মোবায়েদুর রহমান : বাংলাদেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো লক্ষ্য করুন আর না করুন, গত মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে, বিশেষ করে চলতি মাসের প্রথম থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে। পরিবর্তনের এই ধারায় এতদিন ধরে দোদুল্যমান আমেরিকা জঙ্গিবাদকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেছে। অন্যদিকে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে এক ধরনের আশা-নিরাশার দোলাচল সৃষ্টি হয়। কংগ্রেস সরকার আওয়ামী লীগ সরকারকে যেরূপ অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে গেছে, আওয়ামী সরকারের প্রতি মোদি সরকারের সেই সমর্থন কি অব্যাহত থাকবে? অনেকে ধারণা করেছিলেন যে, বাংলাদেশের বিভাজিত রাজনীতিতে বিজেপি সরকার কোনো পক্ষই নেবে না। তারা মোটামুটি নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করবে। বিএনপি ভারতীয় রাজনীতির মাত্রাতিরিক্ত সরলীকরণ করেছিল। বিএনপি ভেবেছিল যে, যেহেতু কংগ্রেস সব সময় আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে এসেছে তাই রাজনীতির সহজ সমীকরণ অনুযায়ী বিজেপি সরকার বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ বিরোধী জোট বা দলকে সমর্থন করবে। না করলে নিদেনপক্ষে তারা বাংলাদেশের দুই জোট অথবা বড় দুই দলের মধ্যে সমর্থনের ব্যাপারে নিরপেক্ষতা অথবা ভারসাম্য বজায় রাখবেন।
আমেরিকা ও ভারত এবার প্রকাশ্যে এসেছে
মোদি সরকার দিল্লির ক্ষমতায় আসার
আমেরিকার অবস্থান পরিবর্তন
পরপরই বিএনপি খুব ফুরফুরে মেজাজে ছিল। কিন্তু যারা রিয়াল পলিটিক্যাল এলিমেন্ট তারা বিএনপির অনুক্ত উল্লাসকে রাজনীতির অপরিপক্বতা বলে মনে করছিলেন। কারণ তারা দেখছিলেন যে, মোদি সরকারের আমলেও বাংলাদেশের বর্তমান সরকার যখন ভারতের কাছ থেকে কিছু না পেয়েও ভারতকে দেয়ার ব্যাপারে ছিল উদার ও মুক্তহস্ত সেই সরকারকে সমর্থন না দিয়ে ভারত অনিশ্চিতের পথে যাত্রা করবে কেন? তাদের এই ধারণা অবশেষে সত্য বলে প্রতিভাত হয়েছে। জঙ্গিবাদ দমনের নাম করে আমেরিকা এতদিন ধরে তার ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’ নীতি পরিত্যাগ করে আওয়ামী সরকারের জঙ্গিবাদ দমন নীতিকে বলিষ্ঠ সমর্থন দিয়েছে। আর ভারত অস্পষ্টতার চাদর সরিয়ে বর্তমান সরকারকে প্রকাশ্যে এবং সরবে সমর্থন দিয়েছে। তারই প্রকাশ ঘটেছে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুব্রামনিয়াম জয় শঙ্করের সদ্য সমাপ্ত ২৫ ঘণ্টাব্যাপী বাংলাদেশ সফরের সময়। সফর শেষ করার আগে তিনি বাংলাদেশের বিশেষ ঘরানার কয়েকজন বাছাই করা বুদ্ধিজীবীর সাথে একটি অভিজাত হোটেলে মতবিনিময় সভায় মিলিত হন। সেই সভায় তিনি স্পষ্ট ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন নীতির প্রতি নরেন্দ্র মোদি সরকারের বলিষ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপনের জন্যই তিনি ঢাকা এসেছিলেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার নিয়ে যখন পাশ্চাত্যের কয়েকটি দেশ এবং কয়েকটি মুসলিম দেশ প্রশ্ন রাখছে তখন ভারত থেকে ঘোষণা করা হয়েছে যে, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সব বিচারকে ভারত সমর্থন করে।
নিশা দেশাই ও ভারতীয়
রাষ্ট্রদূতের বৈঠক
এর আগে চলতি মাসের ৪ ও ৫ তারিখে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল ঢাকা সফর করেন। ঢাকা সফরকালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের গ্ররুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠক করেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই যে, ঢাকা অবস্থানকালে তিনি বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার সাথে গত ৪ মে বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠকে উভয় রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনার এই মর্মে একমত হন যে, আমেরিকা ও ভারত কেউই বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হোক, সেটা চায় না। দেশী ও বিদেশী পত্রিকায় এই বৈঠক সম্পর্কে একটি চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশিত হয়। বৈঠকে ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন নিশা দেশাইকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানান যে, নিরাপত্তার কারণে হোক বা অন্য যেকোনো কারণে হোক, ভারত চায় না যে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হোক। এর জবাবে নিশা দেশাই হর্ষ বর্ধনকে স্পষ্ট জানান যে, ওয়াশিংটন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ইতোমধ্যেই পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেছে। শান্তি এবং স্থিতিশীলতার স্বার্থে ওয়াশিংটন বাংলাদেশ সরকারের সাথে একযোগে কাজ করতে চায়। হর্ষ বর্ধন মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে জানান যে, বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা যদি বিনষ্ট হয় তাহলে তার প্রভাব ভারতের ওপরও পড়বে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, The Indian High Commissioner told Nisa Desai that India is “very much” with the present government in Bangladesh and would continue its support. In response, Biswal said the US too wanted a stable and secure Bangladesh. অর্থাৎ, ‘ভারত সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সাথে আছে এবং তারা এই সরকারকে সমর্থন করে যাবে। উত্তরে মার্কিন মন্ত্রী বিসওয়াল বলেন যে, আমেরিকাও একটি নিরাপদ ও স্থিতিশীল বাংলাদেশ চায়।’
মতদ্বৈধতার মাঝেও ঐক্য
একথা ঠিক যে, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উৎপত্তি নিয়ে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে কিছুটা তফাৎ রয়েছে। ভারত মনে করে যে, যারা বাংলাদেশে সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলা করছে তারা বাংলাদেশী। কিন্তু আমেরিকা মনে করে, তারা বাংলাদেশী হোক আর যাই হোক, ইসলামিক স্টেট বা আইএসের সাথে তারা সংশ্লিষ্ট। এই পটভূমিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিবের সাথে বৈঠক করে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া বার্নিকাট বলেছেন, আমাদের তিনটি সরকার অর্থাৎ বাংলাদেশ, ভারত ও আমেরিকা সবাই চরমপন্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছি। এ ব্যাপারে আমরা সবাই একই সমতলে অবস্থান করছি।
বিএনপিকে উপেক্ষা করা হচ্ছে
এই পটভূমিতে বিএনপির প্রতি আমেরিকা ও ভারতের আচরণ দেশ দু’টির অবস্থান পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। নিশা দেশাই ঢাকা সফরকালে অনেকের সাথেই বৈঠক করেছেন। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করেননি। অথচ অতীতে আমেরিকার সব ডিগনিটারি বাংলাদেশ সফরকালে বিরোধী দলে অবস্থান করা সত্ত্বেও বেগম জিয়ার সাথে দেখা করেছেন। একই কথা প্রযোজ্য ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব সুব্রামনিয়াম জয় শঙ্করের ক্ষেত্রেও। তিনি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ছাড়াও আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের সাথে বৈঠক করেছেন। কিন্তু তিনি বিএনপির কোনো সিনিয়র নেতা এমনকি বেগম জিয়ার সাথেও দেখা করেননি। বলা হয়ে থাকে যে, গণচীনের সাথে বিএনপির বন্ধুত্ব নাকি সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। কিন্তু কিছুদিন আগে চীনের উপ-প্রধানমন্ত্রী যখন বাংলাদেশ সফরে আসেন তখন আওয়ামী সরকারের সাথে কথাবার্তা বললেও বেগম জিয়ার সাথে বৈঠকের কোনো চেষ্টাও করেননি। অতীতের যে কূটনৈতিক রীতিনীতি ও প্র্যাকটিস বাংলাদেশে রয়েছে সেই ট্র্যাডিশন অনুযায়ী বিএনপি তথা বেগম জিয়ার সাথে তাদের দেখা সাক্ষাৎ হওয়ার কথা ছিল।
আর বিদেশ নির্ভরতা নয়
এগুলো কেন ঘটছে? এখন সময় এসেছে, এসব নিয়ে বিএনপির গভীরভাবে ভাবার। একটি দল যখন শক্তিশালী থাকে, দলটির রাজনৈতিক তৎপরতা যখন সবার নিকট দৃশ্যমান হয় তখন তাকে আর বিদেশী শক্তিরা ইগনোর বা উপেক্ষা করতে পারে না। বিগত ১৪ মাস হলো বিএনপির কোনো দৃশ্যমান তৎপরতা নেই। বিএনপির সব কর্মকা- সংবাদ বিজ্ঞপ্তি এবং সংবাদ সম্মেলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বিএনপি হয়তো বলবে যে, তাদেরকে মিটিং- মিছিল করতে দেয়া হয় না। তাদের ওপর প্রচ- দমননীতি চলছে। এসব কথার মধ্যে সত্যতা আছে। কিন্তু বিগত ১৪ মাসে পুনর্গঠিত হয়ে বিএনপি মাঠে নামতে পারত। কিন্তু মাঠে নামার কোনো চেষ্টাও তারা করেনি। কয়েক হাজার মানুষ নিয়ে মিছিল করলে এবং সেই মিছিল থেকে নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করলে সেটির প্রভাব পড়ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। কিন্তু বিগত ১৪ মাসে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি এবং আগামীতেও নেয়ার কোনো আলামত নেই। বিএনপিকে রাজপথমুখী না হয়ে গুলশানের কূটনৈতিক পল্লীমুখী হতে দেখা যাচ্ছে। শক্তি সঞ্চয় না করলে বিদেশীরা রুপার থালায় ক্ষমতায় এনে বিএনপির হাতে দেবে না। বিএনপির শক্তি হওয়া উচিত জনগণ। জনগণের শক্তিতেই তাদেরকে ক্ষমতায় যেতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন