শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

কৃষিনির্ভর দিনাজপুরে অর্থনৈতিক সঙ্কট

প্রকাশের সময় : ১৭ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মাহফুজুল হক আনার, দিনাজপুর থেকে : নাই, শুধু নাই-নাই। গ্রাম কি শহর সবখানে শুধু ‘নাই’। কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ীÑসবার মুখে শুধু ‘নাই’। ধানের দাম নেই, কাজ আছে ন্যূনতম মজুরী নেই, চরম মন্দাভাবের কারণে ব্যবসায়ীদের হাতে টাকা নেই। উন্নয়নমূলক কাজ আছে, বিল নেই। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দিনাজপুর-রংপুর অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তি নেই। টাকার জন্য মানুষের মধ্যে একরকম হাহাকার অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর ওপর মরার ওপর খাঁড়ার ঘা-এর মত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির ঋণের বোঝা। অসচ্ছল মানুষদের সচ্ছল করার নামে স্বেচ্ছাসেবামূলক সংগঠনগুলোর সাপ্তাহিক আর মাসিক কিস্তি পরিশোধের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে দিনান্তে খেটে খাওয়া মানুষ। অথচ ইরি-বোরো ধান কাটা-মারার এই মৌসুমে কৃষিনির্ভর এসব অঞ্চল উৎসব মুখর হয়ে থাকার কথা। কিন্তু এসবের কিছুই নেই। আছে শুধু হাহাকার। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলি কেবল ব্যবসায়িক মনোভাব অর্থনৈচিক উন্নয়নের আরো একটি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জেলায় শাখা স্থাপনের যে সকল শর্ত রয়েছে তার একাংশ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। শিল্প স্থাপনে অর্থ লগ্নির ক্ষেত্রে বেসরকারী ব্যাংকগুলির হার প্রায় শূন্য বলা চলে। সিসি নামক কোটি কোটি টাকার ব্যাংক ঋণের অর্ধেক টাকাই ব্যবহার হচ্ছে দাদন ব্যবসায়। এর শিকার হচ্ছে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা। সাধারণ ব্যবসায়ী ও সরবরাহকারীর ট্রেড লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ী গোডাউন দেখিয়ে প্রয়োজনীয় সম্পত্তি বন্দক দিয়ে ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা সিসি নামক ঋণ ব্যবহার করছে। লেনদেন ঠিক থাকলেও খোঁজ নিলে দেখা যাবে ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের পুরো টাকাই ব্যবহার করা হচ্ছে উচ্চ সুদে প্রান্তিক ব্যবসায়ী ও কৃষকদের মাঝে। সমাজের সচেতন মানুষদের মতে এই অবস্থার পরিবর্তন করা সম্ভব না হলে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে।
দিনাজপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এবং বিভিন্ন স্তরে কথা বলে অর্থনৈতিক সংকটের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। কৃষিনির্ভর হওয়ায় পর্যালোচনা করা যাক একজন কৃষকের অবস্থা। কেননা বছরের অর্থকরী ফসল হিসাবে বিবেচিত ইরি-বোরো ধান কাটা-মাড়া শুরু হয়েছে। বাজারে নিয়ে আসছে কৃষকেরা অনেক আশা নিয়ে। ধান বিক্রি করে স্ত্রী-সন্তানদের জন্য নুতন জামা-কাপড় আর মাছ মাংস নিয়ে যাবে। কিন্তু আশায় গুড়ে বালি। ধান বিক্রি করে সার-বীজ আর কীটনাশকের নাশকের পাওনা টাকা পরিশোধ করার পর দু’কেজি চাল কেনার টাকাও বাঁচে না। আলাপ হলো জেলার বৃহৎ ধানের বাজার আমবাড়ী বাজারে সামসুদ্দিন নামের এক কৃষকের সাথে। তার বাড়ী মোস্তফাফুর ইউনিয়নের বলে সে জানালো। বাজারে এসেছে ধান বিক্রি করতে। তার নিজের সাত বিঘা জমি আছে। বিত্তশালী না হলেও তিন ফসলি এই সাত বিঘা জমি আবাদ করে সে তিন সন্তানের পড়ালেখার খরচ জুগিয়ে মোটামুটি সচ্ছলভাবেই চলছিল। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে কিছুই যে থাকছে না। আগে যা ধান হতো এখন ২৫ থেকে ৩০ মণ ধান বেশী পাচ্ছি। তারপরও ছেলেমেয়ের পড়াশোনার যোগাতে পারছি না। কেন এমন অবস্থা জানতে চাইলে গ্রামের সহজ-সরল এই মানুষটির ভাষায় বরকত নেই। খুলে বলতে বললে সে জানালো আগে ধান কম পাইলেও খরচার তুলনায় দাম ভাল পাইতাম। এখন ধান বেশী পাইলেও খরচার তুলনায় দাম নেই। তার মতে এক বিঘা জমিতে ইরি-বোরো আবাদ করতে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা খরচা হয়ে থাকে। এক বিঘা জমিতে ধান পাওয়া যায় ২৫ থেকে ৩০ মনের মত। ৯০০ টাকা বস্তায় ধান বিক্রি করে পাওয়া যায় ১১ থেকে ১২ হাজার টাকা। একই অবস্থা ভুট্টা আবাদের ক্ষেত্রেও। উৎপাদন খরচ উঠছে না ভুট্টা বিক্রি করে।
আলাপ হলো একজন সাধারন তৈরী পোষাক বিক্রেতার সাথে। জেলরোডস্থ জেলখানা রেইনবো সুপার মার্কেটের এক ব্যবসায়ী নাম না বলার শর্তে জানালো, ইরি-বোরো এই মৌসুমে সকাল সকাল দোকানে আসতাম। কারণ গ্রামের লোকজন আসবে বাজার করতে। ধান বিক্রির টাকায় পরিবারের জন্য বাজার করতে আসা গ্রামের মানুষদের দেখা নেই। দোকানের যে বিক্রি তাতে ভাড়ার টাকা না দিতে পেরে জামানত হারানো ছাড়া কোন উপায় নেই।
আলাপ হলো দিনাজপুরের উঠতি এক ঠিকাদারের সাথেও তাররমরমা অবস্থা। কোটি টাকার সরকারী টেন্ডার পেয়েছে এবারও। শিক্ষা প্রকৌশল আর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের এই ঠিকাদার জানালো, স্ত্রী-সন্তান ছাড়া বাড়িঘর যতটুকু আছে সবকিছুই ব্যাংকে বন্ধক আছে। রড-সিমেন্ট ব্যবসায়ীরা পাবে কয়েক লক্ষ টাকা। বিল পেলে সব পরিশোধ করবো এই কথা বলছি ব্যাংক, পাওনাদারদের। স্ত্রী-সন্তানদের বলছি এবারের বিল পেলেই তোমাদের বায়না পূরণ করবো। কাজ শেষে অর্থ বছরের শুরুতে বরাদ্দকৃত টাকা পাওনাদার ঠিকাদারদের মাঝে পাওনার রেসিও মোতাবেক বরাদ্দ করা হচ্ছে। দেখা যায় পাওনা টাকার ২৫ শতাংশ টাকাও ভাগে জোটে না। ফলে নেই-এর আর শেষ হচ্ছে না। সহ নিজ পরিবারের সদস্যদের।
আসা যাক খেটে খাওয়া শ্রমিকদের কথায়। ইরি-বোরো মৌসুমে মজুর পাওয়া মুশকিল। পেলেও দিন হাজিরা ৪শ থেকে ৫শ টাকা। তাহলে অভাব কথায়। আসলে ইরি-বোরো মওসুমে ১৫ থেকে এক মাস কাজ থাকে। এছাড়া বছরের ১১ মাস ১৫০ থেকে ১৭০ টাকায় শ্রম দিতে হয় মজুরদের। তাদের মতে পূরো বছর ধার দেনা করে এক বেলা খেয়ে না খেয়ে বাঁচতে হয়। শ্রমিকদের সিংহভাগই বিভিন্ন এনজিও থেকে চড়া সুদে দিন কিস্তিতে ঋণ নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে। ঋণ প্রদানকারী এনজিও কর্মীরা কাবুলীওয়ালার মত মাঠেই শ্রমিকদের কাছ থেকে কিস্তি আদায় করে থাকে। অপরদিকে বানিজ্যিক ব্যাংকগুলিও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির মত ঋণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। হিসাবে লেনদেন সন্তোষজনক আর মডগেজ রেখে কোটি কোটি টাকার ঋণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কেবলমাত্র দিনাজপুরের বিরল উপজেলায় দেয়া সিসি ঋনের কয়েকজন গ্রহিতার প্রকৃত ব্যবসার ধরন সম্পর্কিত তথ্য যাচাই বাচাই করলেই সামাজিক তথা জাতীয় উন্নয়নে ব্যাংকের উদ্দেশ্য কার্যকর হচ্ছে না তার প্রমান মিলবে। যার অধিকাংশই স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, সাউথ ইষ্ট ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক জাতীয় উন্নয়নের পরিবর্তে পুরোপুরী ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে অনেক ব্যবসায়ী মন্তব্য করেছেন।
চলছে মৌসুমী ফল লিচুর রমরমা মৌসুম। এখানেও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এবং আড়তদারদের কারসাজীতে প্রান্তিক কৃষক ও ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। খোজ নিয়ে জানা গেছে, লিচু আবাদে বিষ, ভিটামিন প্রয়োগের বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। উপজেলা বা জেলা পর্যায়ে অঅনুমোদিত বিষ বা ভিটামিন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয় না। কৃষক ও বাগান গ্রহনকারী ব্যবসায়ীরা অধিক ফলন ও মোটাতাজাকরণের জন্য মানবদেহের লাভ ক্ষতির কোন তোয়াক্কা না করে বিষ ও ভিটামিন প্রয়োগ করে যাচ্ছে এখনও। যদিও তাদের মতে বিষ বা ভিটামিন প্রয়োগের ৮ থেকে ১০ পর এসকল বিষ বা ভিটামিনের কোন অ্যাকশন থাকে না। বিষ ও ভিটামিন প্রয়োগকারী কৃষক ব্যবসায়ীদের অভিযোগ অন্য জায়গায়। তাদের আবাদ অবস্থায় ভিটামিন বা বিষ প্রয়োগের ক্ষেতে সরকারের কোন বিভাগ থেকে তদারকি থাকে না। যখন বাজারে লিচু উঠে তখন শুরু হয় ফরমালিন যুদ্ধ। তাদের মতে ফরমালিন কি জিনিস প্রান্তিক চাষি বা স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানেন না এবং চেনেন না। তবে একটি বিষয়টি তারা নিশ্চিত ঢাকা চিটাগাংয়ের বড় বড় আড়তদাররা প্রান্তিক কৃষক ও ব্যবসায়ীদের বিপদে ফেলে অধিক ফায়দা হাসিলের জন্য এসকল কারসাজি করে থাকেন। এক্ষেত্রে প্রশাসনের একটি পক্ষের যোগসাজস থাকার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায়না। কেননা দিনাজপুর থেকে যখন লিচু ঝুড়িজাত করা হয় তখন ফরমালিন পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হলে প্রান্তিক ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
সবকিছু মূল্যায়ন করে একটি বিষয় নিশ্চিতভাবে বলা যায় সরকার তথা প্রশাসন যদি সাধারন মানুষের কল্যাণে কিছু করতে চায় তাহলে হতাশা বা নেই নামক শব্দটি মুছে ফেলা যাবে অনায়াসে। এক্ষেত্রে দরকার যথাযথ আইনের প্রয়োগ এবং মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনিক কঠোর নজরদারী।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন