মোবায়েদুর রহমান : সারা দেশে প্রায় ৬০টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল অর্থাৎ ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। তার পরেও ধানমন্ডি, গ্রিন রোড, কলাবাগান, সায়েন্স ল্যাব, কাঁঠালবাগানসহ ঢাকার অনেক এলাকার লাখ লাখ মানুষ দৈনিক ৭-৮ বার অর্থাৎ ৭-৮ ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের দুর্ভোগ পোহাবে কেন? ভারত থেকে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। তারপরেও মানুষ দৈনিক ৭-৮ বার বিদ্যুৎবিচ্ছিন্নতায় কষ্ট করবে কেন? এই সরকারের আমলে বিদ্যুতের মূল্য অন্তত ৬ গুণ বেড়েছে। বিদ্যুতের দাম এত বিপুলভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার পরেও মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে কেন? এসব প্রশ্ন এখন রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে মফস্বল এলাকার অনেক মানুষের মুখে মুখে। এখন প্রতিদিন লোডশেডিং হচ্ছে। গত
দিন হলো প্রতিদিন ৭-৮ বার লোডশেডিং হয়। কোনো কোনো বার লোডশেডিংয়ের স্থায়িত্ব এক ঘণ্টা ছাড়িয়ে যায়। সকাল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কম করে হলেও ৭ বার যদি কারেন্ট যায় তাহলে ১২ ঘণ্টা দিনের মধ্যে ৭ ঘণ্টাই কারেন্ট থাকে না।
লোডশেডিংয়ের কারণ কী?
বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বলা হচ্ছে যে, সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে গ্রিন রোড পর্যন্ত এক বা একাধিক স্থানে নাকি আন্ডারগ্রাউন্ড বিদ্যুৎ ক্যাবল মারাত্মকভাবে নষ্ট হয়েছে। সেটির মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ নাকি চলছে। মাইক্রোফোনে জনগণকে অনুরোধ করা হয়েছে যে, তারা যেন ধৈর্য ধরে এই সাময়িক দুর্ভোগ মেনে নেন। বিদ্যুৎ বিভাগ মাইক্রোফোনের মাধ্যমে এই ধরনের অফিসিয়াল অ্যানাউন্সমেন্ট দিয়ে কাকে কী বোঝাতে চাচ্ছে সেটি তারাই ভালো বোঝেন। মাসের মধ্যে এমনিতেই এক-দুই বার রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। সে জন্য সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ৫-৬ ঘণ্টা কারেন্ট বন্ধ থাকে। এর মধ্যে আবার নতুন করে ব্রেক ডাউন হলে সেটি মেরামত বা ভালো করার জন্য প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা মানুষকে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হবে কেন? আজ ১২-১৪ দিন হলো একই কথা বলা হচ্ছে। রিপেয়ার বা মেইনটেনেন্সের জন্য কি দিনের পর দিন বা সপ্তাহের পর সপ্তাহ লাগে? আর বিদ্যুতের যন্ত্রপাতি একটি এলাকায় বিকল হলে সারা ঢাকায় বিভিন্ন সময় এভাবে বিদ্যুৎ যাবে কেন?
মফস্বলের অবস্থা
ঢাকায় বিদ্যুৎ বিতরণকারী দুটি কোম্পানি ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ডেসকো) সূত্রে জানা গেছে, কয়েক দিন ধরে এই দুটি কোম্পানির মোট লোডশেডিং হচ্ছে প্রায় ৩০০ মেগাওয়াট। ঢাকার বাইরে প্রতিটি শহর-নগরে লোডশেডিং ও বিদ্যুৎ বিভ্রাট এখন নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর পল্লী বিদ্যুতের (আরইবি) আওতাধীন বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলের অবস্থা আরও খারাপ। আরইবির এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ৯ মে, সোমবার তারা লোডশেড করেছে ১১৭৭ মেগাওয়াট। এর মধ্যে রাজশাহী অঞ্চলে ২৬৫; ঢাকা অঞ্চলে (ডিপিডিসি ও ডেসকোর এলাকা ছাড়া) ৩৮৫; ময়মনসিংহ অঞ্চলে ৫৯; যশোর ও খুলনা অঞ্চলে ১৩১; রংপুর অঞ্চলে ১২৩; চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৮৩; কুমিল্লা অঞ্চলে ৮১; বরিশাল অঞ্চলে ৩০ ও সিলেট অঞ্চলে ২০ মেগাওয়াট লোডশেড করা হয়েছে। এই লোডশেডিং ছাড়া সঞ্চালন ব্যবস্থার সমস্যার কারণে ৩৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘিœত হয়েছে। বর্তমানে আরইবির দৈনিক সর্বোচ্চ চাহিদা চার হাজার মেগাওয়াটের বেশি।
ঘাটতি ১০০০ মেগাওয়াট
পিডিবির হিসাব অনুযায়ী, কয়েক দিন ধরে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা সাড়ে আট হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে। কিন্তু জ্বালানি-সংকটের কারণে উৎপাদন সাড়ে সাত হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি রাখতে হচ্ছে। ঢাকায় বিদ্যুৎ বিতরণকারী দুটি কোম্পানি ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ডেসকো) সূত্রে জানা গেছে, কয়েক দিন ধরে এই দুটি কোম্পানির মোট লোডশেডিং হচ্ছে প্রায় ৩০০ মেগাওয়াট। এই সত্য কথাটি না বলে আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবল নষ্ট হওয়া ইত্যাদি ধানাই-পানাই করা হচ্ছে।
ভারত থেকে আমদানি ৫০০ মেগাওয়াট
ভারত থেকে এখন নিয়মিতভাবে আমদানি করা হচ্ছে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। গত ২৭ সেপ্টেম্বর পরীক্ষামূলকভাবে ভারতীয় বিদ্যুতের তারে যুক্ত হয় বাংলাদেশ। এ দিন কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় নির্মানাধীন ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে আসে এই বিদ্যুৎ।
বিদ্যুতের দাম ৬ গুণ বাড়ল কেন?
আমার নিজের কথাই বলছি। এই তো ৩-৪ বছর আগেও আমার বিদ্যুৎ বিল ১০০০ টাকাও হতো না। কিন্তু এ মাসে ৫০০০ টাকার বিল এসেছে। তার মানে হলো বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ বাবদ আমাকে ৩-৪ বছর আগের তুলনায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেশি টাকা দিতে হচ্ছে। কেন আমরা এত বেশি টাকার বিল দিচ্ছি? কঠিন সত্য এবং দুর্ভাগ্য জনক বিষয় হলো এই যে, হাতেগোনা কয়েকজন লোককে শত শত কোটি টাকার মালিক বানানোর জন্য কোটি কোটি মানুষের পকেট কাটা হচ্ছে। কথাগুলো আমরা ঢালাওভাবে বলছি না।
তেলচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ইউনিট প্রতি খরচ হয় কম করে হলেও ১৬ টাকা। পক্ষান্তরে গ্যাস চালিত কেন্দ্রে সেই উৎপাদন খরচ সর্বোচ্চ ৪ টাকা। যদি পানি বিদ্যুৎ বা কয়লাচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় তাহলে তার খরচ ইউনিট প্রতি ২ টাকার বেশি হয় না। এই সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রধানত নির্ভর করছে তেল চালিত অর্ধশতাধিক রেন্টাল বা কুইক রেন্টালের ওপর। এগুলো স্থাপন করার জন্য কোন টেন্ডার ডাকা হয়নি, কিংবা কোন কোন পার্টিকে কুইক রেন্টাল বরাদ্দ করা হবে তার জন্য কোন টেন্ডার বিধিও ফলো করা হয়নি। শুধু তাই নয়। পার্টি নির্বাচন এবং এসব স্থাপন করার জন্য যে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হবে সে খরচকেও দায়মুক্ত করা হয়েছে। এসব নিয়ে আদালতে কোন মামলা করা যাবে না, জাতীয় সংসদেও কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। কুইক রেন্টাল স্থাপন এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সরকারকে দিতে হচ্ছে অকল্পনীয় ভর্তুকি, যার পরিমাণ ৯-১২ হাজার কোটি টাকা। ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে বড় লোকদের। আর সেই ভর্তুকির টাকা আদায় করা হচ্ছে বিদ্যুৎ গ্রাহকদের পকেট থেকে।
সরকার কার কাছে কম দামে
বিদ্যুৎ বিক্রি করছে?
সংসদীয় কমিটি বলেছে যে, সরকার কম দামে বিক্রি করছে বলে তাদের লোকসান হচ্ছে। কিন্তু আসল কথা হলো এই যে, গ্রাহকদের কাছে সরকার কম দামে বিক্রি করছে না। কম দামে বিক্রি করছে বিতরণ কোম্পানীগুলোর কাছে। বিতরণ কোম্পানীগুলো উৎপাদন খরচের চেয়েও বেশী দামে সেই বিদ্যুৎ বিক্রয় করছে।
লুটপাট কোম্পানী হল
কুইক রেন্টাল
অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ কেন্দ্রের মালিকানার সঙ্গে সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতাকর্মী আর মন্ত্রী-এমপি জড়িত থাকায় সরকার তাদের কাছে একদিকে বেশি দামে তেল কিনে কম দামে বিক্রি করে টাকা গচ্চা দিচ্ছে। সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হচ্ছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এই রেন্টাল-কুইক রেন্টালগুলো জিইয়ে রাখতে গিয়ে যথাসময়ে সরকারের বড় বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসতে দিচ্ছে না।
বড় বড় প্রকল্প আসছে না কেন?
ভাড়াভিত্তিক রেন্টাল আর কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো জিইয়ে রাখতে বিলম্বিত করা হচ্ছে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকার ২ হাজার ৩শ’ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৬টি বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা জোগাড় করতে পারছে না, অথচ প্রতিবছর রেন্টাল আর কুইক রেন্টাল খাতে ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে ৭-৮ হাজার কোটি টাকা। জানা গেছে বড় পুকুরিয়া ২৫০ মেগাওয়াট, ঘোড়াশাল ৩০০-৪৫০ মেগাওয়াট, বিবিয়ানা ৪৫০ মেগাওয়াট, শাহজীবাজার ৩০০ মেগাওয়াট, আশুগঞ্জ ৪৫০ মেগাওয়াট এবং সিরাজগঞ্জ ৪৫০ মেগাওয়োট বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালকে লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে নির্ধারণ করলেও এখনো কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
ওপরে তথ্য ও পরিসংখ্যানসহ যা আলোচনা করা হলো তারপর আর বেশী করে কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। আজ সবচেয়ে বড় যেটি প্রশ্ন সেটি হলো, সাড়ে সাত বছর পরেও জনগণ কেন ৬-৭ ঘণ্টা লোডশেডিং পোহাবে?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন