স্টাফ রিপোর্টার : পশ্চিম মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত গভীর নিম্নচাপটি আরও উত্তরদিকে অগ্রসর ও ঘনীভূত হয়ে ঘূর্ণিঝড় রোয়ান’তে-এ রূপ নিয়েছে। এটি বর্তমানে একই এলাকায় অবস্থান করছে। যা আরও ঘনীভূত হয়ে উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হতে পারে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দেশের সমুদ্র বন্দরগুলোকে ৪ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
রোয়ানুর কারণে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা এবং ট্রলারকে উপকূলের কাছাকাছি থাকতে বলা হয়েছে, যাতে তারা স্বল্প সময়ের নির্দেশে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারে। সেই সঙ্গে তাদের গভীর সাগরে বিচরণ না করতে বলা হয়েছে।
আবহাওয়ার বুলেটিনে বলা হয়েছে, পশ্চিম মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে একই এলাকায় অবস্থান করছে।
এটি বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ১ হাজার ৩৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ১ হাজার ৩৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ১ হাজার ১৮৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ১ হাজার ২১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি আরও ঘনীভূত হয়ে উত্তর-উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে পারে।
ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর খুবই উত্তাল রয়েছে বলেও বিশেষ বুলেটিনে জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের সর্বশেষ পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ী দমকা/ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে।
এদিকে নিম্নচাপের প্রভাবে গত দু’দিন ধরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিপাতের খবর পাওয়া গেছে।
নাছিম উল আলম
বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’র প্রভাবে দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের উপকূলীয় এলাকার আবহাওয়ায় গতকাল ব্যাপক পরিবর্তন সৃষ্টি হয়। গতকাল সকাল ১০টার পর থেকে উপকূলীয় এলাকাসহ দক্ষিণাঞ্চলের সবগুলো জেলাতেই ১০-১২ কিলোমিটার বেগের বাতাসের সাথে বৃষ্টিপাতে জনজবীন অনেকটা সিক্ত হলেও উপকূলীয় এলাকার মানুষের মধ্যে এ ঝড় নিয়ে কিছুটা শংকাও সৃষ্টি হয়েছে। সাগর কিছুটা অশান্ত রয়েছে।
তবে গতকাল রাত ৯টা পর্যন্ত বরিশাল-ঢাকাসহ সার্বিক নৌযোগাযোগ প্রায় স্বাভাবিক ছিল। আকাশ পথেও কোন সমস্যা হয়নি। গতকাল বরিশাল বিমান বন্দরে সরকারী-বেসরকারী ৩টি এয়ারলাইনে বিপুলসংখ্যক যাত্রী যাতায়াত করেছে। আবহাওয়া বিভাগ থেকে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ আরও ঘনীভূত হয়ে উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হবার কথা বলা হয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতর ‘রোয়ানু’র সম্ভাব্য গতিপথ হিসেব দেশের দক্ষিণ উপকূলীয় এলাকার কাছ দিয়ে মায়ানমার উপকূল অতিক্রম করার কথাও বলা হয়েছে। গতকাল দুপুর ১২টায় ঝড়টি বরিশালের পায়রা সমুদ্র বন্দর থেকে ১,২১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থানের কথা বলা হলেও সকাল ১০টার পর থেকেই দক্ষিণাঞ্চলসহ গোটা উপকূলীয় এলাকায়ই বৃষ্টিপাত শুরু হয়। গতকাল সন্ধা ৬টা পর্যন্ত বরিশালে বৃষ্টিúাত রেকর্ড করা হয়েছে প্রায় ২৭ মিলিমিটার। সন্ধা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত সমগ্র উপকূলীয় এলাকায় হালকা থেকে মাঝারী বৃষ্টি অব্যাহত ছিল। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট এ গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে গতকাল সকাল ১০টা থেকে আগামী শনিবার সকাল পর্যন্ত বরিশাল ও খুলনাসহ সমগ্র উপকূলীয় এলাকায় ভারী থেকে অতি ভারীবর্ষণের আশংকার কথা জানিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ।
ঘূর্ণিঝড়টি আরও ঘনীভূত হয়ে উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হবার কথা জানিয়ে পায়রাসহ সবকটি সমুদ্র বন্দরকে ৪ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের সবকটি নদী বন্দরে ২নম্বর সতর্ক সংকেত জারীর ফলে অনধিক ৬৫ ফুট দৈর্ঘের সব যাত্রীবাহী নৌযানের চলাচলও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারসমূহকে উপকূলের কাছাকাছি থাকতে বলা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’তে ভর করে গতকাল সকালের পর থেকে দক্ষিণাঞ্চলে যে মাঝারী বর্ষণ হয়েছে তা জনজীবনের জন্য যথেষ্ঠ আশীর্বাদ রয়েছে এখনো। তবে ঝড়টি যদি বাস্তবেই দেশের দক্ষিণ উপকূলে আছড়ে পরে বা উপকূলের কাছ ঘেষে মায়নমার উপকূলে চলে যায়, তবে অতিবর্ষণে জনজীবন বিপর্যস্ত হবার পাশাপাশি সব ধরনের ফসলের জন্যও এতদিনের অনাবৃষ্টির মত বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
আবহাওয়া বিভাগের পূর্বাভাসে বরিশাল বিভাগসহ উপকূলীয় এলাকাসহ দেশের অধিকাংশ এলাকাতেই অস্থায়ী দমকা বা ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়ে কোন কোন এলাকায় ভারী থেকে অতি ভারীবর্ষণের সম্ভবনার কথাও বলা হয়েছে।
বহির্নোঙরে পণ্য খালাস বন্ধ
চট্টগ্রাম ব্যুরো
চট্টগ্রাম বন্দরসহ দেশের চারটি সমুদ্র বন্দরকে চার নং দূরবর্তী সতর্কতা সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। সাগর উত্তাল হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে। গতকাল (বৃহস্পতিবার) বিকেল থেকে সেখানে অপেক্ষমান মাদার ভেসেল (বড় জাহাজ) থেকে আমদানি পণ্য খালাস বন্ধ করে দেয়া হয়। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে গতকাল দিনভর থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হয়েছে।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস জানায়, বঙ্গোপসাগর এলাকায় একটি গভীর নিন্মচাপ অবস্থান করছে। নিম্নচাপটি আরো শক্তিশালী হয়ে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’তে রূপ নিয়েছে। ঘূর্ণিঝড়টি আরো ঘনীভূত হয়ে উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ঘূর্ণীঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ৬২ কিলোমিটার যা দমকা ও ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছে। এ মাসের গোড়ার দিকে আবহাওয়া বিভাগের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে চলতি মাসে বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভবনার কথা জানিয়েছিল।
মংলা বন্দরে পণ্য ওঠানামা বন্ধ
বাগেরহাট জেলা সংবাদদাতা
মংলা বন্দরে অবস্থানরত সব জাহাজের পণ্য বোঝাই-খালাস ও পরিবহন কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। বন্দরে অবস্থানরত সকল দেশী-বিদেশী বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে নিরাপদে সতর্কতাবস্থায় রাখার নির্দেশ দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ও ঘূর্ণিঝড় মনিটরিংয়ের জন্য মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি কন্ট্রোল রুম খুলেছে।
এদিকে নৌবাহিনীর বিএনএস মংলা নৌঘাটির সকল যুদ্ধ জাহাজসহ কোস্টগার্ডের অন্যান্য নৌযানগুলোকে নিরাপদ স্থানে নোঙ্গর করে রাখা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় বাগেরহাটের মংলা, রামপাল, শরণখোলা ও মেড়েলগঞ্জ উপজেলায় সকল ধরণের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসন। সতর্কতা সংকেত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উপজেলাগুলোর সকল আশ্রয় কেন্দ্র ও বহুতল ভবন বিশিষ্ট সরকারী-বেসরকারী ভবন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বাগেরহাটের উপকূলীয় এলাকাজুড়ে বাতাসের তীব্রতাও বেড়ে চলেছে। এরইমধ্যে দুপুর থেকেই বৃষ্টি শুরু হওয়ায় সাধারন মানুষের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় আতংঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, নিম্নচাপটি মংলা সমুদ্র বন্দর থেকে ১১শ ৮৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছে।
নি¤œচাপের কারণে মংলা বন্দরকে ৪ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অফিস।
মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের মেম্বর (অপারেশন) মো: আলতাফ হোসেন জানান, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর কারণে বন্দরে অবস্থানরত সকল দেশী-বিদেশী জাহাজগুলোকে নিরাপদে সতর্কতাবস্থায় রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পণ্য ওঠানামার কাজ বন্ধ রয়েছে। এছাড়া ঘূর্ণিঝড় মনিটরিংয়ের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি কন্ট্রোল রুম খুলেছে।
আতঙ্কে শরণখোলাবাসী
শরণখোলা উপজেলা সংবাদদাতা
সিডর বিধ্বস্ত উপকূলীয় বাগেরহাটের শরণখোলায় ঘূর্ণিঝড় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ঘূর্ণিঝড় ‘রুয়ানা’ বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসার খবর শুনে শরণখোলাবাসী প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। বেড়ি বাধের বাইরে বসবাসকারী ভূমিহীন পরিবারগুলো বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।
গতকাল বিকেলে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইউএনও মোহাম্মদ অতুল মন্ডলের সভাপতিত্বে এক জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় সরকারি-বেসরকারি সকল দপ্তরকে প্রস্তুত থাকার আহবান জানিয়েছেন ইউএনও।
বুধবার রাত থেকেই শরণখোলায় হালকা ঝড়ো বাতাস ও বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বাজারঘাটে মানুষের উপস্থিতি কমে গেছে। উপজেলা সদর রায়েন্দা বাজারের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। স্থানীয় বলেশ্বর নদে প্রবল ঢেউয়ে কোনো জেলেকে নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে দেখা যায়নি। সবার মধ্যে একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে। ঝড়ের নাম শুনেই শরণখোলাবাসী ২০০৭ সালের সেই প্রলয়ঙ্করি ঘূর্ণিঝড় সিডরের দুঃসহ স্মৃতি মনে করছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ অতুল মন্ডল জানান, ঝড়ের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। ঝড়ের পূর্ব ও পরবর্তী সব ধরণের করণীয় নিধারণ করা হয়েছে। এ উপজেলায় মোট ৭৬টি সাইক্লোন শেল্টার রয়েছে। যার সবগুলোই প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন