রফিকুল ইসলাম সেলিম : রমজানের আগেই ভোগ্যপণ্যের বাজারে উত্তাপ বাড়ছে। বিশেষ করে রমজান মাসে সর্বোচ্চ চাহিদার পণ্যসামগ্রীর দাম আকাশ ছুঁয়েছে। ছোলা, চিনি, ডাল, রসুনের দাম বাড়ছে ঘণ্টায় ঘণ্টায়। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যসব পণ্যের দামও।
সরকারী হিসাবে গত কয়েক মাসে চাহিদার চেয়ে বেশি পণ্য আমদানি হয়েছে। দেশের আড়ত, গুদাম, পাইকারি বাজার কোথাও কোন পণ্যের সংকট নেই। পণ্য পরিবহনেও নেই কোন ঝামেলা। জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে দেয়ায় পরিবহন ভাড়াও কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বেশির ভাগ পণ্যের দরপতন হয়েছে। এরপরও হঠাৎ করে কেন বাজারে আগুন তার জবাব মিলছে না।
খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারেরা দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অধিক মুনাফা করছে তারা। আমরা কেনা দাম থেকে সামান্য লাভ করেই পণ্য বিক্রি করছি। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, গত এক সপ্তাহে বেশ কয়েকটি ভোগ্যপণ্যের দাম দশ থেকে পঞ্চাশ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এর নেপথ্যে রয়েছে অসৎ ব্যবসায়ী-মজুদদার সিন্ডিকেটের কারসাজি।
রমজান ঘনিয়ে আসায় সাধারণ ভোক্তাদের পকেট কাটতে এ সিন্ডিকেট আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। দ্রুত সিন্ডিকেটের লাগাম টেনে ধরা না গেলে রমজানে নিত্যপণ্যের দাম সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
পবিত্র রমজানের বাকি আর কয়েক দিন। এর মধ্যেই বাজারে আগুন লেগেছে। বিশেষ করে রোজার মাসে সর্বোচ্চ চাহিদার পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। চিনি, ছোলা, ডাল, সয়াবিন তেল, রসুন থেকে শুরু করে সবপণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। এসব পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। গতকাল (বৃহস্পতিবার) নগরীর বাজারগুলোতে ছোলার দাম ছিল কেজি প্রতি ৯০ টাকা। নিম্নমানের ছোলা বিক্রি হয়েছে ৮৫ টাকায়। অথচ এক সপ্তাহ আগেও ছোলার দাম ছিল সর্বোচ্চ ৭০ থেকে ৭৫ টাকা।
সয়াবিন প্রতি লিটার (প্যাকেট) বিক্রি হয়েছে ৯০ টাকা। আর খোলা সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ৮৫ টাকা। পাম অয়েলের দামও বেড়েছে কেজিপ্রতি ৫ থেকে ৭ টাকা। ব্যবসায়ীরা জানান, এক সপ্তাহের ব্যবধানে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে তিন টাকা। মশুরের ডাল বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ টাকা কেজি। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, তারা পাইকারদের কাছ থেকে প্রতিকেজি ১৩৮ টাকায় কিনছেন। বিক্রি করছেন ১৪৫ টাকা। একটু মোটা মশুরের ডাল বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১১৫ টাকা।
রমজান মাসে বেশি চাহিদার খেসারীর ডালের দামও ঊর্ধ্বমুখী। এক সপ্তাহ আগে কেজি প্রতি খেসারীর ডালের দাম ছিল ৬৯ টাকা। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকায়। এক মাস আগে কেজি প্রতি দাম ছিল ৪৮ টাকা। মটর ডালের দাম এখন ৪৫ থেকে ৪৬ টাকা। এক সপ্তাহ আগেও কেজি প্রতি দাম ছিল ৩৬ টাকা। রোজা সামনে রেখে এক লাফে দাম বেড়েছে দশ টাকা। ছোলার সাথে পাল্লা দিয়ে চনার ডালের দামও আকাশ ছুঁয়েছে। প্রতিকেজি চনার ডাল বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা। এক সপ্তাহ আগেও দাম ছিল ৭০ টাকা।
রমজান মাসে সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে চিনির। চিনির দামও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দুই মাস আগেও চিনির দাম ছিল কেজি প্রতি ৩৮ টাকা। এখন চিনি বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৫৬ থেকে ৫৮ টাকায়। আমদানিকারক ও মিল মালিকেরা মিলে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়িয়েছে বলে অভিযোগ খুচরা ব্যবসায়ীদের।
রসুনের দামে আগুন লেগেছে অনেক আগে। এই পণ্যের দাম বাড়ছে ঘণ্টায় ঘণ্টায়। গতকাল চট্টগ্রামের বাজার প্রতিকেজি রসুন (চীনা) বিক্রি হয়েছে ২৪০ টাকায়। আর দেশি রসুনের দাম ছিল ১৪০ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দশদিন আগে প্রতিকেজি রসুন বিক্রি হয়েছে ১৮০ টাকায়। হঠাৎ করে পাইকারেরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়িয়ে দেয়। অথচ পর্যাপ্ত রসুন আমদানি হয়েছে, দেশেও ভাল উৎপাদন হয়েছে। পেঁয়াজের দাম কিছুটা নাগালের মধ্যে থাকলেও দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠেছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস, চাক্তাই খাতুনগঞ্জ কেন্দ্রিক আমদানিকারক, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দেশে চাহিদার চেয়ে বেশি ভোগ্যপণ্য আমদানি হয়েছে। দেশে কোন পণ্যের কোন ঘাটতি নেই। এরপরও প্রতিদিন কোন না কোন নিত্যপণ্যের দাম কমবেশি বেড়েই চলেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর ও বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে হরেক পণ্যের আমদানি ও মজুদ বর্তমানে পর্যাপ্ত। অথচ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এমনকি আন্তর্জাতিক বাজারে এখন অনেক নিত্যপণ্যের দর নিম্নমুখী কিংবা স্থিতিশীল এবং আমদানির পর্যায়ে শুল্ককর হ্রাস, ইতোমধ্যে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস করা হলেও ক্রেতা সাধারণ এর সুফল থেকে বঞ্চিত।
রোজাকে পুঁজি করে ক্রেতাসাধারণের পকেট কেটে শত শত কোটি টাকা নির্ঘাত হাতিয়ে নেয়ার টার্গেট নিয়ে সমগ্র বাজারব্যবস্থা কব্জা করতে উঠেপড়ে লেগেছে অতিমুনাফালোভী চক্রটি। রোজার মাসে যেসব নিত্য ও ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেশিই হয়ে থাকেÑ চিনি, ছোলা, পেঁয়াজ-রসুন, আদা, ডালের মতো অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমাগতভাবেই। পাইকারি বাজারের সাথে পাল্লা দিয়ে খুচরা পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধি আরও লাগামহীন। এ অবস্থায় বিশেষত সীমিত আয়ের মধ্য ও নিম্নবিত্তের ক্রেতারা বাজার সিন্ডিকেটের জিম্মিদশায় এবং অগ্নিমূল্যের কারণে নেহায়েৎ অসহায় হয়ে পড়েছেন। কিন্তু অগ্নিমূল্যের লাগাম টেনে ধরার ক্ষেত্রে প্রশাসনযন্ত্র নির্বিকার।
বন্দর-শিপিং সূত্রে জানা গেছে, চাহিদার তুলনায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী পর্যাপ্ত হারে আমদানি করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে ও বহির্নোঙ্গরে গতকাল পর্যন্তও ছিল নিত্যপণ্য বোঝাই ১২টি জাহাজ। বন্দরের জেটি-বার্থ, ইয়ার্ড-শেডে পণ্য খালাসের ব্যস্ততা। এ সপ্তাহে বহির্নোঙ্গরে আসার কথা আরও ১০টি নিত্যপণ্যবাহী জাহাজ। অনুরূপভাবে দেশের প্রধান পাইকারি ও ইন্ডেন্টিং ব্যবসায়কেন্দ্র ‘সওদাগরী পাড়া’ চাক্তাই খাতুনগঞ্জ, মাঝিরঘাট, রেয়াজুদ্দিন বাজারে রয়েছে লেনদেনের কর্মব্যস্ততা, ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের জটলা ও পণ্য লোডিং-আনলোডিংয়ের তাড়া। কোথাও নিত্যপণ্য ঘাটতির আলামত চোখে পড়ে না।
সরকারি তথ্যমতে, দেশে ছোলার চাহিদা আছে ৬০ হাজার টনের। এর মধ্যে ৫০ হাজার টন প্রয়োজন হয় শুধু রমজানে। গত নয় মাসে ছোলাসহ ডাল আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার টন। চিনির অভ্যন্তরীণ চাহিদা ১২ থেকে ১৪ লাখ টন। গত ৯ মাসে আমদানি হয়েছে ১২ লাখ ২১ হাজার টন। দেশের চিনি কলগুলোতে প্রচুর চিনি রয়েছে। রমজান মাসেই প্রায় দেড় লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানায়, দু’টি বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের কারসাজিতেই বাজারে দাম বাড়ছে। এছাড়া দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা ১৫ লাখ মেট্রিক টন। গত নয় মাসে আমদানি হয়েছে ১৭ লাখ টন। এভাবে চাহিদার চেয়ে আমদানি বেশি হলেও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মূল্য বাড়ানোর প্রতিযোগিতা চলছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দর নিম্নমুখী হলেও দেশের পাইকারি বা খুচরা বাজারে তার কোন প্রভাব দেখা যাচ্ছে না দীর্ঘদিন ধরে। ভোজ্যতেলের দাম আকাশচুম্বি। সেই দর আর যৌক্তিকভাবে স্থিতিশীল হয় না। জানা যায়, বর্তমানে পাম, সয়াবিনসহ ভোজ্যতেল মজুদ রয়েছে সোয়া ৩ লাখ মেট্রিক টনের মতো। সাধারণত প্রতিমাসে দেশে ৮৫ হাজার মেট্রিক টন ভোজ্যতেলের চাহিদা হলেও রমজান মাসে প্রয়োজন ১ লাখ ৬০ হাজার টন। ভোজ্যতেলের পর্যাপ্ত যোগান সত্ত্বেও দাম কমছে না। বরং রমজান সামনে রেখে সয়াবিন ও পামতেলের দাম আরও বাড়ানোর কারসাজি চলছে।
চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে ছোলার দাম বেড়ে যাওয়ায় বাজারে দাম কিছুটা বেড়েছে। রোজার আগে প্রতিবছর ভোগ্যপণ্যের দাম কিছুটা বেড়ে যায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভোক্তাদের উচিত একসাথে বেশি করে পণ্য না কিনে পরিমিতভাবে ভোগ্যপণ্য ক্রয় করা। এতে করে বাজারে প্যানিক সৃষ্টি হবে না। খুব শিগ্গির পণ্যমূল্য নিম্নমুখী হবে বলেও জানান তিনি। সিন্ডিকেট করে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানোর বিষয়টি অস্বীকার করে খাতুনগঞ্জ ট্রেড এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ছগির আহমদ বলেন, মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে সিন্ডিকেট করার সুযোগ নেই। ভোগ্যপণ্য শুধু চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে নয় বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়েও আমদানি হচ্ছে। ফলে কোন একটি গোষ্ঠীর পক্ষে কারসাজি করা সম্ভব নয়। চিনির মূল্যবৃদ্ধির জন্য আমদানিকারক নয়, মিল মালিকরা দায়ী বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে ব্যবসায়ীদের সাথে এক সভায় বুধবার প্রশাসনের কর্মকর্তারা বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে ভোক্তাদের দাবি বাজার তদারকি এখন থেকেই জোরদার করা না হলে রোজার আগে পণ্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন