শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

দখলে দূষণে বুড়িগঙ্গা

প্রকাশের সময় : ২৮ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৩৭ পিএম, ২৭ জানুয়ারি, ২০১৬

নূরুল ইসলাম : বুড়িগঙ্গা দখল চলছেই। বুড়িগঙ্গার জমি দখল করে প্রতিদিনই গড়ে উঠছে নতুন স্থাপনা। সাথে দূষণতো আছেই। নদ-নদী, খাল-বিল উদ্ধারে সরকারে ঘোষণা এবং হাইকোর্টের নির্দেশনা কোনো কিছুই আমলে নিচ্ছে না অবৈধ দখলদাররা। আগের মতোই পেশিশক্তির জোরে বিভিন্ন এলাকায় নদীর তীর দখল করে রেখেছে তারা। অভিযোগ রয়েছে, দখলদারিত্বের সাথে বিআইডব্লিউটিএ’র কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা জড়িত। একদিকে উচ্ছেদ হলে আরেক দিকে আবার নতুন করে অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠছে। বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আবু নাসের খান এটাকে ‘উচ্ছেদ উচ্ছেদ খেলা’ আখ্যায়িত করে বলেন, আগে সোয়ারীঘাটের দিকে দখলদারিত্ব বেশি দেখা গেলেও এখন শহরের বাহিরে নদীর তীরঘেঁষে দখলদারিত্ব চলছে। তিনি বলেন, নদীর সীমানা পিলার বসানোতে ত্রুটি থাকায় শুধু বুড়িগঙ্গা নয়, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা সবই নদীকে ঘিরেই দখলের মহোৎসব চলছে। বিআইডব্লিউটিএ’র বন্দর পরিচালক শফিকুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, উচ্ছেদকৃত জায়গায় স্থাপনা গড়ার সুযোগ আর দেয়া হবে না। নদীর জায়গা-জমি উদ্ধারের পর সেখানে ওয়াকওয়ে, পার্কিং ইয়ার্ড এবং বাগান তৈরী করা হবে। কাউকে আর দখলদারিত্বের সুযোগ দেয়া হবে না। অন্যদিকে, রাজধানীর দেড় কোটি মানুষের মলমূত্রসহ বিভিন্ন কলকারখানা এবং গৃহস্থালীর ১০ হাজার ঘন মিটারের বেশী বর্জ্য প্রতিদিন বুড়িগঙ্গায় নিক্ষিপ্ত হচ্ছে, যার ৪০ শতাংশই অপরিশোধিত। এতে করে বুড়িগঙ্গায় দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই দূষণে ঢাকার বাসিন্দারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
ঢাকার পশ্চিমের বুড়িগঙ্গা শাখা নদীর বুকে বালু দিয়ে ভরাট করে দখলের মহোৎসব অতি পুরনো বিষয়। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার পরেও ঢাকার খোলা জানালা হিসেবে পরিচিত বুড়িগঙ্গা নদীর শাখা-প্রশাখার দুই তীর দখলে মেতে উঠেছে চিহ্নিত প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা। দখলের কারণে বুড়িগঙ্গা ঢাকার মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, দীর্ঘ দুই যুগ ধরে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, লালবাগ, হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচর এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গার শাখা নদীর প্রায় ২৪ হাজার ৫০০ কাঠা (৩৫০ একর) দখল করে নিয়েছে ভূমিদস্যুরা। যার অনুমানিক মূল্য ৪৯০ কোটি টাকা। এ ছাড়া সদরঘাটের আশপাশের দুই পাড়েই গড়ে উঠেছিল শতাধিক স্থাপনা। বিআইডব্লিউটিএ’র বন্দর পরিচালক শফিকুল হক জানান, গত সপ্তাহে সদরঘাট, সোয়ারীঘাট, বাদামতলী, ওয়াইজঘাটসহ আশপাশের এলাকার শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। উচ্ছেদকৃত জায়গায় প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সেখানে ওয়াকওয়ে ও বাগান তৈরী করা হবে। এছাড়া থাকবে পার্কিং ইয়ার্ড। বন্দর পরিচালক বলেন, কোনোভাবেই আর উচ্ছেদকৃত স্থানে কাউকে দখল করতে দেয়া হবে না। যদিও এরই মধ্যে পুরান ঢাকার বাদামতলী ও সোয়ারীঘাটে উচ্ছেদকৃত স্থানে কয়েকটি স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে বলে জানা গেছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, উচ্ছেদের পরদিন থেকে বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মচারীদের ম্যানেজ করে কতিপয় ব্যবসায়ী দোকান বসিয়ে ব্যবসা করছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এলে তাদেরকে সরিয়ে দেয়া হয়।
সরেজমিনে শ্যামপুর এলাকায় বুড়িগঙ্গার পাড় ঘুরে দেখা গেছে, নদীর বুক বালু দিয়ে ভরাট করে রাতারাতি দখল করে নিচ্ছে চিহ্নিত ভূমিদস্যুরা। নদীর জায়গা ছেড়ে ৩০/৪০ ফুট দুরে বালুমহাল তৈরী করার নিয়ম থাকলেও বালু ব্যবসায়ীরা তা মানছে না। বরং নদীর সীমানা পিলারের ভিতরে প্রবেশ করে অবাধে ব্যবসা করছে তারা। পোস্তগোলা প্রথম বুড়িগঙ্গা সেতুসংলগ্ন এলাকায় সবচেয়ে বড় দখলদার ইব্রাহিম খলিল রিপন। বুড়িগঙ্গার শ্মশানঘাট এলাকার পুরোটাই তার দখলে। নদীতে ড্রেজার লাগিয়ে সমানে বালু উত্তোলনের পাশাপাশি নদী ভরাটের কাজটি করছেন এই দখলদার। শ্যামপুর ঢাকা ম্যাচ ফ্যাক্টরীর উল্টোদিকের ঘাট দখল করে বালুমহাল তৈরী করেছেন সিরাজুল ইসলাম সেন্টু নামে এক দখলদার। নারায়ণগঞ্জের সাবেক এমপি কবরীর এপিএস বলে খ্যাত সিরাজুল ইসলাম সেন্টু দুই বছর আগে ওই ঘাট দখল করতে গেলে সোলেমান নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি বাধা দেয়। পরে রাতে সেন্টুর লোকজন সোলেমানের বাড়িতে গিয়ে তাকে গুলী করে। ঘরের আসবাবপত্র ভাঙচুর। সাবেক এমপির হস্তক্ষেপে সে ঘটনা আর বেশি দূর গড়ায়নি। তবে গুলীর ঘটনার পর সেন্টুর ঘাট দখলে আর কেউ বাধা দেয়ার সাহস করেনি। শ্যামপুর ইকোপার্কের সাথেই সীমানা পিলারের ভিতরেই রয়েছে চার তলা বাড়ি। স্থানীয়রা জানান, বাড়ির মালিক নজরুল ইসলাম এখানে থাকেন না। বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানায়, এই এলাকায় যখন সীমানা পিলার স্থাপন করা হয় তখন ওই বাড়ির মালিকের পক্ষ থেকে কয়েক দিন সময় চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে তিনি আর সেই বাড়ি ভাঙ্গেননি। বরং বিআইডব্লিউটিএ’র দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কোনোভাবে ম্যানেজ করে রেখেছেন। নেই থেকে সীমানা পিলারের ভিতরেই রয়ে গেছে চারতলা বাড়িটি। পাগলা এলাকায় সাবেক এমপি সালাহউদ্দিনও বুড়িগঙ্গা নদীতে ‘সুইমিং পুল’ নির্মাণ করে দখলে রেখেছেন বলে স্থানীয়রা জানান। তাঁর এক ভাইও একইভাবে নদীর উপর স্থাপনা করে রেখেছেন বলে জানা গেছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএ’র বন্দর পরিচালক বলেন, উন্নয়নের জন্য বালু লাগে। সে কারণে আমরা বালু ব্যবসায়ীদের বিপক্ষে নই। আমরা চাই নদীর জায়গা থেকে কমপক্ষে ৩০/৪০ ফুট দূরে বালু মহাল তৈরী করে মানুষ ব্যবসা করুক। তাতে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সরকারও যাতে রাজস্ব পায় সে ব্যবস্থা করা হবে। তবে এখন যারা আছে, তাদের মধ্যে অনেকেই অবৈধ। শিগগিরি তাদেরকে উচ্ছেদ করা হবে জানিয়ে শফিকুল ইসলাম বলেন, দখলদার কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।
একই চিত্র নদীর দক্ষিণপাড়ে কেরানীগঞ্জের আঁটি ও খোলামোড়া থেকে শুরু করে জিনজিরা, কালিগঞ্জ, মাদারীপুর, লসমনগঞ্জ, বরিশুর, মান্দাইল, আগানগর, পার গেন্ডারিয়া, মিরেরবাগ ও হাসনাবাদ এলাকার। এসব এলাকাতেও গড়ে তোলা হয়েছে বহুসংখ্যক টংঘরসহ চার শতাধিক কাঁচাপাকা স্থাপনা। অনুসন্ধানকালে অভিযোগ পাওয়া গেছে, পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিএ’র একশ্রেণীর কর্মকর্তা ও কর্মচারী এসব অবৈধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত আর্থিক সুবিধা নিয়ে থাকেন। প্রতিটি টংঘর থেকে মাসে দুইশ’ টাকা থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা এবং অন্যান্য স্থাপনা থেকে আয়তন ও স্থানের গুরুত্ব ভেদে পাঁচশ’ টাকা থেকে সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়ে থাকে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ব্যবসায়ীরা ভলগেটের মাধ্যমে বালি এনে তা নদীর তীরে ফেলছে। দীর্ঘমেয়াদি এই প্রক্রিয়ায় নদীর পাড় ভেঙে তা নদীগর্ভে পড়ছে। ভরাট হচ্ছে নদী। এই ভরাটকৃত স্থানসহ নদীর যেসব স্থানে পানির গভীরতা ও প্রবাহ কম সেসব স্থানে আয়তাকারে বাঁশ, খুঁটির বেড়া দিয়ে ঘিরে চৌহদ্দির মধ্যে ভাঙা ইট, বালির বস্তা ও মাটি ফেলে ভরাট করা হচ্ছে। আর এভাবে ভরাটকৃত স্থান দখল করে নতুন নতুন অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলো হচ্ছে।
দূষণে বুড়িগঙ্গা
রাজধানী থেকে নির্গত বর্জ্যরে কারণে দূষিত হচ্ছে বুড়িগঙ্গার পানি। নদীর নাব্যতা কমে গেছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অবহেলা আর গাফিলতির কারণে বুড়িগঙ্গা নদীতে দখল দূষণ অব্যাহত থাকায় পরিবেশ ক্রমেই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। জানা গেছে, ঢাকা শহরের গৃহস্থালী ও বিভিন্ন কল-কারখানার উৎপাদিত ৭ হাজার টনের বেশি বর্জ্যের ৬৩ শতাংশ অপরিশোধিত কঠিন বর্জ্য বিভিন্ন খাল ও ড্রেন দিয়ে প্রতিদিন বুড়িগঙ্গায় পড়ছে। সদরঘাট থেকে দেশের ৪৯ টি নৌ-রুটে চলাচলকারী প্রায় ৪ শতাধিক নৌযান বুড়িগঙ্গা নদীতে বছরে ১ দশমিক ৭০ থেকে ২ দশমিক ৪০ বিলিয়ন টন বর্জ্য ফেলায় টনকে টন রাসায়নিক পদার্থ পলি হিসেবে নদীর তলদেশে জমা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বুড়িগঙ্গার তলদেশে প্রায় ৭ ফুট পলিথিনের স্তর জমে গেছে। নদী দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী নদীর সঙ্গে যুক্ত ৩৬৫টি টেক্সটাইল মিল, ১৯৮টি চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ ট্যানারী, ১৪৯টি ওষুধ প্রস্তুতকারক কারখানা, ১২৯টি ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, ১১৮টি রাসায়নিক ও কীটনাশক দ্রব্য প্রস্তুতকারক কারখানা, ৯২টি পাটকল, ৬৩টি রাবার ও প্লাস্টিক কারখানা, ৩৮টি খাদ্য ও চিনিজাত দ্রব্য প্রস্তুতকারক কারখানা, ১০টি পেপার এন্ড পাল্প ফ্যাক্টরী, ৫টি সিমেন্ট কারখানা, ৫টি সার কারখানা ও ৪টি ডিস্টিলারী কারখানা। নদী দূষণে এদের সাথে যুক্ত হয়েছে কামরাঙ্গীরচরের ৩৮০টি ডায়িং ফ্যাক্টরীসহ সহস্রাধিক প্লাস্টিক ও পলিথিনের কারখানা। ১৯৯৭ সালের প্রণীত পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে বলা হয়েছে, প্রত্যেক শিল্প কারখানার জন্য ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লাট বাধ্যতামূলক। পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়া কোন কারখানায় বিদ্যুৎ এবং গ্যাস সংযোগ দেয়া যাবে না কিন্তু খোদ সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানী বিভাগ এ আইন মানছে না। পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়াই কামরাঙ্গীরচরের শত শত কারখানায় বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ দিয়েছে।
বিভিন্ন রাসায়নিক পরীক্ষায় দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গার পানিতে প্রায় ১০ গুণ বেশি বিওডি থাকায় জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। এ পানি আদৌ সেবন ও ব্যবহার যোগ্য নয়। নদীর পানিতে প্রতি লিটারে ৪ মিলিগ্রামের বেশি অক্সিজেন থাকার কথা কিন্তু তাও নেই। এছাড়া বুড়িগঙ্গায় মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক সিসার পরিমাণও আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আবু নাসের খান এ প্রসঙ্গে বলেন, বহু চেষ্টা করেও বুড়িগঙ্গার দূষণ কমানো যায়নি। বুড়িগঙ্গার পাড় ঘেঁষে অবস্থিত মিল-কারখানাগুলোতে ইটিপি স্থাপন করা গেলে দূষণ কিছুটা কমানো যেতো। কিন্তু তাও হচ্ছে কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারনে। এজন্য সরকারকে আরও সিরিয়াস হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তা না হলে এই দূষণই একদিন ঢাকাবাসীর জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন