব্যারাকে চিহ্নিত সশস্ত্র দুর্বৃত্ত দলের হামলায় আলী হোসেন (৫৫) নামে এক আনসার সদস্য নিহত হয়েছেন। এ সময় ব্যারাকের ১১টি অস্ত্র ও ৬৭০ রাউন্ড গোলাবারুদ লুট করে দুর্বৃত্তরা। নিহত আনসার সদস্য টাঙ্গাইল জেলার শফিপুর ইউনিয়নের মৃত শুক্কুর আহমদের ছেলে।
শুক্রবার ভোররাত সাড়ে ২টার দিকে মোচনী নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শালবাগান আনসার ক্যাম্পে এ ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, টেকনাফের নয়াপাড়া নিবন্ধিত শরণার্থী শিবিরের পার্শ্ববর্তী পাহাড় থেকে ‘সি’ ও ‘ডি’ ব্লকসংলগ্ন শালবাগান আনসার ক্যাম্পের সামনে থেকে ৩ ব্যক্তি পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। এ সময় কর্তব্যরত আনসার সদস্য অজয় বড়–য়া তাদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় অপর মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা তাকে পেছন থেকে চোখ বেঁধে রাখে। এ সুযোগে দুর্বৃত্তরা ভেতরের ব্যারাকে ঢুকে ৮ জন আনসার সদস্যকে রশি দিয়ে বেঁধে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে অস্ত্রাগারে থাকা ১১টি অস্ত্র ও ৬৭০ রাউন্ড গোলাবারুদ লুটের সময় আনসার কমান্ডার মোঃ আলী হোসেন বাধা দিলে দুর্বৃত্তরা তার ওপর গুলি চালায়। পরে তাকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ক্যাম্প হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক আলী হোসেনকে মৃত ঘোষণা করেন।
তথ্যনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, অস্ত্রাগার লুট ও আনসার সদস্যকে গুলি করে যাওয়ার পথে ২টা ৪৫ মিনিটের দিকে স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল আমিন নামে এক ব্যক্তি তাদের দিকে টর্চলাইট মারলে দুর্বৃত্তদের চিনতে পারায় তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাথায় ব্যাপক আঘাত করে পার্শ্ববর্তী ড্রেনে ফেলে পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যায়। আহত আবদুল আমিন জাদিমুরা এলাকার আমির হামজার ছেলে। বর্তমানে সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছে।
শরণার্থী শিবিরের ৪টি আনসার ক্যাম্পের মধ্যে শালবাগান একটি। এ ক্যাম্পে ১৬ জন আনসার সদস্য থাকার কথা থাকলেও ছিলেন ৯ জন। তারা হচ্ছেন নিহত কমান্ডার মোঃ আলী হোসেন, অজিত বড়–য়া, শ্রী চয়ন কুমার শীল, মোঃ হোসাইন, আবদুর রাজ্জাক, মোঃ শহিদ, ইব্রাহীম খলিল, মোঃ আমজাদ ও নায়েক রফিক।
স্থানীয়রা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চট্টগ্রামে অবস্থানকারী রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) নেতা আবদুর রাজ্জাক ও ডি ব্লকের শীর্ষ দুর্বৃত্ত রফিক, টেকনাফে অবস্থানকারী আবদুল হাকিম দুর্বৃত্ত, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের মোস্তাক, দুর্বৃত্ত হারুন, নুর আলম, নেজাম, জকির আহমদ, রশিদ উল্লাহ, হাসান, মোঃ আয়াছ, হোসেন আহমদ, কেফায়েত উল্লাহ, মাষ্টার রশিদ, ডা. ইউনুছ, খোরশেদ ও মাহামুদুল হাসান এবং কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের খাইরুল আমিনসহ একটি সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্তদল মিয়ানমার, বিভিন্ন প্রধান সড়কে ডাকাতিসহ খুনের মতো ঘটনার সাথে জড়িত।
স্থানীয়রা আরো ধারণা করছেন, এ সিন্ডিকেটের প্রধান (আরএসও) নেতা আবদুর রাজ্জাক কয়েক দিন আগে টেকনাফে এসেছেন এবং কয়েক দিন ধরে তাকে পাহাড়ে আনাগোনা করতে দেখা গেছে। তারাই এ ঘটনার সাথে জড়িত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
ঘটনার খবর পেয়ে বিজিবির সেক্টর কমান্ডার তানভীর আহমদ, জেলা প্রশাসক আলী হোসেন, ইউএনও শফিউল আলম, ২৯ আনসার ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার তানজিনা বিনতে এরশাদসহ র‌্যাব, বিজিবি, পুলিশ, আনসার, গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ আবদুল মজিদ জানান, রাত আড়াইটার দিকে একদল মুখোশধারী ক্যাম্পের অস্ত্রগারের প্রহরীকে বেধে রেখে অস্ত্র লুট করে। এসময় পাশে আরেক সদস্য আলী আহমদ (৫৫) ঘুম থেকে জেগে উঠলে তাকে সরাসরি গুলি করে মুখোশধারীরা ২টি এসএমজি, ৪টি শটগান, ৫টি চায়না অস্ত্র ও ৬৭০ রাউন্ড গোলাবারুদ নিয়ে পালিয়ে যায়।
তিনি আরো জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পশ্চিমে রয়েছে পাহাড়। আর ওই পাহাড়ে দুর্বৃত্ত দলের আস্তানা রয়েছে বলে স্থানীয়দের কাছ থেকে জানতে পেরেছি। এর প্রেক্ষিতে ওই আস্তানা লক্ষ করে অভিযান চালানো হচ্ছে।
ক্যাম্প ইনচার্জ শাহীন উল ইসলাম ঘটনার সতত্যা নিশ্চত করে জানান, অস্ত্রগার লুট ও আলী হোসেন নামে এক আনসার কমান্ডারকে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।
ক্যাম্প পুলিশের পরির্দশক মো. কাসেম জানান, নিহতের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে এবং এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
শরণার্থীদের অভিযোগ, কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এরা লালিত-পালিত হয়। এ ব্যাপারে পুলিশ ক্যাম্প ইনচার্জ আবুল কাশেম জানান, পাহাড়ে অবস্থান করায় তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হচ্ছে না।
বর্তমানে ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ, বিজিবি, আনসার মোতায়েন করা হয়েছে। আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে শরণার্থী শিবিরের লোকজন ও এলাকাবাসী।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আলী হোসেন বলেন, ‘এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য থেকে তাদের কাছে মনে হয়েছে বিষয়টি স্থানীয় কোনো মাদক চোরাচালান চক্রের কাজ। তাৎক্ষণিকভাবে এটি কোনো সন্ত্রাসী চক্র বা কোনো জঙ্গী গোষ্ঠীর কাজ বলে তাদের কাছে প্রতীয়মান হয়নি। তবে সব বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত চলছে বলেও জেলা প্রশাসক জানান।
উল্লেখ্য, ১৯৭৮ সাল থেকে পাশর্^বর্তী মিয়ানমার থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিলেও পর্যায়ক্রমে প্রত্যাবাসনের পরে উখিয়া-টেকনাফের দুটি শরণার্থী ক্যাম্পে ৩৫ হাজার মতো রেজিস্টার্ড রোহিঙ্গা থেকে যায়। মিয়ানমারের অসহযোগিতার কারণে তাদের প্রত্যাবাসনে দেখা দেয় জটিলতা। এই সময়ে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ গোলযোগের কারণে সেখানে নতুন করে রোহিঙ্গা বিতাড়নের ঘটনা ঘটে বেশ কয়েকবার। এসময় বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া হাজার হাজার রোহিঙ্গা। আনরেজিস্টার্ড রোহিঙ্গা হিসেবে উখিয়া টেকনাফের আরো দু’টি ক্যাম্পে আশ্রয় নেয় তারা। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন গ্রামে কমপক্ষে ১০ লাখেরও বেশী রোহিঙ্গা অবস্থান করে আসছে। অনন্যোপায় হয়ে আরো ১০ লাখের মত রোহিঙ্গা বিশে^ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশী পাসপোর্ট ব্যবহার করে বসবাস করে আসছে।
উখিয়া-টেকনাফের এসব রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিয়ে বেশ কিছু এনজিও শরণার্থী সেবার নামে ব্যাপকভাবে ব্যবসা চালিয়ে আসছে সরকারকে অনেকটা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে। কয়েকটি এনজিও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ধর্মান্তরিত করার ঘটনা ফাঁস হয়েছে কয়েকবার। অভিযোগ রয়েছে ওই এনজিওগুলো মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সাথে গোপনে সম্পর্ক গড়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ঠেকিয়ে রেখেছিল বছরের পর বছর।
এখন মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ মনে করে রোহিঙ্গা মুসলমানদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দিয়ে সেদেশে প্রত্যাবাসনই হতে পারে একমাত্র রোহিঙ্গা সম্যার সমাধান।
সখিপুরে শোকের ছায়া
সখিপুর (টাঙ্গাইল) উপজেলা সংবাদদাতা : কক্সবাজারের টেকনাফ আনসার ক্যাম্পে দুর্বৃত্তদের হামলায় নিহত আনসার কমান্ডারের বাড়ি টাঙ্গাইলের সখিপুর পৌরসভার রেজিস্ট্রি পাড়ায়। এলাকায় সে আলী হোসেন নামে পরিচিত। তার বাবার নাম দবির উরফে দাবাইড়া। আলী হোসেনের নিহত হওয়ার খবর সখিপুরে এলে পরিবারসহ সখিপুর পৌরসভায় শোকের ছায়া নেমে আসে। খবর শোনার পর আলী হোসেনের ভাই আবুলসহ ৩ জন সখিপুর থেকে টেকনাফের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। নিহতের পরিবারকে সান্ত¦না দিতে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলে বাড়িতে গিয়ে হাজির হচ্ছে। পরিবারের সদস্যরা জানায়, আলী হোসেনের নিকট অস্ত্রের চাবি ছিল, চাবি না দেওয়ায় দুর্বৃত্তরা তাকে গুলি করে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন