রাজধানীর ওয়ারী থানা এলাকার হুমায়ুন সাহেবের রেল গেইটে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হয় এসএসসি পরীক্ষার্থী শারমিন আক্তার। সোহেল নামের এক বখাটে দিনে দুপুরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে শারমিনকে। গত বছরের ২৮ নভেম্বর নির্মম এই হত্যাকাÐ নিয়ে পুলিশের গড়িমসির অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিহতের মা সালমা বেগম জানান, হত্যাকাÐের চার মাস অতিবাহিত হলেও মামলার কোনো অগ্রগতি নেই। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট আসেনি জানিয়ে ওয়ারী থানা পুলিশ সময়ক্ষেপণ করে চলেছে। অথচ মিটফোর্ড হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের তথ্যমতে, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট আরও দেড় মাস আগেই পাঠানো হয়েছে। এদিকে এরই মধ্যে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুইবার পাল্টানো হয়েছে। এতে করে মামলার তদন্তকাজ অনেকটাই থমকে গেছে।
নিহত শারমিনের মা সালমা সালমা বেগম জানান, শারমিনের হত্যাকারী সাহেল পাশের মহল্লায় থাকতো। বখাটে সোহেল হত্যাকাÐ ঘটানোর ২/৩ বছর আগে থেকেই শারমিনকে উত্যক্ত করতো। এক পর্যায়ে সে শারমিনদের বাসায় এসে শাসিয়ে যায়। এ নিয়ে তিনি ওয়ারী থানায় তিনবার জিডি করেছিলেন। কিন্তু পুলিশ জিডির তদন্ত করেনি। এমনকি পুলিশকে বার বার অনুরোধ করার পরেও একবারও আসেনি। সালমা বেগম আক্ষেপ করে বলেন, আমরা গরীব মানুষ। টাকা দিতে পারিনি বলে পুলিশ আসেনি। পুলিশ বিষয়টাকে একটু গুরুত্ব দিলেই আমার মেয়েটাকে এভাবে নির্মমভাবে জীবন দিতে হতো না। বেঁচে থাকলে আজ সে কলেজে পড়তো।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২৮ নভেম্বর সকাল ১০টার দিকে গোপীবাগ হুমায়ুন সাহেবের রেলগেইটের কাছে প্রকাশ্যে দিবালোকে সোহেল নামের এক বখাটে এসএসসি পরিক্ষার্থী শারমীন আক্তার কে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও গলা কেটে জখম করে। ওই দিন শারমিনের স্কুলে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায়ী অনুষ্ঠান ছিল। সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে শারমিন বাসা থেকে স্কুলের দিকে যাচ্ছিল।
শারমিনের মা সালমা বেগম ওই দিনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ঘটনার দিন শারমিনের স্কুলে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায়ী অনুষ্ঠান ছিল। সকালে সে গোসল করে সিভিল পোশাকে সাজগোজ করে প্রস্তুত হয়। এরপর পাশের রুমের এক মহিলাকে ডেকে বলে, ফুপু মোবাইল দিয়ে আমার কয়টা ছবি তুলে দেন। মহিলাটি শারমিনের কয়েকটা ছবি তুলে দেয়। এরপর সে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পর খবর আসে শারমিনকে সোহেল হত্যা করেছে। আমরা ছুটে যাই। তিনি জানান, বখাটে সোহেল ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা ছাড়াও শারমিনের গলা কেটে ফেলায় ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। স্থানীয় লোকজন খুনী সোহেলকে ঘটনাস্থলেই হাতেনাতে আটক করে। এরপর পুলিশ লাশ মর্গে পাঠায় ময়নাতদন্তের জন্য। শারমিনের মা বলেন, রাতে ওয়ারী থানায় ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে পুলিশ বলে, যে খুন করেছে সে তো ধরাই পড়েছে। আর কাউকে আসামী দেয়া যাবে না।
ওয়ারী থানার ১৮/৭/বি কেএম দাস লেনের বাসায় ভাড়া থাকেন শারমিনের মা। দুই বছর আগে শারমিনের বাবা হার্ট এটাক করে মারা যায়। স্বামীর অকাল মৃত্যুতে দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েন সালমা বেগম। অভাব তার সংসারে জেঁকে বসে। কিন্তু অভাবের মধ্যেও ছেলেমেয়ের লেখাপড়া বন্ধ করেননি তিনি। স্বামীর অবর্তমানে নিজেই বাসাবাড়িতে কাজ করা শুরু করেন। সেই টাকায় কোনোমতে সংসারের হাল ধরেন। এরই মধ্যে বখাটে সোহেল খুন করে শারমিনকে। সালমা বেগম বলেন, মেয়ের মৃত্যুর পর আমার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। বহু কষ্টে কোনোমতে বেঁচে আছি। এতোকষ্টের পরেও যদি মেয়ের খুনীর ফাঁসি দেখে যেতে পারতাম তবে মরেও শান্তি পেতাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি যে হবে তা বুঝতে পারছি না।
শারমিন হত্যাকাÐের পর ওয়ারী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের হয় (নং-৩১,তারিখ ২৮(১১)২০১৮)। কিন্তু মামলার তদন্ত নিয়ে শুরু থেকেই গড়িমসি করে পুলিশ। শারমিনের মা বলেন, আমার মেয়ে খুন হয়েছে। মেয়ে বেঁচে থাকতে থানায় একাধিক জিডি করার পর একবারও পুলিশ আসেনি। অথচ মেয়ে খুন হওয়ার পর পুলিশ বাসার আশপাশে অযথা ঘোরাঘুরি করে। এতে করে আমরা যেমন আতঙ্কিত, মামলার সাক্ষীরাও ভয়ে আছে। হত্যাকাÐের প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই আতঙ্কে আছে। এরই মধ্যে কেউ কউে সাক্ষী দিবে না বলে জানিয়েছে। এতে করে মেয়ে হত্যার বিচার পাবো কি না তা নিয়েও সংশয়ে আছি। স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দাও শারমিন হত্যাকাÐের নৃশংসতার বিবরণ দিয়ে বলেন, একটা সভ্য দেশে এভাবে রাস্তায় স্কুলগামী একজন শিক্ষার্থী এভাবে প্রকাশ্যে খুন হবে ভাবাই যায় না। ওয়ারী থানা এলাকাকে ক্রাইমজোন আখ্যা দিয়ে মালেক নামে একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, শারমিন হত্যাকাÐের পর বখাটেদের উৎপাত একটুও বন্ধ হয়নি। রাস্তার অলিতে-গলিতে নেশাখোর ও বখাটেদের আড্ডা। আমরা আমাদের মেয়েদের একা স্কুলের পথে ছাড়তে পারি না। বখাটে, নেশাখোর আর ছিনতাইকারীদের উৎপাতে আমরা সবাই আতঙ্কিত। এলাকায় পুলিশের টহল বলতে কিছু নেই। দেড় বছর আগেও সাত সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তালহাকে খুন করলো ছিনতাইকারীরা। চার মাস আগে খুন হলো এসএসসি পরীক্ষার্থী শারমিন। এরপরেও পুলিশের কোনো তৎপরতা নেই। এটা খুবই দুঃখজনক। তিনি ওয়ারী এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে পুলিশ প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করে বলেন, এভাবে চললে একটার পর একটা ঘটনা ঘটতেই থাকবে। ##
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন