শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

বাংলা ভাষায় কুরআন চর্চা : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

মু. জাকারিয়া শাহিন | প্রকাশের সময় : ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

এক

পবিত্র কুরআন মানব জাতির ব্যাক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক, ধর্মীয়, জাগতিক, ও পারলৌকিক জীবনের দিক-নির্দেশনার প্রধান উৎস। এ মহাগ্রন্থ আল-কুরআন বৈজ্ঞানিক উপাত্ত সংবলিত একটি সংবিধান। এর বহু আয়াত ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে। একমাত্র গবেষণার মাধ্যমেই এর যথাযথ ব্যাখ্যা সম্ভব। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষী মনীষীরা যুগে যুগে স্বভাষায় কুরআন চর্চা করেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলা ভাষী প্রথিতযশা মুসলিম ও অমুসলিম পণ্ডিতবর্গ এবং কবি সাহিত্যিকরাও বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশে বাংলা ভাষায় পবিত্র কুরআনের অনুবাদ ও তাফসীর চর্চা করে কুরআনী সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা রেখেছেন। কুরআনী সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনের বঙ্গানুবাদ, ভাষ্য, কুরআনের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে স¤পর্কিত গ্রন্থাবলী রচনা ও সাময়িক পত্রে কুরআন চর্চা প্রভৃতি বিষয়ে তাদের অবদান অবিস্মরণীয়।
পবিত্র কুরআনের ভাষান্তর সূচনা:
পবিত্র কুরআন মানব জীবনের পার্থিব ও পরলৌকিক বিষয়সহ সর্ব বিষয়ে সকল প্রকার দিক-নির্দেশনার প্রধান উৎস। সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ (দ.)-র উপর অবতীর্ণ মহাগ্রন্থ আল-কুরআন সর্ব যুগে যুগসমস্যার যুগোপযোগী সর্বশ্রেষ্ঠ সমাধান সম্বলিত একটি অতুলনীয় জীবন বিধান। এ কুরআন হলো তাঁর রিসালাতের চিরন্তন ও চ‚ড়ান্ত সাক্ষী। এতে স্রষ্টার সৃষ্টিকুলের সর্ব বিষয়ের বিবরণ নিহিত রয়েছে। এ কুরআনে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষের পথ-নির্দেশক। পবিত্র কুরআনের ভাষা আরবী। কুরআন নাজিল হওয়ার সময় থেকে অদ্যাবধি এ আরবি কুরআন থেকে মানুষ যেভাবে দিক নির্দেশনা পেয়ে আসছে অনাগত কালের সকল শ্রেণীর মানুষ অনুরূপ দিশা পাবে। কারণ, আল্লাহ স্বয়ং এ পবিত্র কুরআন সংরক্ষণের নিশ্চয়তার বিধান দিয়েছেন। এ কুরআন আরবি ভাষায় নাযিল হলেও এর আবেদন ও আহ্বান সর্বজনীন। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম ও সমগ্র মানবজাতির হিদায়াতের উদ্দেশ্যেই প্রেরিত। ফলে তাঁর উপর যখনই পবিত্র কুরআনের যতটুকু অবতীর্ণ হতো তখনই তা তার আশেপাশের লোকদের হিদায়েতের উদ্দেশ্যে শুনিয়ে দিতেন। কারন, এটা ছিল তাঁর রিসালাতের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। তিনি তার দায়িত্ব পালনে কোন ত্রুটি করেনি। বিভিন্ন গোত্রের প্রতিনিধিগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম এর দরবাওে উপস্থিত হতেন। আর তিনি তাদের প্রত্যেকের ভাষা অনুযায়ী অনুবাদ করেন বুঝাতেন। ফলে তাঁর জীবদ্দশায়ও বিভিন্ন ভাষী মানুষ ভাষান্তরের মাধ্যমে তাদের নিজ ভাষায় কুরআন অনুধাবনে সক্ষম হয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, মক্কায় ইসলাম প্রচারে যখন রাসূল (দ.) তীব্র বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন, তখন সেখানে একজন আজমী (ইরানি) বসবাস করতেন। তিনি ছিলেন দ্বিভাষী। কুরআন শুনা মাত্রই তিনি নিজে বুঝার জন্য অবচেতনে তা ফার্সিতে অনুবাদ করে নিতেন। তিনি কুরআনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
বাংলা ভাষায় পবিত্র কুরআনের পরোক্ষ অনুবাদের ধারা:
তুর্কীবীর ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী ১২০৩ খৃষ্টাব্দে রাজা লক্ষণ সেনকে লখনৌ থেকে বিতাড়িত করে বাংলা জয় করেন। এবং বিজিত অঞ্চলে সংস্কৃত চর্চার মূলে কুঠারাঘাত হেনে বাংলা ভাষা চর্চার পথ উন্মুক্ত করেন। তার এই বিজয়ের পর থেকেই মুসলমানদের সাথে বাংলা ভাষার একটি ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলমানরা বঙ্গ দেশে মসজিদ, খানকা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত করে তাদের ধর্ম কর্ম সম্পাদন করতে থাকেন এবং বাংলা ভাষার মাধ্যমে দেশবাসীর প্রতি ইসলাম ধর্ম প্রচার ও ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থাবলী রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। মধ্যযুগীয় কবি শাহ মুহাম্মদ সগীর এদের অন্যতম। মাতৃভাষায় কুরআনী সাহিত্য চর্চার গুরূত্বটি ষোড়শ শতাব্দীর মধ্য ভাগের কবি সৈয়দ সুলতানের (১৫৫০-১৬৪৮)‘ওফাতে রসুল’ নামক কাব্য গ্রন্থেও প্রতিফলিত হয়েছে।
বাংলা ভাষায় পবিত্র কুরআনের প্রত্যক্ষ বঙ্গানুবাদ ও তাফসীর:
১৭৩৭ খৃস্টাব্দে দিল্লীর শাহ ওয়ালীউল্যাহ ফার্সি ভাষায় কুরআনের অনুবাদ করেন। এর ৬১ বছর পর ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ১৮০৮/১৮০৯ খৃষ্টাব্দে আমপারার একটি প্রত্যক্ষ বঙ্গানুবাদ প্রকাশের সন্ধান পাওয়া যায়। অনুবাদক ছিলেন রংপুরের মটুকপুর নিবাসী আমির উদ্দীন বসুনিয়া। এ খন্ডিত অনুবাদটি ছিল বাংলা পুঁথি সাহিত্যের ভাষায় আমপারার কাব্যানুবাদ। শাহ ওয়ালীউল্যাহ অনুবাদের ১৪৪ বছর পর ব্রাহ্মণধর্মাবলম্বী গিরিশ চন্দ্র সেন (১৮৩৫-১৯১০) কর্তৃক বঙ্গানুবাদিত সম্পূর্ণ কুরআন প্রকাশিত হয় ১৮৮১-১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে। আমির উদ্দীন বসুনিয়ার পর কুরআনের বঙ্গানুবাদে এগিয়ে আসেন কলকাতার পাটওয়ার বাগানের মির্জাপুর মহল্লার অধিবাসী আকবর আলী। বৃটিশ ভারতের অধিবাসী রাজেন্দ্রনাথ মিত্র, গিরিশ চন্দ্র সেন (১৮৩৫-১৯১০), খৃস্টান পাদ্রী তারাচরণ বন্দোপাধ্যায়, টাঙ্গাইলের মাওলানা নঈমুদ্দিন (১৮৩২-১৯০৮), দিনাজপুরের আকবর উদ্দিন, বৃটিশ ভারতের অধিবাসী একজন দেশীয় খৃষ্টান শ্রী ফিলিপ বিশ্বাস, প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। এদের মধ্যে গিরিশ চন্দ্র সেনের বঙ্গানুবাদটি ছিল পূর্ণাঙ্গ আর অন্যদের অনুবাদ ছিল খন্ডিত। গিরিশ চন্দ্র সেনের অনুবাদটি অনেকটা আক্ষরিক পর্যায়ের। এতে টীকা-টিপ্পনী সংযুক্তির ফলে এটাকে অর্থানুবাদ বললেও অত্যুক্তি হবে না। এর ভাষা প্রাঞ্জল। তবে সংস্কৃত শব্দের প্রভাবও কম নয়। প্রাথমিক পর্যায়ের কুরআন হিসেবে বিভিন্ন মুসলিম পন্ডিত ও সাহিত্যিকদের কর্তৃক অনুবাদটি প্রশংসিত হলেও অনুবাদটি ত্রæটি মুক্ত নয়। উদাহরণ স্বরূপ সূরা ইখলাসের ‘আস সামাদ’ শব্দের অনুবাদটি লক্ষণীয়। তিনি শব্দটির অনুবাদ করেছেন ‘নিষ্কাম’ অথচ এর সঠিক অর্থ হবে ‘অমুখাপেক্ষী’। তিনি তার অনূদিত কুরআনের বিভিন্ন স্থানে স্বধর্মের প্রভাব বিস্তারেও প্রয়াসী হন। দৃষ্টান্তস্বরূপ সূরা হুমাযার অনুবাদের একটি টিকা লক্ষণীয়। তিনি বলেন “এই সূরাতে নরক যে বাহিরে নয়, অন্তরে ইহাই পরিব্যক্ত হইয়াছে”। *গিরিশ চন্দ্র সেন (অনুদিত) কোরআন শরীফ (কলকাতা হরফ প্রকাশনী, ১৯৭৯)
আকবর আলীর অনুবাদটি ‘তরজমা আমছে পারা’ নামে বাংলা পুঁথি সাহিত্যের ভাষায় একটি কাব্যানুবাদ। এটি কলকাতা থেকে ১৮৬৮ খৃস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে মাওলানা নঈমুদ্দীন সর্বপ্রথম কুরআনের বঙ্গানুবাদ সহ ভাষ্য রচনা করেন। তাঁর অনূদিত কুরআন হতে ১ম থেকে ৯ম পারা পর্যন্ত তাঁর জীবদ্দশায় (১৮৮৭-১৯০৮)খৃস্টাব্দের মধ্যে প্রকাশিত হয়। অতঃপর তাঁর পুত্রগণও তাঁর অনুসরণ করে ২৩ পারা পর্যন্ত কুরআনের বঙ্গানুবাদ ও ভাষ্য ১৯০৯ খৃস্টাব্দে প্রকাশ করেন। শ্রীফিলিপ বিশ্বাসের অনুবাদটি ছিল খৃস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে প্রণোদিত। অনুবাদটি ১৮৯১ খৃস্টাব্দে প্রকাশিত হলে তৎকালীন জনতার প্রতিবাদের মুখে বৃটিশ সরকার তা বাজেয়াপ্ত করেন।
ঊনিশ শতকে বাঙালি মুসলিম পন্ডিত ও সাহিত্যিকদের ধর্মপ্রচারক ও কুরআনি সাহিত্য চর্চার ফলে মুসলমানদের স্বধর্মীয় স্বাতন্ত্রবোধ উজ্জীবিত হয়েছিল। এ সময় খৃস্টান, আর্য, ব্রাহ্মধর্মের পন্ডিতদের লিখনি দ্বারা স্বধর্ম প্রচারে তৎপরতা লক্ষ করা যায়। তখন এ সময় মুসলিমদের ক্ষুরধারা লিখনীও ইসলামের মহাত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে এবং মুসলিম চেতনা ও সাতন্ত্রবোধ রক্ষায় সক্রিয় ছিল। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেও এ মুসলিম চেতনা ও স্বান্ত্রবোধ অব্যাহত থাকে। বাঙালি মুসলমানদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনধারায় এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এ অখন্ড ভারতে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কুরআনের পূর্ণাঙ্গ বঙ্গানুবাদ ও ভাষ্য চর্চায় যারা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন তাদের মধ্যে মাওলানা মুহাম্মদ আব্বাস আলী (১৮৫৯-১৯২৩), মাওলানা তসলিমুদ্দীন আহমদ (১৮৫২-১৯২৭), আবুল ফজল আবদুল করিম (১৮৭৫-১৯৪৭), মুহাম্মদ আব্দুল হাকীম (১৮৮৭-১৯৫৭),ও মুহাম্মদ আলী হাসান, মাওলানা ওসমান গনি ও ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ (রহ.)। বিংশ শতব্দীর প্রথমার্ধের সর্বশেষে কুরআনের পূর্ণাঙ্গ বঙ্গানুবাদ হলেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ (রহ)। তবে তাঁর অনুবাদ আজও প্রকাশ হয়নি। “মহাবাণী” নামে এর মাত্র ১০ টি সূরার বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৪৬ খৃষ্টাব্দে।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাঙ্গালী মুসলিম পন্ডিত ও কবি সাহিত্যিকদের অনেকেই বাংলা গদ্যে ও কাব্যাকারে কুরআনের খন্ডিত অনুবাদ ও ভাষ্য লিখনে অবদান রেখেছিলেনভ। এঁদেও মধ্যে কয়েকজন অমুসলিম পন্ডিত অনুবাদকও রয়েছেন। বাংলা ভাষায় কুরআনি সাহিত্য চর্চায় এই সব অনুবাদ খন্ডিত অনুবাদ ও প্রকাশিত অনুবাগুলোর নিন্মোক্ত মুসলিম ও অমুসলিম পন্ডিত, কবি-সাহিত্যিক ও তাঁদেও কৃত অনুবাদগুলো উল্লেখযোগ্য।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন