শতাব্দির মহীরুহ মৌকারার পীর মুহাম্মাদ অলী উল্লাহ রহ.। প্রকাশ মৌকারার হুজুর, মৌকারার পীর সাহেব ক্বিবলা।
জন্ম ও বাল্যকাল: বিগত শতাব্দির প্রথম দশকের শুরুতে ১৯০৫ ঈসায়ী সনে আলহাজ্ব মাওলানা পীর অলি উল্লাহ রহ. জন্মগ্রহণ করেন। অমানিশার ঘন আঁধারে আলোকের বিস্পোরন হয়ে জন্মে ছিলেন হযরত পীর সাহেব ক্বিবলা রহ.।
পিতা- সূফি আব্দুল হামিদ ,মাতা- জোহরা খাতুন। পিতা-মাতা দুজনেই ছিলেন আধ্যাত্মিক জগতের পথিক। এ দম্পত্তির ছয় সন্তানের মধ্যে শিশু অলী উল্লাহ ছিলেন জৈষ্ঠ। আল্লাহ পাক তাঁকে সব দিক দিয়েই সহোদরদের মাঝে জৈষ্ঠতা দান করেছেন। সর্বোপরি শিশুকাল হতে মহাপ্রভু তাঁকে গড়ে তুলেছেন পরিবার-পরিবেশ, সমাজ, ও জীবনকে, অজ্ঞতা ও র্শিকের কলুষ হতে টেনে তোলার এক বিশেষ শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে। পিতা সূফি আবদুল হামিদ রহ. ছিলেন কাছাড়ের পীর সূফি আবদুর রাজ্জাক রহ. এর মুরীদ। পীরের আনুগত্য তাঁর চরিত্রের এক বিশেষ দিক ছিল, প্রতিটি কাজে পীরের অনুসরণ করতেন, তাঁর দোয়া চাইতেন। কামফধারী এ পীর ছিলেন যেন তাযকিরাতুল আউলিয়ার অলীদের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। মূলত: এ সমস্ত পীর মাশায়েখদের ছোহবত বা পবিত্র স্পর্শ ও আন্তরিক দোয়াতেই পীর অলি উল্লার জন্ম ও বৃদ্ধি।
সবুজ বাংলার মুক্ত প্রকৃতির মাঝে গ্রামীন জীবন ও পরিবেশে শিশু অলি উল্লাহ বড় হতে থাকেন। ‘Morning shows the day’- এ প্রবাদটি পীর অলি উল্লাহর জীবনে প্রত্যক্ষ হয়ে দেখা দিয়েছে। আবাল্য তাঁর ধর্মানুরাগ, ওলামা ও আওয়িাদের প্রতি গভীর ভক্তি-ভালোবাসা, সর্বাবস্থায় আল্লাহ-মুখীতা কম্পাস কাঁটার মতো উত্তর দক্ষিন মূখিতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
জন্মস্থান: মৌকারা গ্রাম পীর অলী উল্লাহ রহ. এর জন্মস্থান। দক্ষিন কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলাধীন এ গ্রাম। মৌকারা শব্দের মাধ্যেই যেন এ ক্ষণজন্মা পুরূষের কর্মকুশলতা ও আধ্যাত্মিক দীপ্তি সংগুপ্ত আছে। ‘মৌ’ করে যে, (মধু সংগ্রহ করে যে) ‘মৌমাছি’ঃ জীবনের প্রস্তুতি পর্বে পীর ক্বিবলা রহ. মৌমাছির মতো ক্লান্তহীন প্রচেষ্টায় ক্বলবে নূর,আত্মার নির্যাস অর্জনে চারদিকে উরে বেড়িয়েছেন; জীবনের উত্তর পর্বে তৃষাতুর মানুষ একই মধুকর হয়ে এ মৌকারা গ্রামে তাঁর চতুর্দিকে ভীড় জমিয়েছে- বিগত প্রায় অর্ধ শতাব্দির ও অধিককাল ধরে।এ যেন তাঁর জন্মস্থান মৌকারার এক বাস্তব রূপায়ন।
শিক্ষা: ছাত্র জীবনের প্রথম পাঁচটি বছর পীর ক্বিবলা রহ. সরকারী প্রথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভ করেন। আসমানী জ্ঞানান্বেষনের নিমিত্তে ভর্তি হন পার্শবর্তী ঢালুয়া মাদরাসায়। পরবর্তীতে লাকসাম গাজীমুড়া আলিয়া মাদ্রাসায়। এ প্রতিষ্ঠান হতেই তিনি তখনকার সময়ের উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। তাঁর শিক্ষকদের অনেকেই আওলিয়া পর্যায়ের ছিলেন লোক ছিলেন।
বাই‘আত:শিক্ষানবিশী প্রতি ক্ষেত্রেই অত্যাবশ্যক, কামেল উস্তাযের নিবিড়তম সান্নিধ্যেই সত্যিকার জ্ঞান অর্জিত হয়। সায়্যেদুল মুরসালিন মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাক দরবার থেকেই এ শিক্ষাকে জগত প্রত্যক্ষ করে আসছে। আকাশের নক্ষত্রতুল্য, অনুপম চরিত্রের অধিকারী আমাদের সকল সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র সাহাবা কিরাম রা. ও সুবর্ণ যুগের সকল মূমিন-মুসলমান, শরিয়াত-ত্বরিকতের সকল ইমাম ও আওলিয়াগণের ক্ষেত্রে এ ধারা পূর্ণরূপে বিদ্যমান ছিলো। অবিচ্ছেদ্য এ ধারাবাহিকতায় পীর অলি উল্লাহ রহ. বাই‘আত গ্রহন করেন। তাঁর স্বনামধন্য পীর ছিলেন বৃহত্তর বাংলা ও আসামের অসাধারণ পুরুষ, শর্ষিনার আদি পীর হযরত মাওলানা শাহ সূফি নেছার উদ্দিন আহমদ রহ.। বাই‘আত সনঃ১৯৪৪ ঈসায়ী।
আধ্যাত্মিক সাধনা ও খেলাফত লাভ: মূমিন জীবনের সব সাধনাই মূলত: আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও আখিরাতের নাজাতের লক্ষে। আধ্যাত্মিক সাফাই বা আত্মিক পবিত্রতা, আল্লাহর পথে এগিয়ে যাওয়ার সোপান।চিরন্তন এ ধারাবাহিকতায় মুরীদ অলি উল্লাহ মোর্শেদের নির্দেশ মতো ডুবে যান গভীর সাধনায়। এ যেন এক অন্তহীন যাত্রা,ক্লান্তিহীন পথ-পরিক্রমা! আসহাবে সুফফা রা.-এর মতো পীর ক্বিবলা – এর নূরানী দরবারে তিনি পড়ে থাততেন অনাথের মতো, নিজেকে সম্পুর্ণ বিলিয়ে দিয়ে, সর্বরিক্ত হয়ে;‘ফানাফিশ্ শায়খ’ বলতে যা বুঝায় সাধনার এ স্তরে, আল্লাহ্ পাকের মেহেরবানীতে, মুরীদ অলি উল্লাহ র মাঝে উন্মেষ ঘটে। একে একে মারিফাতের জটিল ও কঠিন স্তর সমূহ ডিঙ্গিয়ে এতদাঞ্চলে মশহুর চারতরীকায় কামালিয়ত অর্জন করেন। আলহামদুলিল্লাহ।
কোন সুকর্মই বৃথা যায়না, এটাই মূলত: প্রকৃতির সুত্র: ইসলামের ফিতরাত, এরই ফলশ্রুতিতে হযরত পীর ক্বিবলা নেছার উদ্দিন আহমদ রহ. তদীয় অনুগত মুরীদ, ঝুঁকিপূর্ন আধ্যাত্মিক সিঁড়ি সমূহ ডিঙ্গিয়ে আসা সালিক, নফসে আম্মারার কন্ঠে লাগাম পরিয়ে নফসে মুৎমাইন্নায় পরিণত করা সাধকেক পরিয়ে দিলেন- সকল ত্যাগ ও সাধনার ফসল ‘খিলাফতের খিরকা’-হিদায়েতের ঝান্ডা! সাল:১৯৪৫ ঈসায়ী।
কাশ্ফ ও কারামত: চিশতিয়া তরীকায় পূর্ন কামালিয়াত পর্যন্ত ১৫টি স্তর বা দর্জা রয়েছে, ৫ম স্তর হলো কাশফ(অর্ন্তদৃষ্টি) ও কারামতের (খোদায়ী শক্তির বিশেষ প্রকাশ)। সন্দেহ নেই, এদুটো, বান্দার প্রতি আল্লাহর বিশেষ মেহেরবানির প্রকাশ। যথারীতি পীর অলি উল্লাহ রহ. এর মাঝে কামালিয়াত-ধারা অতিক্রমের এ দুটো নিদর্শন দিনকে দিন স্পষ্টতর হতে থাকে। এ সবেরজীবন্ত স্বাক্ষী হয়ে আছেন চারপাশের অতি পরিচিত আপনজন,অসংখ্য ছাত্র ও মুরীদ।কর্মজীবন: পীর অলি উল্লাহর জীবনের মূখ্য কর্মটিই ছিলো মানুষকে হিদায়েত করা,পথহারা উম্মতদেরকে নবী-ই-পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শে উজ্জিবিত করে আল্লাহ পাকের দরবারে এগিয়ে দেওয়া।মহান আল্লাহ যুগেযুগে তাাঁ অপার অনুগ্রহ বিতরণে পথভ্রষ্ট মানুষকে সত্য ও সুন্দরের পথ দেখান, হিদায়াত দান করে তাঁর ক্ষমা ও পুরস্কারের য়োগ্য করে তোলেন; আম্বিয়া কিরমের পরবর্তী যুগে আওলিয়া তথা মুজাদ্দি-ই-যামান – এর মাধ্যমেই বান্দার প্রতি আল্লাহ পাক এ মেহেরবানী আঞ্জাম দিয়ে থাকেন।আমাদের আজকের আলোচ্য মৌকারার পীর সাহেব হুজুর শাহ সূফি অলি উল্লাহ রহ. ছিলেন সে সব জামানার মুজাদ্দিদদের অন্যতম। আলহামদুলিল্লাহ। তাঁর সত্তর বছরের সুদীর্ঘ কর্মজীবনের প্রতিটি দিন, ম্স ও বছর হিদায়েত ও মানব কল্যানের স্বাক্ষ্য বহন করছে। তিনি একাধারে ইলমে শরীয়াতের শিক্ষাদান ও আধ্যাত্মিক স্ফুরণ ঘটাতে যুগপঃ কাজ করে চলেন। এ লক্ষ্যে নিজ বাড়ির আঙ্গীনায় প্রথমে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন দারুচ্ছুন্নাত ফাযিল মাদ্রাসা(বর্তমানে কামিল) মাদ্রাসা ও হিফজ্খানা। যা বর্তমানের দীর্ঘ কয়েক যুগের লালনে হয়ে উঠেছে মনমাতানো সুরম্য বিদ্যা নিকেতনের সমষ্টি-‘মৌকারা দারুচ্ছুন্নাত ওয়ালিয় কমপ্লেক্স’। প্রতিষ্ঠাকাল: ১৯৪৭ ঈসায়ী।
পারিবারিক জীবন: পীর ক্বিবলাহ রহ. দু স্ত্রী গ্রহন করেন। প্রথমা স্ত্রীর ঘরে দু পুত্র সন্তান ও দু কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। দ্বিতীয়া স্ত্রীর গর্ভে জন্ম লাভ করে তিন পুত্র ও চার কন্যা।বর্তমানে তার উত্তর বংশধরদের সংখ্যা শতাধিক।
ইন্তিকাল: বাংলার বুলবুল আজ আর নেই, শতাব্দির দিবাকর অস্তাচলে পাড়ি জমিয়েছেন। বিগত ৩০ মর্হরম, ১৪২৭ হিজরী, ১৭ই ফাল্গুন ১৪১৩ বাংলা, ১লা মার্চ,২০০৬ ঈসায়ী ভোর ৪টা ৩০ মিনিটে মুজাদ্দিদে জামান মৌকারার পীর ক্বিবলাহ্ আলহাজ্ব মাওলানা অলি উল্লাহ্ রহ. নশ্বর পৃথিবীর মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে, প্রিয় পরম মহান আল্লাহর সন্নিধানে উপনীত হয়েছেন। ইন্নালিল্লাাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন