শেখ জামাল : সারা দেশে গুম, হত্যা, গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের মতো ঘটনা একের পর এক চলছেই। এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যকে দায়ী করছেন দেশের সচেতন জনগণ। সর্বশেষ এই বাহিনীর গ্রেপ্তারের ঘটনা নিয়ে গতকাল উদ্বেগ প্রকাশ করলেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। ইউনিফর্ম না পরে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেপ্তারের ঘটনা ভয়াবহ বলে মন্তব্য করেছেন আপিল বিভাগ। এর আগে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য কর্তৃক গুম, হত্যা, গ্রেপ্তার ও নির্যাতন নিয়ে মন্তব্য করেন। তিনি বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাড়াবাড়ি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। নিয়ন্ত্রণহীন পুলিশের এখন লাগাম টেনে ধরা দরকার; অত্যাচারী পুলিশ আমাদের প্রয়োজন নেই।
এদিকে দেশে গুম, হত্যা, গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ থেকে ভয়াবহতর হচ্ছে। বর্তমান মহাজোট সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও তাদের সময়ে কমপক্ষে ৪০৩টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ঘটেছে।
এদিকে কাউকে গ্রেপ্তার করতে হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যকে ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় থাকতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ইউনিফর্ম না পরে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেপ্তারের ঘটনা ভয়াবহ, বলেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার (৫৪ ধারা) ও হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ধারা (১৬৭ ধারা) সংশোধনে এক যুগ আগে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানিতে গতকাল মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি এসব মন্তব্য করেন। একই সঙ্গে এই বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের রায়ের দিন আগামী ২৪ মে ঠিক করেছেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। অন্যদিকে রিট আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টর এম আমীর-উল ইসলাম। মুরাদ রেজা পরে বলেন, ‘শুনানি শেষ হয়েছে, আদালত ২৪ মে রায়ের দিন রেখেছেন।’
আদালত শুনানির একপর্যায়ে প্রধান বিচরাপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের উদ্দেশে বলেন, ‘বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট রায়ে সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা দিয়েছিল। ১৩ বছর পার হয়ে গেলেও আপনার (সরকার) একটি নির্দেশনাও প্রতিপালন করেননি।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধি একটি কলোনিয়াল আইন। ১৯৭০ সালে মালয়েশিয়া এই আইনের সংশোধনী এনেছে। মালয়েশিয়াকে অনুসরণ করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও তাদের ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করেছে। কিন্তু আমরা এখনো এটি করতে পারছি না।’
এ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমাদের দেশের সামাজিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে হাইকোর্টের নির্দেশানসমূহ যথাযথ নয়। আর কাউকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় পুলিশ হেফাজতে যদি কেউ মারা যায় তাহলে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আমাদের দেশে আইন রয়েছে।’
এরপর প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘যথাযথ চিন্তাভাবনা না করেই আইন প্রণয়ন না করার কারণেই বিচার বিভাগের ওপর মামলার চাপ আছে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান আমাকে বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ডের দায়িত্ব পালনকারী এক মুক্তিযুদ্ধের সন্তানকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু আজও তাদের খোঁজ পাওয়া যায়নি।’ তিনি আরো বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলাবাহিনী কাউকে গ্রেপ্তার করেই গণমাধ্যমের সামনে হাজির করছেন না। এটি গ্রহণযোগ্য নয়।’
শুনানি শেষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আইনের অপপ্রয়োগের বিষয়ে আদালত যদি কোনো নির্দেশনা দেয়, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু আদালত আইন সংশোধনের জন্য এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে আদেশ দিতে পারেন না। আদালতকে সমন্বয় করতে হবে, যাতে করে মামলার আসামি এবং বাদী কেউই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘৫৪ ধারায় আসামিদের সুরক্ষার বিষয়ে নানা রকম বক্তব্য রয়েছে। কিন্তু সমাজে নানা রকম মানুষ রয়েছে। আসামিদের যেভাবে অধিকার রয়েছে, তেমনি ভিকটিমের (ভুক্তভোগী) অধিকার রয়েছে। আমাদের দেশে বর্তমানে জঙ্গিবাদ, গুপ্তহত্যায় মুক্তচিন্তার মানুষের বিরুদ্ধে যে অবস্থান, তাতে যদি আইনের সঠিক প্রয়োগ না হয়, তাহলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে।’
মামলার বিবরণে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে বেসরকারি ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র শামীম রেজা রুবেলকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করার পর ওই বছরের ২৩ জুলাই মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশ-কার্যালয়ে তার মৃত্যু হয়। ওই ঘটনার পর বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানের নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। তদন্ত শেষে কমিটি ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের পক্ষে কয়েকটি সুপারিশ করে। সেসব সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করে। তার চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল হাইকোর্ট এ বিষয়ে কয়েকদফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেয়।
রায়ে ছয় মাসের মধ্যে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার ও হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে প্রচলিত বিধি সংশোধন করার পাশাপাশি ওই ধারা সংশোধনের আগে কয়েক দফা নির্দেশনা অনুসরণ করতে বলা হয় সরকারকে। রাষ্ট্রপক্ষ ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন করলে ২০০৪ সালে তা মঞ্জুর হয়। তবে হাইকোর্টের নির্দেশনা সে সময় স্থগিত করা হয়নি। এর ধারাবাহিকতায় গত ২২ মার্চ আপিল বিভাগে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের ওপর শুনানি শুরু হয়।
হাইকোর্টের রায়ে দেয়া নির্দেশনা
ক. আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেওয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করতে পারবে না। খ. কাউকে গ্রেপ্তার করার সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে। গ. গ্রেপ্তারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে কারণ জানাতে হবে। ঘ. বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেপ্তার ব্যক্তির নিকট আত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে বিষয়টি জানাতে হবে। ঙ. গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে তার পছন্দ অনুযায়ী আইনজীবী ও আত্মীয়দের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে। চ. গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে কারাগারের ভেতরে কাচের তৈরি বিশেষ কক্ষে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। ওই কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকট আত্মীয় থাকতে পারবেন। ছ. জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে। ট. পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল বোর্ড গঠন করবে। বোর্ড যদি বলে ওই ব্যক্তির ওপর নির্যাতন করা হয়েছে তাহলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা নেবেন এবং তাকে দ-বিধির ৩৩০ ধারায় অভিযুক্ত করা হবে। এসব নির্দেশনা ছয় মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছিল হাই কোর্টের সেই রায়ে।
এদিকে গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মিরপুরে চাঁদার টাকা না দেয়ায় পুলিশের আগুনে দগ্ধ চা দোকানি বাবুল মাতুব্বরের মৃত্যুর ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। পুলিশের বাড়াবাড়ি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে অভিযোগ করে তিনি বলেছেন, নিয়ন্ত্রণহীন পুলিশের এখন লাগাম টেনে ধরা দরকার; অত্যাচারী পুলিশ আমাদের প্রয়োজন নেই।
এদিকে মানবাধিকার সংস্থা অধিকার-এর রেকর্ড অনুযায়ী সোয়া ৩ বছরে ৪০৩ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ২০০৯ সালে ১৫৪, ২০১০ সালে ১২৭ ও ২০১১ সালে ৪৮ জন। ২০১২ সালে ৩৮ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার ৩৮ জনের মধ্যে ৩৩ জন কথিত ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে র্যাবের হাতেই ২৪ জন, পুলিশ কর্তৃক ৩ জন, র্যাব-পুলিশ যৌথভাবে ২ জন ও র্যাব-কোস্টগার্ড কর্তৃক ৪ জন নিহত হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন