স্টাফ রিপোর্টার : আবারও রাজউকের উচ্ছেদ অভিযান নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। প্রভাবশালীদের তদবিরে এবং গত দুইদিন ধরে অভিযান বন্ধ থাকায় এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শুধু তাই নয়, আবারও অতীতের মতো রাজউক উচ্ছেদ করার পরই অবৈধ স্থাপনাগুলো পুনরায় গড়ে তোলা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ বলছেন, নানা ধরনের তদবির এবং প্রভাবশালীদের অবৈধ হস্তক্ষেপে রাজউকের এ প্রশংসনী উদ্যোগ থমকে গেছে। অবশ্য রাজউক বলছে, আবার অভিযান শুরু হবে। তবে তা কতটা বাস্তবায়ন হবে এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। নগরবাসী বলছেন, অবৈধ স্থাপনার কারণে রাজধানীর অভিজাত এলাকার আবাসিক এলাকাসহ পুরো মহানগরী একটি বস্তিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে রাজউকে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার দাবি জনিয়েছেন তারা। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের পরেই আবার সেখানে দখলদারদের তৎপরতা দেখে এ অভিযানের ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।
উচ্ছেদ হওয়া জায়গাগুলো আবার দখল হয়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) মো. আসমাউল হোসেন বলেন, ‘কোনো অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের পর তা পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে আমাদের কিছুটা ঘাটতি আছে। ইমারত পরিদর্শকের স্বল্পতা-এর একটি কারণ। তবে চলমান অভিযানে আগে উচ্ছেদ হওয়া স্থাপনাগুলোর ব্যাপারেও নজর রাখার বিষয়ে নির্দেশ দেওয়া আছে। তিনি বলেন, মানবিক দিক বিবেচনায় অনেক ভবন মালিককে স্থাপনা সরিয়ে নেওয়ার জন্য সময় দেওয়া হলেও পরে তারা সেটা করেন না। তাই এবার অভিযানের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করা হবে। কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না।
১৮ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া বিশেষ উচ্ছেদ অভিযানের জন্য আটটি জোনে সাড়ে তিন হাজারের বেশি ভবন চিহ্নিত করেছে রাজউক। এর মধ্যে গত সোমবার শেষ হওয়া প্রথম পর্বের অভিযানে দুই শ’র বেশি ভবনে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে।
এদিকে অভিযোগ উঠেছে, বড় ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই ঢিলেঢালা ভাবে অভিযান চালানো হয়েছে। এই অভিযানে আদৌ সফলতা আসবে কিনা, সেটা নিয়ে সন্দিহান খোদ রাজউকেরই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তারা জানান, রাজধানীর ৪০ ভাগ বাণিজ্যিক ও আবাসিক বহুতল ভবনে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই। এর মধ্যে এলাকা হিসেবে মতিঝিলের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। সেখানকার ৯০ ভাগ ভবনেরই নিজস্ব পার্কিং লট নেই। এ ছাড়াও ঢাকা শহরের প্রধান সড়ক সংলগ্ন আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনের অধিকাংশ গাড়ি পার্কিং লট ব্যবহৃত হচ্ছে ভিন্ন কাজে। এতে কেউ দোকানপাট গড়ে তুলেছেন। কেউ আবার রীতিমতো পজিশন বিক্রি করে শিল্পকারখানা কিংবা গোডাউন ভাড়া দিয়েছেন। অনেকে আবার ওই অংশে ঘর তুলে বসবাস করছেন। অথচ এতদিন কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে ন্যূনতম নোটিশ জারিরও কোনো নজির নেই। তাই হঠাৎ করে অগোছালো অভিযানে সফলতার চেয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কাই বেশি।
রাজধানীর ব্যস্ততম সড়ক-সংলগ্ন ফুটপাতসহ বিভিন্ন জায়গায় গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জোরদার অভিযান শুরু হতে না হতেই দখলদাররা নানামুখী দৌড়ঝাঁপে নেমেছে। অবৈধ সুবিধাভোগী এই চক্র নানা অপকৌশলে হকারসহ নিম্ন আয়ের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ছিন্নমূল মানুষকে উসকে দিয়ে এই তৎপরতা রোধ করতে চাইছে। তারা উল্টা-সোজা বুঝিয়ে মন্ত্রী-এমপিদের দিয়ে এ ব্যাপারে সরকারের কাছে জোরালো তদবির-সুপারিশ করানোরও চেষ্টা চালাচ্ছে। অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ ও দখলবাজির অধিকাংশ ঘটনার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতারা জড়িত থাকায় এরই মধ্যে তারা এগিয়েও গেছে বলে চাউর রয়েছে। তাই রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সিটি করপোরেশন এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের উচ্ছেদ অভিযান শেষ পর্যন্ত ‘হালে পানি’ পাবে কিনা, সেটা নিয়ে নগরবাসী সংশয়ে রয়েছেন। তাদের আশঙ্কা, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে রাজউক ঢাকঢোল পিটিয়ে মাঠে নামলেও কয়েকদিন না যেতেই প্রভাবশালীদের দাপটে তারা সেটা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়াও রাজউকের একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী অবৈধ দখলদারদের নানা কৌশলে ‘ফাঁক’ তৈরি করে দিবে। বরাবরের মতো তারা ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা অন্যান্য লোকবল সংকটের অজুহাতে ধীর গতিতে কার্যক্রম পরিচালনা করে এই অভিযানের মূল টার্গেটও বদলে দিতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন অনেকেই।
অন্যদিকে উচ্ছেদকারীদের পুনর্বাসনের নামে নতুন নতুন এলাকায় অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠার আশঙ্কা করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
জানা যায়, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মতে গুলশান, বনানী, বারিধারা ও মহাখালী এলাকার ভবনে অবৈধভাবে বাণিজ্যিক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ভবন মালিক ও ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয় রাজউক। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে উচ্ছেদ অভিযান ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় সহায়তার জন্য পাঁচজন মহিলা সদস্যসহ এক প্লাটুন পুলিশ চেয়ে গত ১৩ জানুয়ারি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারকে চিঠি দেন রাজউকের পরিচালক (শোসন) দুলাল কৃষ্ণ সাহা। চিঠির তথ্য অনুযায়ী, ১৮ ও ১৯ জানুয়ারি গুলশান শুটিং ক্লাব থেকে গুলশান-১ নম্বর পর্যন্ত ২০ ও ২১ জানুয়ারি গুলশান-১ নম্বর থেকে গুলশান-২ নম্বর পর্যন্ত, ২৪ ও ২৫ জানুয়ারি গুলশান-২ নম্বর চত্বর থেকে উত্তর পাশসহ আশপাশের এলাকায়, ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা, ১ ও ২ ফেব্রুয়ারি বারিধারা হাউজিং সোসাইটি, ৩ ও ৪ ফেব্রুয়ারি মহাখালী-গুলশান লিংক রোডের রাস্তার উভয় পাশে অভিযান চালানো হবে। কিন্ত রহস্যজনক কারণে গত দুইদিন ধরে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হচ্ছে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজউকের সহকারী পরিচালক পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘ফুটপাতের দখলদার থেকে শুরু করে অবৈধ বহুতল ভবন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি, পার্কিং ভেঙে দোকানপাট গড়ে তোলা বাড়ির মালিক তারা সবাই চলেন পলিটিক্যাল পাওয়ারে’। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে গেলেই চাকরির গোড়ায় টান পড়ে। তাই সবাই এসব ব্যাপারে চোখ বুঁজে থেকে বাড়তি ফায়দা লোটার ধান্ধা খোঁজে।’ তাই সরাসরি সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়া শুধু এক-দুই সপ্তাহের উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে কোনো লাভ হবে না বলে মন্তব্য করেন রাজউকের ওই দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় রাজউকের অনুমোদনবিহীন অবৈধ ভবনই রয়েছে ৪ হাজার ৯৭টি। এই তালিকায় প্রভাবশালী আবাসন প্রতিষ্ঠানেরও একাধিক ভবন রয়েছে। রয়েছে একাধিক সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবনও। প্রায় অর্ধ যুগেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে ছোটখাটো ত্রুটির জন্য অনেক ভবনের বিরুদ্ধে নানা সময় অভিযান চালিয়েছে রাজউক। যদিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দাবি, জনবল সঙ্কট ও মামলার কারণে তারা বড় স্থাপনার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
প্রশাসনের একাধিক সূত্র জানায়, রাজউক, সিটি করপোরেশন এবং স্থানীয় সরকার বিভাগ যাতে উচ্ছেদ অভিযান ধারাবাহিকভাবে চালাতে না পারে এজন্য সংঘবদ্ধ দখলদারচক্র নানাভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তারা এরই মধ্যে বেশ কয়েক জায়গায় টোকাই ও ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের দিয়ে উচ্ছেদ অভিযানে বাধাও দিয়েছে। পাশাপাশি এই চক্র হকারদের আন্দোলনে নামানোর জন্য উসকে দিচ্ছে। তাই কিছুটা আটঘাট বাধতেই অভিযান ধীর তালে চালানো হচ্ছে বলে দাবি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের।
জানা গেছে, রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্তাকর্তাদের ম্যানেজ করেই অধিকাংশ বাড়ির মালিক বহুতল ভবনের গ্যারেজ ভেঙে দোকানপাট গড়ে তুলেছেন। তাদের কাছ থেকে রাজউকের একাধিক কর্মকর্তা মোটা অংকের মাসোহারাও নিচ্ছেন। উচ্ছেদ অভিযান শেষ হতে না হতেই সেটা পুনর্দখলের বিস্তর নজির দেখা গেছে কাওরানবাজার, মিরপুর, সবুজবাগ, ধানমন্ডি, কলাবাগান, লালমাটিয়া, মোহাম্মদপুর, গুলশান, বারিধারা, বনানী, মহাখালী এবং উত্তরার বিভিন্ন অংশে। অভিযোগ রয়েছে, রাজউক ও সিটি করপোরেশনের উচ্ছেদ অভিযান শেষ হওয়ার পর ওইসব এলাকায় তাদের পক্ষে উৎকোচ গ্রহণের জন্য একাধিক ‘লাইনম্যান’ তৈরি হয়েছে। তারা কারো কাছ থেকে সপ্তাহান্তে, আবার কারো কাছ থেকে দৈনন্দিন ভিত্তিতে অর্থ আদায় করছে। আর স্থায়ী দোকানিরা উৎকোচ দিচ্ছেন মাস চুক্তিতে। যদিও রাজউক এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
রাজউকের কর্মকর্তারা বলছেন, এক্ষেত্রে উচ্ছেদ-পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে সংশ্লিষ্ট এলাকার অথোরাইজড অফিসার ও ইমারত পরিদর্শকদের তৎপরতায় ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়া ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অর্থের বিনিময়ে তাদের ‘ম্যানেজ’ করার অভিযোগও রয়েছে।
১৮ জানুয়ারি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে রাজধানীর ধানমন্ডি, গুলশান ও উত্তরায় ভবনের বেসমেন্ট (ভূতল) ও ফুটপাত থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে একযোগে অভিযান শুরু করে রাজউকের তিনটি বিশেষ দল। অভিযানের তৃতীয় দিনে (২০ জানুয়ারি) ধানমন্ডির চিলিস নামের একটি রেস্তোরাঁর বেসমেন্টে গড়ে ওঠা একটি অফিস কক্ষ, গুদাম ও ভবনের সামনের অংশ থেকে দোতলায় উঠার একটি সিঁড়ি ভেঙে দেওয়া হয়। তার পরের দিনই ওই রেস্তোরাঁর ভেঙে দেওয়া সিঁড়িটি সংস্কার করা হয়েছে। বেসমেন্টের যে অংশে গুদাম ছিল, সেখানে কয়েকটি গাড়ি পার্ক করা রয়েছে। আর অফিস কক্ষের জায়গাটিই এখন গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ওই অভিযান পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রাজউকের জোন-৫-এর অথোরাইজড অফিসার এ জেড এম শফিউল হান্নান। তিনি বলেন, ‘অন্যান্য সময়ে অল্প কয়েক দিনের জন্য অভিযান চলে। যে কারণে উচ্ছেদ হওয়া জায়গা আবার দখল হলেও আমাদের কিছু করার থাকে না। কিন্তু এ দফায় যে অভিযানটি পরিচালিত হচ্ছে সেটা দীর্ঘমেয়াদি। তাই এবার আমরা বিষয়টির দিকে আলাদা নজর দেব।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন