শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

শুরু হলো মধুমাস

রসালো শাঁসালো ফলের ডালি ॥ আর দৃষ্টিনন্দন ফুলের সমারোহ

প্রকাশের সময় : ১৫ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রেজাউল করিম রাজু : তাপ প্রবাহের দাপট দেখিয়ে বিদায় নিল বৈশাখ। শুরু হলো জ্যৈষ্ঠ। রসালো শাঁসালো হরেকরকম ফলের ডালি নিয়ে হাজির হয় বলে এর আরেক নাম মধুমাস। চৈত্র-বৈশাখের খরতাপে অতিষ্ঠ তৃষ্ণাত মানুষের প্রাণ জুড়াতে প্রাকৃতিক নিয়মে এ মাসে হরেক রকমের ফল চলে আসে বাজারে। এ সময় গাছে গাছে দোল খায় পাকা আম লিচু। এর কিছু আগে চলে আসে তরমুজ বাঙ্গি জামরুল।
জ্যৈষ্ঠ মাসে ধীরে ধীরে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে হরেকরকমের রসালো শাঁসালো ফল। যার মন মাতানো সৌরভ থাকে চারদিকে। শুধু ফল-ফলারী নয়, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া লাল বর্ণের ফুল ও কনকচুড়া, হলুদচুড়া এবং মাধবীজবা বলে দিচ্ছে জ্যৈষ্ঠ এসেছে। ফলের সাথে ফুলের সমারোহ প্রকৃতিতে এ এক অন্যরকম সাজ। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও জন্ম নিয়েছেন এ মাসেই।
গ্রীষ্ম মওসুমে যেমন তপ্ত আবহাওয়া, তেমনি প্রশান্তির জন্য আল্লাহ তা আলার পক্ষ থেকে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য নানা রকমের রসালো শাঁসালো ফল-ফলারীর সমারোহ ঘটে। খরতাপে অতিষ্ঠ মানুষের প্রাণ জুড়াতে বৈশাখেই চলে আসে তরমুজ বাঙ্গি বেল জামরুল শসা আর কাঁচা আমের শরবত। সারা বছরের মধ্যে এ মাসেই রসালো আম লিচুর স্বাদ পাওয়া যায়। ফলের রাজা আমও আসে রাজকীয় হালে। কত নামের বাহারি আম তার শেষ নেই। সব মিলিয়ে সাত-আটশ’ জাতের আম রয়েছে।
আজ হতে মধুমাস শুরু হলেও বনেদী আম লিচুর স্বাদ পেতে আরো কিছুদিন রসনা সংযত করতে হবে। এবার আবহাওয়া অনুকূল থাকায় গাছ ভরে মুকুল এলেও পরবর্তীতে আবহাওয়া বদলে যাওয়ায় গুটি ও ফলন ভাল হয়নি। এরমধ্যে প্রচ- তাপদাহ আরো খানিকটা ক্ষতি করেছে। গরমে ঝরে পড়ার কারণে নানা জাতের কাঁচা আম মানুষের রসনা মেটাচ্ছে। আম ডাল কিংবা ছোট মাছের সাথে আমের কুচি জিভে পানি না এনেই পারে না। কাঁচা আম আর বিট লবণ দিয়ে বরফ কুচি মিশিয়ে বানানো শরবতের কথা কি ভোলা যায়। সারা বছর আমের স্বাদ নেবার জন্য কাঁচা আম দিয়ে আচার বানানো শুরু হয়ে গেছে। আচারের জন্য আলাদা ভাবেও বিক্রি হচ্ছে আম। ইতোমধ্যে বাজারে এসেছে ক্ষণিকের অতিথি লিচু। এখন বাজারে যে লিচু সবুজ গোলাপী আভা নিয়ে বিক্রি হচ্ছে টক মিষ্টি স্বাদের স্থানীয় জাতের লিচু। মোটা বিচির এ লিচু বাজারে বিক্রি হচ্ছে প্রতিশ’ আড়াই থেকে তিনশ’ টাকা দরে। বনেদী জাতের রসালো শাঁসালো লিচু খেতে আরো কটাদিন অপেক্ষা করতেই হবে। বোম্বাই চায়না-৩ ও বেদনা জাতের এসব লিচু বাজারে এলে লিচুর বাজার সহনীয় হবে।
আমের আগমনী বার্তায় আমের রাজধানী হয়ে উঠতে শুরু করেছে সরগরম। রাজশাহী অঞ্চলের চার জেলা রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁয় পঞ্চাশ হাজার হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়। এর মধ্যে অর্ধেকই চাঁপাইনবাবগঞ্জের যার আয়তন চব্বিশ হাজার হেক্টরের বেশি। যেখানে আম গাছ রয়েছে প্রায় কুড়ি লাখ। রাজশাহীতে সাড়ে ষোল হাজার হেক্টর, নওগাঁয় নয় হাজার হেক্টর আর নাটোরে চার হাজার হেক্টর। প্রতি বছর আম বাগানের সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে নওগাঁ জেলায়। প্রতি বছর এ অঞ্চলে আমের মওসুমে হাজার কোটি টাকার আম বাণিজ্য হয়। মাস তিনেকের জন্য এখানকার ‘আম অর্থনীতি’ বেশ সচল থাকে। আম চাষ ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট কাজে যুক্ত থাকে আট-দশ লাখ মানুষ। আম গাছের পরিচর্যা। আম পাহারা দেয়া, আমপাড়া, পরিবহন, আড়তদারী, বিক্রি, খাঁচা টুকরী তৈরিসহ নানা কাজে ব্যস্ত থাকে শ্রমজীবীরা। পরিবহনের জন্য ট্রাকের পাশপাশি কুরিয়ার সার্ভিসগুলো বাণিজ্য করে শত কোটি টাকার। আম বাণিজ্য নিয়ে প্রতি বছর মওসুমের এ সময়টা বেশ সরগরম থাকে। কিন্তু গত বছর থেকে আম পাড়ার সময় বেঁধে দেয়া। আম ফরমালিনযুক্ত এসব বিষয় নিয়ে প্রশাসনের তৎপরতায় বেশ হয়রানি ও লোকশানের মুখে পড়ে। সে কারণে এবার আম বাগানের হাত বদল হয়েছে কম। বড় বড় ব্যবসায়ীরা এসেছে কম। গতবার আম পাড়ার সময় বেঁধে দেয়ায় অনেক আম গাছে নষ্ট হয়েছে। এ নিয়ে কৃষি বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে মত-ভেদ আছে। বেশির ভাগের কথা পাকা আম সংগ্রহের ব্যাপারে কখনো সময় বেঁধে দেয়া ঠিক নয়। পরিবেশ তাপমাত্রা আমেরজাত ইত্যাদি কারণে প্রাকৃতিকভাবে একেক সময় একেক আম পাকে। ফলে আম সংগ্রহের সময়ের হেরফের হয় স্বাভাবিক ভাবে। আম চাষীরা ভাল জানেন কখন কোন আম পাকবে। তারা কখনো অসময়ে আম ভাঙে না। যখন যার সময় হয় তাকে পেড়ে বাজারজাত করে। এটাও সত্য এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী বেশি লাভের জন্য আম সংগ্রহের ঠিক সময়ের আগে ক্যালসিয়াম কার্বাইড এ ফরমালিন ব্যবহার করে। যা ভোক্তা ও আম শিল্পের জন্য ক্ষতিকর। এটা বন্ধ করতে দরকার বড় বড় আড়তে প্রশাসনিক নজরদারি। আমপাড়ার সময় বেঁধে দিয়ে আম চাষীদের বেঁধে ফেলা ঠিক নয়। গতবারের শংকার মধ্য দিয়ে আমের রাজধানীতে প্রস্তুতি চলছে আমকে বাজারে স্বাগত জানানোর। ভোজন রসিক আর প্রকৃতি প্রেমীদের স্বাগত জানানোর জন্য লাখ লাখ গাছের কোটি কোটি ঝুলন্ত আম প্রস্তুত। আজ থেকে মধুমাস শুরু হলেও প্রকৃত পক্ষে শাঁসালো রসালো আম লিচুর স্বাদ নিতে দিন পনের সময় লাগবেই। এরমধ্যে ভ্রমণ পিপাসু মানুষ প্রস্তুতি নিতে পারেন সরাসরি আম বাগান আর বাজার দেখার জন্য। গরমকে ভয় নয় জয় করে চলে আসতে পারেন। সারাদেশের হাট-বাজারেতো আম লিচু পাওয়া যায়। কিন্তু হাজার হাজার গাছের সারি। আম বাগানের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তা দিয়ে যেতে দুচোখ যেদিকে যাবে শুধু আম গাছ আর আমের স্বাগতম দুলনি। এমন দৃশ্য কোথায় পাবেন। এ যেন দেখার মজার সাথে খাবার মজাও বটে। বেড়াতে এসে আম বাগানে যদি ঝড়ের মধ্যে পড়েন। তাহলে তো কথাই নেই। ছেলেবেলার সেই কবিতা নিজের অজান্তে গুনগুনিয়ে উঠবেন। ‘আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা মামার বাড়ি যাই। ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়াতে সুখ’........। ভাবছেন এ অঞ্চলে মামা বাড়ি নেই। তাতে কি এখানকার অতিথিপরায়ণ মানুষ আছে না! ভাগ্নের মত ভালোবাসা পাবেন। বাস কিংবা ট্রেনে চেপে সোজা চলে আসবেন মাত্র ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে। আম পাক ধরার কটা দিনের মধ্যে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলতে পারেন। আপনাদের বসরা কিন্তু মোটামুটি প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। আম লিচুর এ মওসুমে শ্বশুররা বেশ ব্যস্ত থাকবেন। যারা অন্য অঞ্চলে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ের সম্মান বলে কথা। বেয়াই বাড়িতে পাঠানো হবে আম লিচুর ঝুড়ি। অন্য ঘনিষ্ঠজনদের জন্য যাবে। হাজার হোক মেয়ের শ্বশুর বলে কথা। মেয়ে জামাইকে নাইয়রে আনা হবে। সব মিলিয়ে কি শহর কি গ্রাম মেতে উঠবে আম উৎসবে। এবার রমজান মাসজুড়ে থাকবে আমের সমারোহ। রোজাদারদের তৃষ্ণা মেটাবে আমের জুস আর পাকা আম। বরাবরের মত আমের মওসুম শুরু হলেই বড় সাহেবদের ম্যাঙ্গোট্যুর শুরু হবে। আম লিচু পছন্দ করে না এমন মানুষ আছে নাকি। হাজার টাকায় যে কাজ হয় না সেই কাজ অনায়াসে হয়ে যেতে পারে এক ঝুড়ি লিচু ও আমে। অচল ফাইল সহজে সচল করার কিংবা বসের সুপ্রসন্ন দৃষ্টিতে পড়ার ভাল উপায় হলো বাজার থেকে এক ঝুড়ি আম লিচু কিনে সাহস করে বসের বাড়ি চলে যান। বলবেন স্যার কিছু মনে করবেন না। আমাদের নিজের গাছের আম লিচু। বাড়ি থেকে পাঠিয়েছে। শুরুতে বস একটু গম্ভীর হয়ে বলবেন এসবের কি দরকার ছিল। কিন্তু মনে মনে খুশি হবেন। আপনিও চলে আসবেন গুড বুকে। বিভিন্ন দপ্তরের ফাইল সচল করতে আম লিচুর জুড়ি নেই। প্রতি বছর ট্রাক বোঝাই করে আম পাঠানো হয় বিভিন্ন দপ্তরে। মন্ত্রী-এমপি নেতা কেউ বাদ যান না। আম লিচুর ঝুড়ি আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়। পাষাণ হৃদয় গলে যায় রসালো শাঁসালো আম লিচুর রসে। একেবারে একশতে একশ’। তাছাড়াও জিয়ারত করতে পারেন হযরত শাহ মখদুম (রহ:)-এর মাজার। শাহ নিয়মত উল্লাহ ও আব্দুল হামিদ দানিস মান্দ-এর মাজার দেখে নেবেন ঐতিহাসিক সোনামসজিদ, বাঘা মসজিদ, কুসম্বা মসজিদ, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন