রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

ইসলামী অর্থনীতিতে রয়েছে কল্যাণ

এসএম আরিফুল কাদের | প্রকাশের সময় : ১৫ মার্চ, ২০১৯, ১২:০০ পিএম

অর্থনীতি প্রত্যেক জাতি বা রাষ্ট্রের জন্যই অপরিহার্য। ইসলামী জীবন বিধানের অনুসারীদের জন্যও এ কথা সত্য। তাই ইসলামী অর্থনীতি বলতে ওই অর্থনীতিকে বোঝায় যার আদর্শ, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, কর্মপদ্ধতি এবং পরিণাম ইসলামী আকিদা মোতাবেক নির্ধারিত হয়। এই অর্থনীতির মূলনীতি ও দিক-নির্দেশনা বিধৃত রয়েছে আল-কুরআন ও সুন্নাহয়। ইসলামী অর্থনীতিতে মানুষ মূলত সম্পদের মালিক নয়, ব্যবহারকারী মাত্র। এই নীতির ভিত্তিতে ইসলামে নির্ধারিত সীমারেখার আলোকে মানুষের অর্থনৈতিক আচরণ, বিশ্লে­ষণ, সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার ও ন্যায়ানুগ বণ্টনের নিশ্চয়তা বিধান করাই ইসলামী অর্থনীতি।

ইসলামী আকিদা ও ঈমানী চেতনা লালন অর্থনীতির কল্যাণকর সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। ইসলামী অর্থনীতি ও ঈমান অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ইসলামী অর্থনীতি থেকে যদি এ বৈশিষ্ট্যকে তুলে নেওয়া হয় তাহলে সেটি মুখ থুবড়ে পড়বে। সফলতার আলো দেখতে পাবে না কখনো। কারণ এটি ঈমানের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতি নির্দেশ করে। আর তা হচ্ছে আমান তথা নিরাপত্তা ও শান্তি। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে- ‘যারা ঈমান এনেছে এবং নিজ ঈমানকে জুলুমের সাথে মিশ্রিত করেনি, তাদের জন্যেই নিরাপত্তা এবং তারাই হিদায়াত প্রাপ্ত।’ (সূরা আনআম : ৮২)। ঈমান একটি সহজবোধ্য বিষয়, যার শব্দগুলোও খুব সাবলীল। মন ও মননকে তার প্রতি আকৃষ্ট করে দারুণভাবে। অনুরূপভাবে এটি আনুগত্য ও বশ্যতা স্বীকারের প্রতিও নির্দেশনা প্রদান করে। অর্থাৎ মহান আল্ল­াহ ঈমান দ্বারা এমন সমর্থন ও স্বীকৃতি কামনা করেন যার পশ্চাতে থাকবে আনুগত্য ও মান্যতা। আর ঈমান শব্দটি মৌলিকভাবে উল্লে­খিত অর্থ বুঝিয়ে থাকে। অর্থাৎ ঈমানের অর্থ শুধুমাত্র সমর্থন ও স্বীকৃতিই নয় বরং আনুগত্য সংবলিত স্বীকৃতি। মানসপটে একটি জিজ্ঞাসা উঁকি দিচ্ছে যে, অর্থনীতির সাথে ঈমানের সম্পর্ক কি? তার সাথে এর যোগসূত্রই বা কি? কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটিতে আমরা এর সমাধান খোঁজে পাব। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আর যদি জনপদসমূহের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত তাহলে আমি অবশ্যই আসমান ও জমিন থেকে বরকতসমূহ তাদের ওপর খুলে দিতাম; কিন্তু তারা অস্বীকার করল। অতঃপর তারা যা অর্জন করত তার কারণে আমি তাদেরকে পাকড়াও করলাম।’ (সূরা আরাফ : ৯৬)। এ আয়াতে কারিমা থেকে জোরালোভাবে প্রতিভাত হচ্ছে, ঈমান ও তাকওয়া ইসলামী অর্থনীতির উন্নতি ও বিকাশের অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এ দু’টি বরকত ও প্রাচুর্যের অতি কার্যকরী উপকরণ। অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য হচ্ছে, অর্থনীতির মৌল উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিলাসবহুল প্রাচুর্যপূর্ণ সমাজের বাস্তবায়ন ও প্রতিষ্ঠা। সুতরাং আমরা বলতে পারি এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলতে চাচ্ছেন তোমরা যদি নিরাপদ অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে চাও যার মাধ্যমে প্রাচুর্যময় সুখী জীবন বাস্তবায়িত হবে তাহলে আল্ল­াহ ভীতি, তাঁর প্রতি অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপনের বিকল্প নেই।
রাসূল (সা.)-এর অসংখ্য হাদীসও এ আপাত সত্যটিকে পরিদৃষ্ট করেছে সুস্পষ্টভাবে। নবীজ (সা.) বলেন, ‘বয়স বৃদ্ধি নেক কাজের মাধ্যমেই সাধিত হয়, একমাত্র দোয়াই পারে তাকদীর রদ করতে, আর ব্যক্তি নিজ পাপের কারণেই মূলত রিজিক থেকে বঞ্চিত হয়।’ (সহিহ ইবনে মাজাহ)
নবীজী (সা.)-এর এ বাণী প্রচ্ছন্নভাবে ইসলামী অর্থনীতি ও ঈমানের ওতপ্রোত সম্পর্কের প্রতি তাগিদ করছে। অর্থনীতির উন্নতিতে তাকওয়া ও আল্লাহ ভীতির কার্যকারিতা প্রমাণিত ও একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। হাদীসের বিশাল ভাণ্ডারে এর দৃষ্টান্ত নিতান্তই কম নয়। যেমন এক হাদীসে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি একটি ঘর বা জমি বিক্রি করল অতঃপর বিক্রয়লদ্ধ মূল্য সমপর্যায়ের কাজে ব্যয় করল না, তাতে আর তার জন্য বরকত দেওয়া হবে না।’ (ইবনে মাজাহ ও মুসনাদে আহমাদ) এখানেও বিষয়টি অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, ইসলামী অর্থনীতির উন্নতির সম্পর্ক বস্তুগত বিষয়াদির সাথে নয়। বরং এর অগ্রগতি ও উন্নতি ঈমান ও ঈমান নির্ভর কার্যাবলীর সাথে সম্পৃক্ত। বর্তমানে স্টক এক্সচেঞ্জ ব্যবসা একটি আধুনিক ও লাভজনক ব্যবসা পদ্ধতি। কিছু লোক সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে যে, তারা নিজদের বাড়ি ঘর বিক্রয় করে সেখানে বিনিয়োগ করেছিল, কিন্তু ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দেওলিয়া হয়ে গিয়েছে। এখানে ব্যাপারটি সামান্য দুর্বোধ্যই বলতে হবে। কেননা, ঈমানের সাথে অর্থনীতির যোগসূত্রতা বাহ্যিক দৃষ্টিতে একটু অস্বাভাবিকই মনে হয়। তবে ব্যাপারটি অতি বাস্তব এবং এ দূরত্ব অদৃশ্য ও ঈমানী দূরত্ব যা কেবল ইসলামী অর্থনীতিতেই গোচরে আসে। আল্লাহ ও ধর্মে অবিশ্বাসী অর্থনীতিবিদ যাদের অর্থনীতি ঈমানের ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়নি, যা বরকত বঞ্চিত এবং যা বিশ্বকে শুধু ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অশান্তি ভিন্ন কিছু দিতে পারেনি তারা এ বাস্তবতাকে স্বীকার করে না।
ইসলামী অর্থনীতির উন্নতির সাথে তাকওয়া ও আল্লাহর প্রতি ঈমানের সম্পর্ক রয়েছে। নিম্নোক্ত হাদীসও আমাদেরকে এ সত্য মেনে নিতে বাধ্য করছে। ইসলামের নবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘দান সদকা সম্পদ হ্রাস করে না। ক্ষমা ও উদরতা বান্দার ইজ্জত সম্মানকে বৃদ্ধিই করে। আর আল্লাহর জন্য কেউ বিনয়ী হলে আল­াহ তার মর্যাদাকে বাড়িয়ে দেন।’ (সহিহ মুসলিম)
এ মানদণ্ড ও আদর্শ শুধুমাত্র ইসলামী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য। এতে নবীজি (সা.) বলছেন, সম্পদের হ্রাস বৃদ্ধিতে আল­াহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে দারিদ্র্য ক্লিষ্ট অনাথ মিসকিনদের দান সদকার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। আর সেটি দু’ভাবে হতে পারে। ১. দান সদকার কারণে মহান আল­াহ মুসলিম বান্দাদের বিপদাপদ সরিয়ে নেন মর্মে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। অনেক সময় এমন হয় যদি সে দান খয়রাত না করত তাহলে অজান্তেই তার সম্পদ উজাড় হয়ে যেত। সুতরাং স্পষ্ট হল যে, দান খয়রাত সম্পদ শুধু বৃদ্ধিই করে না, রক্ষাও করে। ২. মহান আল্লাহ অল্প সম্পদের ভেতর অধিক সম্পদ অপেক্ষা বেশি উপকার ও কল্যাণ দান করেন। অল্প সম্পদের মাধ্যমে এত উপকার লাভ করা যায় যা অনেক সম্পদ দ্বারা কল্পনাও করা যায় না।
ইসলামী অর্থনীতির আরো একটি কল্যানকর বৈশিষ্ট্য হল, এটি ওহির ওপর প্রতিষ্ঠিত এক পূর্ণাঙ্গ অর্থনীতি। প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের জোড়াতালি দেওয়া অসার চিন্তার ফসল নয় এবং এর উৎসও কিন্তু কোন মানুষ নয়, যাদের চিন্তা ও পরিকল্পনা প্রতি নিয়ত পরিবর্তন হয়। তারপরও তাতে থেকে যায় ভুলশুদ্ধ উভয়ের অবকাশ। সামগ্রিক বিবেচনায় এটি ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কেননা, এটি একমাত্র ওহির ওপরই নির্ভও করে ওহি ব্যতীত অন্য কিছুর প্রতি তার আস্থা নেই। এটি একটি স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা যার উৎস হচ্ছে ঐশী প্রত্যাদেশ। ইসলামে যাবতীয় মতবাদ ও চিন্তাধারা অর্থনীতি বিষয়ক হোক কিংবা সাধারণ বিষয়ক সবকিছুকে যাচাই ও তুলনা করা হয় ঐশী প্রত্যাদেশের সাথে। ওহির চেতনার সাথে সাঙ্ঘর্ষিক মতবাদ ও চিন্তাধারাকে পরিত্যাগ করা হয় আর সংগতিপূর্ণ তত্ত¡ ও মতবাদকে প্রেক্ষিত ও অবস্থার বিবেচনায় আমলে নেওয়া হয়। সুতরাং গ্রহণ বর্জনের সাধারণ মানদণ্ড একটিই, আর সেটি হচ্ছে ওহির চেতনার সাথে সামঞ্জস্যশীল হওয়া। আর বাস্তব পরিবেশ পরিস্থিতি হচ্ছে বিধানের বাস্তবায়ন ক্ষেত্র-উৎস নয়। অন্যদিকে পুঁজিবাদী অর্থনীতির আদর্শ হচ্ছে ভোগ বিলাস ও সুবিধাবাদ। যেমনি করে প্রেক্ষিত ও বাস্তব অবস্থা হচ্ছে বিধানের উৎস মূল বাস্তবায়ন ক্ষেত্র নয়। কারণ ধর্মনিরপেক্ষতা ও নাস্তিকতাই হচ্ছে পুঁজিবাদী অর্থনীতির আধার। আর সেটি “সুবিধাবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতাই হচ্ছে বিধানের উৎস” মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন