ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। চারদিন আগের অগ্নিকাণ্ডের বিভীষিকা যেন পিছু ছাড়ছে না স্থানীয়দের। অগ্নিকাণ্ডের সময় স্থানীয় অধিবাসীদের অনেকে বাসাবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদের কেউ কেউ ফিরলেও এখনও সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। অগ্নিকাণ্ডে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির পর ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর কাজ শুরু করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। গতকাল দুপুরে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন উপস্থিত থেকে ওয়াহেদ ম্যানশনের বেজমেন্টে থাকা শত শত টন কেমিক্যাল সরানোর মধ্য দিয়ে এই কাজ শুরু করেন।
অন্যদিকে চকবাজারের চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশন দেখতে কাছে-দূরের বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে এসেছেন উৎসুক জনতা। এতে তদন্তকারী সংস্থার কাজে ব্যাঘাত ঘটলেও সাধারণ মানুষ কোনো বাধাই মানছিল না। যে যেভাবে পারছে ঘটনাস্থলে ঢোকার প্রাণপন চেষ্টা করছেন। ফলে, উৎসুক জনতাকে সরাতে রীতিমত হিমশিম খেতে হয় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ, র্যাব ও আনসার সদস্যদের।
গতকাল সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, বিদ্যুতের লাইন নতুন করে বসানোর কাজ করছে ডিপিডিসি’র কর্মকর্তারা। পানি ও গ্যাসের লাইন সংযোগের জন্যও কাজ করতে দেখা গেছে। এছাড়া অগ্নিকান্ডের ঘটনা তদন্তের সাথে জড়িত বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলেন।
সরেজমিনকালে দেখা গেছে, অগ্নিকান্ডের চারদিন পরও দোকান ও গুদামে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন কেমিক্যাল। এর কোনটা থেকে বের হচ্ছে পোড়া গন্ধ আবার কোনো কোনোটা থেকে বের হচ্ছে পারফিউমের গন্ধ। ছড়িয়ে আছে দোকানের মালপত্র, পারফিউমের পোড়া বোতল ও ইলেকট্রিক পণ্য ও দ্রব্যাদি। রাস্তার ওপর পড়ে আছে আগুনে পুড়ে যাওয়া পিকআপভ্যান-প্রাইভেটকার, মোটরবাইক, বাইসাইকেল, ভ্যান, বিভিন্ন রং ও কার্বন রং। কেমিক্যাল অপসারণের পাশাপাশি রাস্তার পোড়া আবর্জনা পানি ছিটিয়ে পরিষ্কার করছেন সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও লালবাগ জোনের পুলিশ সদস্যরা।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রায় ২০ বছর আগে হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন নামের ভবনটি তৈরি করা হয়। ভবনের মূল মালিক হাজী ওয়াহেদের মৃত্যুর পর তার দুই ছেলে হাসান (৫০) ও সোহেল (৪৭) মালিকানা পায়। তবে সোহেল প্রায় সময়ই চট্টগ্রামে থাকতেন এবং হাসান পরিবার নিয়ে ওই ভবনেই থাকতেন। এই দুই ভাই এবং তাদের পরিবার আগুনের হাত থেকে রেহাই পেলেও তারা বর্তমানে কোথায় আছেন তা জানা যায়নি। ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে কেমিক্যালের এই গোডাউনটি ব্যবসায়ী শামীমের ছিল বলে স্থানীয়রা জানান। তবে গোডাউনটির প্রকৃত মালিকের সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
ওয়াহেদ ম্যানশনের বিপরীত ভবনের গার্ড মোঃ হামিদ দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, অগ্নিকান্ডের রাত ৮টার দিকে চলে ভবন মালিকের ছোট ছেলে সোহেল স্ত্রীসহ বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে যান।
তিনি আরো বলেন, বড় ছেলে হাসান এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা। মেয়ে আগেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। ছেলে কলেজে পড়ে। তার নাম রাজ(২০)। ঘটনার সময় তারাও বাইরে ছিলেন। ভবনের চতুর্থ তলায় থাকতেন বাড়ির মালিখের ছেলে।
নন্দ কুমার দত্ত লেনের পাশে হায়দার বখশ লেইনের একটি বাড়ির বাসিন্দা ৫২ বছর বয়সী মো. আনোয়ার হোসেনের চোখে এখনও আটকে আছে ভয়াল সেই রাতের বিভীষিকা। চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের পাশেই তার বাসা। আগুন লাগার পর ভবনের আর সব বাসিন্দাদের সঙ্গে প্রাণ বাঁচাতে তিনিও সপরিবারে ছুটেছিলেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। দৌঁড়াতে গিয়ে আহত হন তার স্ত্রী মুনিরা বেগম।
তিনি বলেন, আমরা এখনো ঘুমাইতে পারি না। ঘুমের মধ্যেও কান্নার আওয়াজ পাই। সকালে এলাকায় আইস্যা দেখি, লাশ আর লাশ। এই দৃশ্য সহ্য করা যায় না।
আগুনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতগ্রস্ত ওয়াহেদ ম্যানশনের তৃতীয় তলার বাসিন্দা মো. রফিকুল ইসলামকে পাওয়া যায় চুড়িহাট্টা মোড়ের এক কোণে। ফ্যালফ্যাল চোখে তিনি তাকিয়ে ছিলেন পোড়া বাসার দিকে। তিনি বলেন, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বের হয়ে আসতে পেরেছি। কীভাবে বের হয়ে গেছি সবাই জানি না।
নন্দ কুমার দত্ত লেইনের বাসিন্দা আশিকউদ্দিন সৈনিক বলেন, ওই ভবনে বেআইনিভাবে মজুদ করা সিলিন্ডারগুলো একবার বের করে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলাম আমরা। পারা যায়নি। বাড়ির পাশে এসব সিলিন্ডার রাখা মানেই যেন বাড়ির পাশে বোমা-বারুদের গোডাউন।
তিনি বলেন, সরকারের কাছে আমাদের আকুল-আবেদন এসব কেমিক্যালের গোডাউন যেন আবাসিক এলাকা থেকে সরিয়ে অন্যত্র নেয়া হয়। আমাদের জীবনের মূল্যের কথা যেন সরকার একবার চিন্তা করে।
তবে কেমিক্যাল ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেনসহ বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, পুরান ঢাকার অধিকাংশ এলাকায় নিয়মিত যানজট লেগে থাকে। চুড়িহাট্টার আগুনের ভয়াবহতার জন্য এ যানজট দায়ী। এই এলাকায় আমাদের পূর্বপুরুষরা বছরের পর বছর ধরে ব্যবসা করে আসছেন। এখন আমরা ব্যবসা করছি। কেউ যদি বলে কোনো গোডাউন বা কেমিক্যালের কারণে আগুন লেগেছে, এটা সস্পূর্ণ ভুল হবে। এই আগুন কোনো কেমিক্যাল থেকে লাগেনি। সিলিন্ডার থেকে লেগেছে, সরকারকে গাড়ির সেসব সিলিন্ডার নিয়ে ভাবতে হবে।
ধানমন্ডি থেকে স্বামীর সঙ্গে বাড়িটি দেখতে এসেছিলেন নাইমা জাহান। তিনি বলেন, টিভিতে এ মর্মান্তিক ঘটনার খবর পাওয়ার পর থেকেই খুব খারাপ লাগছে। তাই স্বামীকে বললাম চল একটু জায়গাটা দেখে আসি। আর যাই হউক অন্তত নিজ চোখে যেন দেখে আসতে পারি, কেমন সে জায়গা, যেখানে এত বড় মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল। কেমিক্যালের গোডাউন সরানোর পাশাপাশি জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ফ্যামিলি বাসা ভাড়ার তুলনায় গোডাউন ভাড়া দিলে টাকা বেশি পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন চকবাজারের একই লেনের বাসিন্দা ফরিদ উদ্দিন ফারুক বলেন, একটি বাসায় ফ্যামিলি ভাড়া দিলে প্রতিমাসে ভাড়া হয়তো পাওয়া যায় ২০ থেকে ২৫ হাজার। অগ্রিম সর্বোচ্চ পঞ্চাশ হাজার টাকা। কিন্তু কেমিক্যালের গোডাউন ভাড়া দিলে পাওয়া যাবে পঞ্চাশ হাজার, অগ্রিম পাওয়া যাবে দুই লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা। তাহলে কেন বাড়ির মালিকরা গোডাউন ভাড়া দেবে না?’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন