শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

যুক্তরাষ্ট্রে গর্ভাবস্থায় ও পরে মানসিক অবসাদগ্রস্ততা পরীক্ষার আহ্বান

প্রকাশের সময় : ২৮ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : গর্ভাবস্থা ও সন্তান জন্মদানের পর মহিলাদের মানসিক অবসাদগ্রস্ততা পরীক্ষা করে দেখা উচিত। মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্র সরকার নিযুক্ত এক প্রভাবশালী স্বাস্থ্য প্যানেল যুক্তরাষ্ট্র নিবারণমূলক সেবা টাস্কফোর্সের সুপারিশে এ কথা বলা হয়। প্যানেল এই প্রথমবার মাতৃ মানসিক অসুস্থতা পরীক্ষার সুপারিশ করল।
মাতৃ মানসিক অসুস্থতা আগে যা ধারণা করা হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি মহিলার মধ্যে পরিলক্ষিত হওয়ার প্রেক্ষিতে এ সুপারিশ এসেছে। এ সুপারিশ আরো বহু স্বাস্থ্য সেবাদাতাকে মহিলাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উৎসাহিত করবে বলে আশা করা হচ্ছে। দেখা গেছে যে প্রসূতিদের অবসাদের বেশিরভাগ ঘটনাই প্রকৃতপক্ষে শুরু হয় গর্ভধারণকালে এবং তার চিকিৎসা করা না হলে তা শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। কিছু বিশেষজ্ঞে মতে, প্রসবকারী মায়েদের প্রতি ৭ জনের একজনের মধ্যে এ লক্ষণ দেখা যায়। সুপারিশে রাজ্য প্রশাসন, স্বাস্থ্য সংস্থাসমূহ ও স্বাস্থ্য প্রবক্তাদের এ ব্যাপারে আরো বেশি করে উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে। নর্থ ক্যারোলিনা বিশ^বিদ্যালয়ের মেডিসিনের অধ্যাপক ও এ সুপারিশ প্রণেতা ডা. মাইকেল পিগনোন বলেন, গর্ভকালীন ও সন্তান প্রসবের পর অবসাদগ্রস্ততায় আক্রান্ত মহিলাদের চিহ্নিত ও চিকিৎসা করার ভালো প্রমাণ রয়েছে। এ জন্যই আমরা সুনির্দিষ্টভাবে এ সময়টাতে মহিলাদের পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথার বলেছি।
এ সুপারিশ হচ্ছে প্যানেল প্রণীত অবসাদ পরীক্ষা গাইড লাইনের অংশ যে প্যানেল হচ্ছে স্বাস্থ্য ও মানবিক সেবা দফতরের নিয়োগকৃত নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞদের একটি গ্রুপ। ২০০৯ সালে গ্রুপ বলেছিল, ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের যদি সামর্থ ও চিকিৎসা প্রদানের মত জনবল থাকে তাহলে প্রাপ্ত বয়স্কাদের পরীক্ষা করা উচিত। আর নতুন গাইড লাইনে এ ধরনের জনবল না থাকলেও প্রাপ্ত বয়স্কাদের পরীক্ষা করার সুপারিশ করে বলা হয়েছে যে মানসিক স্বাস্থ্য সমর্থন এখন আরো বেশি সহজলভ্য। ২০০৯ গাইড লাইনে গর্ভাবস্থায় বা সন্তান প্রসবের পর মানসিক অবসাদের উল্লেখ করা হয়নি।
মিনেসোটা বিশ^বিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সহযোগী অধ্যাপক কেটি কোঝিমানিল বলেন, এটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে টাস্ক ফোর্স সুনির্দিষ্টভাবে গর্ভবতী ও প্রসবকারী মহিলাদের ব্যাপারে এখন একটি সুপারিশ করেছে। নীতি নির্ধারকদের এদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। মানসিক অবসাদের বর্ধিত পরীক্ষা ও নির্ণয় একটি বড় জনস্বাস্থ্য চাহিদা।
‘বি’ শ্রেণির জে এ এম এ-র জার্নালে প্রকাশিত প্যানেলের সুপারিশের অর্থ অবসাদ পরীক্ষা অবশ্যই সাশ্রয়ী পরিচর্যা আইনের আওতায় করতে হবে।
বহু বছর ধরে গর্ভাবস্থায় ও প্রসবের পরে মহিলাদের দেখাশোনাকারী ধাত্রী ও স্বাস্থ্য সেবাদাতারা চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব অনুভব করেছেন অথবা অবসাদ, উদ্বেগ ও দুরারোগ্য রোগের সমস্যা (ও.সি.ডি) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে অনাগ্রহী ছিলেন।
চ্যাপেল হিলের নর্থ ক্যারোলিনা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রসবপূর্ব ও পরবর্তী মনোচিকিৎসা কর্মসূচির পরিচালক ডা. সামান্থা মেল্টজার-ব্রডি বলেন, ধাত্রীবিদ্যা-স্ত্রীরোগ বিশারদরা মনে করেন যে যদি তারা কিছু সনাক্ত করেন ও তা সমর্থন করার মত সম্পদ তাদের না থাকে, সেটা তাদেরকে বড় ধরনের আইনি ঝুঁকিতে ফেলে। তিনি বলেন, শিশু চিকিৎসকরা সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন, তাদের রোগী আসলে মা নন, শিশু।
তিনি আরো বলেন, বহু মহিলাই তাদের রোগের লক্ষণ নিয়ে চিকিৎসকদের সাথে আলোচনা করতে আগ্রহী নন।
পাঁচ বছর আগে তার প্রথম গর্ভাবস্থার আগে বা পরে ওরিগনের ডালেসের ৩০ বছর বয়স্কা মেলিসা মিডকে কেউ পরীক্ষা করেনি। তিনি বলেন, ছেলে ব্র্যাডির জন্মের পরপরই আমি প্রসবের মানসিক অবসাদ, উদ্বেগ ও ও.সি.ডির অভিজ্ঞতা লাভ করি। আমি তখন জানতাম না যে এগুলো কি।
মিড বলেন, আমি ক্রমাগত কেঁদেছি, খুবই কম ঘুমাতে পেরেছি এবং আমার বাচ্চাটি শ^াসরুদ্ধ হয়ে মারা যেতে চলেছে বলে তার মৃত্যু ভয়ে ভীত ছিলাম। মিড একজন চক্ষু চিকিৎসক। তাই লোকে তাকে জিজ্ঞেস করত, সবকিছুই কি সুন্দর নয়? তিনি বলেন, আমার অনুভূতি ছিল ভিতরে ভিতরে মরে যাওয়ার মত।
এক বছর পর তিনি একজন মনোচিকিৎসকের সাথে সাক্ষাৎ করেন। যখন তার দ্বিতীয় ছেলে এমেট জন্ম নিল তখন তার মধ্যে মানসিক অবসাদের আরো লক্ষণ দেখা যায়। তার এ আশংকাও হতে থাকে যে তিনি রান্নার ছুরি দিয়ে আত্মহত্যা করতে পারেন। তিনি কাজ না হওয়া পর্যন্ত কয়েকটি ওষুধ গ্রহণ করেন। তিনি এখন প্রসূতি সহায়তা ইন্টারন্যাশনালের একজন স্বেচ্ছাসেবী।
প্যানেলের সুপারিশে চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট চিকিৎসক বা কতবার দেখাতে হবে তা বলা হয়নি। ডা. পিগনোন বলেন যে রোগীর সাথে যারই সেবামূলক সম্পর্ক আছে তারই উচিত রোগীর পাশে বসা ও জিজ্ঞেস করা আমরা কিভাবে এর চিকিৎসা করতে চাই। গ্রুপ বলে যে পরীক্ষা পদ্ধতির জন্য ১০ প্রশ্নভিত্তিক জরিপ এডিনবরা পোস্টন্যাটাল ডিপ্রেশন স্কেল কার্যকরী।
প্যানেল বলে, সাক্ষ্যপ্রমাণে দেখা যায়, জ্ঞানমূলক আচরণগত চিকিৎসা মায়েদের জন্য সহায়ক। গর্ভাবস্থায় অ্যান্টিডিপ্রেসান্ট ব্যবহার ভ্রƒণের সম্ভাব্য মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। তবে গুরুতর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা কম।
ডা. পিগনোন জোর দিয়ে বলেন, অচিকিৎসিত মানসিক অবসাদের বহু রকম খারাপ পরিণতি হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, তার মধ্যে রয়েছে মানসিক অবসাদের শিকার মহিলারা শিশুজন্ম পূর্বের স্বাস্থ্য বিষয়ে কম যতœ নেন। তারা বলেন, মাতৃমানসিক অসুস্থতা শিশুদের আক্রান্ত করতে পারে যার ফলে আচরণগত সমস্যা, আবেগজনিত অস্থিতিশীলতা ও স্কুলে জটিলতা সৃষ্টি হয়।
ন্যূনতম কাউন্সেলিং সহ পরীক্ষার সাক্ষ্য উদ্ধৃত করার পাশাপাশি প্যানেল দেখতে পেয়েছে যে পরীক্ষা কোনো ক্ষতি করে না। প্রসূতি সহায়তা ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক ওয়েন্ডি এন. ডেভিস বলেন, এক দশক আগেও অনেক বেশি উদ্বেগ ছিল যে গর্ভবতী ও প্রসূতি মহিলাদের পরীক্ষা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের বেশি ক্ষতি করে। চিকিৎসা প্রদানকারীরা আমাকে বলতেন যে আমি যদি পরীক্ষা করি এবং সে যদি অবসাদ ও উদ্বেগের জন্য ইতিবাচক হয় আমার ভয় যে তা তাকে আরো ভীত করবে অথবা তার জন্য আরো সমস্যার সৃষ্টি করবে।
প্যানেল সুপারিশ করে যে মহিলাদের রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা করার ক্ষমতা চিকিৎসকদের আছে অথবা তারা তা অন্য চিকিৎসকের কাছে রেফার করতে পারেন। ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের মহিলাদের মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিচালক ডা. লি এস. কোহেন বলেন, এটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি অসুস্থ মহিলাদের চিহ্নিত করার প্রশংসা করি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে তাকে কি সঠিকভাবে রেফার করা হচ্ছে? ওষুধই হোক আর চিকিৎসাই হোক, তা কি যথাযথ হচ্ছে? সময় পার হওয়ার সাথে তিনি কি আগের চেয়ে ভালো হয়ে উঠেছেন?
যুক্তরাষ্ট্রে একমাত্র নিউজার্সি রাজ্যেই এ পরীক্ষা করা হয় এবং খুব অল্প চিকিৎসা সুবিধার কারণে এর মিশ্র ফলাফল দেখা যায়। ডা. কোঝিমানিলের এক জরিপে দেখা যায়, মহিলাদের চিকিৎসা করার জন্য শিশু চিকিৎসক ও ধাত্রীবিদ্যা বিশারদদের প্রশিক্ষণ দেয়া হলেও পরীক্ষা করার জন্য তাদের কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়া হয় না।
নিউইয়র্কসহ আরো এক ডজন রাজ্যে পরীক্ষা, শিক্ষা ও চিকিৎসা উৎসাহিত করার জন্য এখন আইন রয়েছে। নিউইয়র্কের সিটি মেয়র বিল দ্য ব্লাসিও সম্প্রতি গর্ভবতী ও প্রসূতি মহিলাদের জন্য একটি সার্বজনীন পরীক্ষার লক্ষ্য ঘোষণা করে বলেছেন, এটি নিয়মিত স্বাস্থ্য সেবার অংশ হবে।
নিয়মিত পরীক্ষা আইওয়ার সিডার ফলসের ৪০ বছর বয়স্কা জেনা জালক বেরেন্ডজেনের জন্য কল্যাণকর হতে পারে। যদিও পাঁচ বছর আগে তার প্রথম গর্ভাবস্থায় তিনি একজন নার্স হওয়ার জন্য পড়াশোনা করেন ও চিকিৎসা জ্ঞান অর্জন করেন। তা প্রসূতিকালীন মানসিক অবসাদগ্রস্ততা পূর্ব ইতিহাস থাকলেও তিনি মনে করতেন যে তার ক্ষেত্রে এটা হবে না। তিনি বলেন, ম্যাক্সওয়েল নামে পুত্রের জন্মের পর অবসাদ আমাকে প্রচন্ডভাবে আক্রমণ করে। তিনি আত্মহত্যা প্রবণ হয়ে ওঠেন। একদিন ছেলে ও স্বামী ঘুমিয়ে পড়ার পর তিনি বিভিন্ন ধরনের ১৫টি ওষুধে বোতল সামনে নিয়ে বসেন। তিনি বলেন, আমি সেগুলো মুখ খুলছিলাম আর বন্ধ করছিলাম। বারবার। আমি শুধু ভাবছিলাম আমি মরতে চাই না। কিন্তু পরিস্থিতি ভালো হচ্ছিল না।
জেনা শেষপর্যন্ত কার্যকর চিকিৎসা লাভ করেন এবং তখন থেকে নিম্ন মাত্রা ওষুধ গ্রহণ করছেন। ২০১৪ সালে আরেকটি ছেলের জন্ম দেন তিনি, কোনো সমস্যা হয়নি। এখন তিনি আইওয়া ওয়াটারলুতে ইউনিটি পয়েন্ট হেলথে স্ত্রীরোগ বিভাগে কর্মরত। তিনি বলেন, গত বছর থেকে আমরা স্বীকার করতে শুরু করেছি যে প্রত্যেক মহিলাকেই আমাদের পরীক্ষা করা প্রয়োজন। সূত্র নিউইয়র্ক টাইমস।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন