আফজাল বারী : বিএনপির নির্বাহী কমিটিসহ অন্যান্য কমিটি ঘোষণা করা হচ্ছে ধাপে ধাপে। এতে প্রাধান্য পাচ্ছে তারুণ্য। সময়ের সাথে পরিবর্তনে অতীতের কর্মী এখন নেতা। ইতোমধ্যে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। হাতে গড়া নিজের কর্মী এখন নেতা বনে গেছেন। আগামীর কমিটিতে নিজের স্থান কোথায় হবে তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন দলটির সিনিয়র নেতারা। আন্দোলন-সংগ্রামের নিজের আমলনামা বিশ্লেষণ করে আপাতত সান্তনা খুঁজছেন কেউ কেউ।
এদিকে নেতা নির্বাচনের বেলায় আগে অঞ্চলের প্রভাবশালী বা রাজনৈতিক অভিজাত/বনেদি পরিবার তালাশ করা হলেও এখন আর সেটি নেই। টাকার কাছে কুপোকাত হচ্ছে আভিজাত্য। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলাপকালে এমন হতাশার কথা জানিয়েছেন বনেদি পরিবার ও বিএনপির ডাকসাইটের একাধিক সিনিয়র নেতা।
এক প্রশ্নের জবাবে ফরিদপুরের অভিজাত পরিবারের সদস্য বিএনপির ভাই চেয়ারম্যান চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ ইনকিলাবকে বলেন, জিয়াউর রহমানের ধারাতেই আছে বিএনপি। আপনার প্রশ্নের বাস্তবতা তো রয়েছেই। তবে এবার তা ঠিক হয়ে যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আরেক বনেদি পরিবারের চট্টগ্রামের গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, রাজনীতিতে অভিজাত পরিবারের গুরুত্ব কমে গেছে। তবে এটা শুধু বিএনপি নয় ডানে-বামে সকল রাজনীতিক দলের বেলায় একই চিত্র। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নেতা নির্বাচনের জন্য এখন আভিজাত্যের চেয়ে আর্থিকভাবে স্বাবলম্ভিতাকেই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বেশি।
দলীয় সূত্রমতে, বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারনী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির আকার বাড়ছে না। ১৯জনই থাকছে। আগের সংখ্যাই রাখার কথা উঠছে চেয়ারপার্সনের ৩৪ সদস্যের উপদেষ্টা কাউন্সিল নিয়ে। তবে ‘মেঘা’ হচ্ছে দলটির নির্বাহী কমিটি। অন্ততঃ পাঁচশত নেতার সমন্বয় ঘটছে এই তালিকায়। এছাড়াও বিষয়ভিত্তিক উপ-কমিটি থাকছে ২৯টি। প্রতি কমিটিতে ১০/১২জনের স্থান হবে এই উপ-কমিটিতে।
বিএনপির ৮ যুগ্ম-মহাসচিবের মধ্যে সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব থেকে মহাসচিব পদে উন্নীত হয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহম্মেদকে পদোন্নতি দিয়ে সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব করা হয়েছে। বহাল আছেন ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। বাকি ছয়জনের ভাগ্যে কি আছে তা নির্ভর করছে দলীয় চেয়ারপার্সনের উপর। অনেকেই প্রত্যাশা করছেন এই ছয়জনের জায়গা হচ্ছে ভাইস-চেয়ারম্যান পদে। কারো কারো মনে উন্নতির বদলে পদাবনতির শঙ্কাও বিরাজ করছে।
ঢাকা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলনকে আগের পদেই রাখা হয়েছে। অবিভক্ত বিভাগের দায়িত্ব থেকে খ-িত বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তার সমসাময়িক সাংগঠনিক সম্পাদকের কয়েকজন পদোন্নতি পেয়েছেন। আবার রাজনীতিতে অনুসারিও স্থান পেয়েছে যুগ্মমহাসচিব পদে। সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মশিউর রহমানের পদাবনতি ঘটেছে। খুলনা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক থেকে তিনি এখন ওই বিভাগের অর্ন্তভূক্ত ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির সভাপতি।
বর্তমান কমিটিতে ভাইস-চেয়ারম্যানের সংখ্যা ১৭। এই পদ থেকে কয়েকজনের উন্নীত হবার কথা ছিলো সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে। তবে সংখ্যায় ১/২জন। এই পদে সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হবে বলে জানা গেছে। তরুণ নেতাদের অগ্রাধিকার দেয়ায় এই পদে থাকা নেতারা টেনশনে আছেন। কারণ তাদের পদোন্নতি না হলে হয়তো এক সময়ের নিজ কর্মী হবেন তার সমপদের। এতে করে রাজনৈতিক পদমর্যদার চেয়ে সামাজিক পদমর্যদাতে আঘাত আসতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই।
উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য সংখ্যা ৩৪ জন। আরো বাড়ছে এই সংখ্যা। স্থায়ী কমিটি ৩টি শূণ্যপদ পুরণের জন্য এই কাউন্সিলের ২/১ সদস্যের স্থান হতে পারে ওই কমিটিতে। এদিকে উপদেষ্টা কমিটিকে আরো মর্যদাপূর্ণ করতে চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা কাউন্সিলকে বিএনপির উপদেষ্টা কাউন্সিলে নামকরণ করার প্রস্তাব এসেছিলো। পদমর্যদা রাখার কথা ছিলো স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সমান। কিন্তু দলের স্থায়ী কমিটির আলোচনায় তা ভেস্তে গেছে। নির্বাহী কমিটিতে যারা সম্পাদকীয় পদে ছিলেন তাদের মধ্যেও শঙ্কার প্রবল চাপ আছে। তাদের চিন্তা হলো-পদোন্নতি না পাই কর্মীর অধীনে যেনো না যেতে হয়। চাউর রয়েছে পছন্দের পদ পেতে জুনিয়র নেতাদের মতো বিভিন্ন মাধ্যমে চেষ্টা-তদবির করছেন সিনিয়র নেতারাও। অর্থকড়ির লেনদেনে সম্পৃক্ত হচ্ছেন কেউ কেউ। এ নিয়ে গত সোমবার দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উষ্মা প্রকাশ করেছেন কমিটির সদস্যরা। দলের ভাবমূর্তি অক্ষুণœ রাখতে তারা গণমাধ্যমে প্রচার-প্রকাশিত অভিযোগের তদন্ত চেয়েছেন।
প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বিএনপির সাথে সম্পৃক্ত নেতাদের সাথে আলাপকালে তারা জানান, দলটির প্রতিষ্ঠা করবার সময় প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দলীয় নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য গুরুত্ব দিতেন। তারমধ্যে ছিলো- শিক্ষা, পারিবারিক প্রভাব বা বনেদি পরিবার, জনসম্পৃক্ততা ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন রাজনৈতিক। সে বিবেচনা থেকেই মুন্সিগঞ্জের বনেদি পরিবার থেকে ডা. এ কিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, নরসিংদীর আবদুল মোমেন খান, পঞ্চগড়ের ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, জামালপুরের অভিজাত পরিবারের ব্যারিস্টার আব্দুস সালাম তালুকদার, গাজীপুরের চৌধুরী তানভীর আহম্মেদ সিদ্দিকী, এই মহাদেশের খ্যাতনামা রাজনৈতিক মশিউর রহমান যাদুমিয়া, ফরিদপুরের কেএম ওবায়দুর রহমান, যশোরের তরিকুল ইসলাম, মানিকগঞ্জের খন্দকার দেলোয়ার হোসেন, এ অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ পার্লামেন্টারিয়ান শাহ আজিজুর রহমান, পানি বিশেষজ্ঞ এসএ বারী এটি ও ড. এম আর খান, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীদের মতো ঐতিহ্যবাহী পরিবার ও সুখ্যাতনামা ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছেন। নেতার জনপ্রিয়তা বা প্রভাবে হাজারো নেতার আগমন ঘটেছে দলে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও দলীয় রাজনীতির গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। যার ফল মিলেছে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনে। বিএনপিতে সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়েছে নিকট অতীতেও। কালক্রমে এখন আগের অবস্থানে নেই দলটি। একই সমস্যা বিএনপির অঙ্গ সংগঠনেও। কোন কোন সংগঠনের সুপার ফাইভ-এ থাকা নেতার শিক্ষা কলেজ পর্যন্ত গড়ায়নি। সুখ্যাতির বদলে আছে কুখ্যাতি। আছে সন্ত্রাসী হিসেবে পুলিশের কালো ‘ক্রসফায়ারের তালিকায়। এমনও আছে বর্তমানে প্রভাবশালী নেতার বংশধর ছিলেন ছিন্নমূল। পারিবারিক অতীত পরিচয় দিতে নেতা নিজেই লজ্জাবোধ করেন। ওই নেতার হাতেই দেয়া হয়েছে অসীম ক্ষমতা। এখন দলটির রাজনীতি অনেকটা তারাই নিয়ন্ত্রণ করছেন। শাসন করতে চায় বনেদিদের। সিনিয়র নেতার বাসায় বয়-বেয়ারার দায়িত্ব পালনের সুবাদে কোন কোন সংগঠনের শীর্ষ নেতা বনে যাওয়ার নজির রয়েছে এই দলে। এর পরিণতি এমনটাই হচ্ছে যে, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আক্রান্ত হচ্ছেন নিজ দলের বিতর্কিত নেতার হাতে। এ বিবেচনায় রেখে নতুন কমিটিতে সন্ত্রাসী বা দুর্নীতিবাজদের যেনো স্থান না হয় সেজন্য শীর্ষ নেতার প্রতি আহ্বান রেখেছেন দলীয় নেতারাই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন