বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

ইসলামে মানব মর্যাদা

প্রকাশের সময় : ২৪ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মু. আতাউর রহমান সরকার
॥ শেষ কিস্তি ॥
সরাসরি স্বয়ং ¯্রষ্টার সাথে ক্রয় বিক্রয়ের চুক্তি করার এই অপূর্ব সুযোগ শুধু মানুষেরই আছে।
কিতাবের ধারক ঃ
মানুষের আরেকটি মর্যাদার বিষয় হল সৃষ্টি জগতের একমাত্র এই মানুষের কাছেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কিতাব নাযিল করেছেন। এই কিতাবের সাথে সাথে প্রেরণ করেছেন দাওয়াত দানের জন্য উন্নত চরিত্র ও উন্নত আমল সম্পন্ন নবী ও রাসুলদের। যাদের কাজ মানুষকে সতর্ক করা, সুসংবাদ দান করা, ভীতি প্রদর্শন করা এবং আহ্বান করা। আল্লাহ বলেছেন- “এ কুরআন মানুষের জন্য সুস্পষ্ট প্রমাণ এবং নিশ্চিত বিশ্বাসী লোকদের জন্য পথনির্দেশ ও রহমত”। এ কুরআন শুধু মর্যাদাই নয় বরং এটি অনেক বড় একটি নিয়ামতও। যা মানুষের জন্য শুধু সম্মানই বয়ে আনে না বরং তার জন্য জবাবদিহিতাও বয়ে আনে। আর ঠিক সেই কারণে সৃষ্টি জগতের কেউ এই কিতাব গ্রহণ করতে চায়নি। শুধুমাত্র মানুষ তাকে গ্রহণ করেছে। এবং পরবর্তীতে সে মর্যাদার যোগ্যতা হারিয়ে নিজকে অক্ষম ও অকৃতজ্ঞ প্রমাণ করেছে। আল্লাহ বলেছেন-
আমি এ আমানতকে আকাশসমূহ, পৃথিবী ও পর্বতরাজির ওপর পেশ করি, তারা একে বহন করতে রাজি হয়নি এবং তা থেকে ভীত হয়ে পড়ে। কিন্তু মানুষ একে বহন করেছে, নিঃসন্দেহে সে বড় জালেম ও অজ্ঞ- সূরা আহযাব-৭২
আমি যদি এই কুরআনকে কোন পাহাড়ের ওপর নাযিল করতাম তাহলে তুমি দেখতে পেতে তা আল্লাহর ভয়ে ধসে পড়ছে এবং ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। আমি মানুষের সামনে এসব উদাহরণ এ জন্য পেশ করি যাতে তারা (নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে) ভেবে দেখে -সূরা হাশর-২১
এভাবেই মানুষ যেমন শ্রেষ্ঠ মর্যাদা লাভ করেছে ঠিক একইভাবে অতি কঠিন দায়িত্ব ও আমানতের ভার নিয়েছে। যা সঠিকভাবে সংরক্ষণ করলে মর্যাদা ও সম্মান অক্ষুণœ রাখা সম্ভব।
দুনিয়ার সকল নেয়ামতের কেন্দ্রবিন্দু:
মানুষের সহায়ক শক্তি হিসাবে আল্লাহ অসংখ্য নেয়ামতের সৃষ্টি করেছেন। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ বলেছেন- “মানুষ ধ্বংস হোক, সে কতো অকৃতজ্ঞ। তিনি তাকে কি বস্তু থেকে সৃষ্টি করেছেন? বীর্য থেকে সৃষ্টি করেছেন তাকে, অতঃপর তাকে সুপরিমিত করেছেন। অতঃপর তার পথ সহজ করেছেন, তারপর তার মৃত্যু ঘটান ও কবরস্থ করেন। এরপর যখন ইচ্ছা করবেন তখন তাকে পুনরায় জীবিত করবেন। সে কখন ও কৃতজ্ঞ হয়নি। তিনি তাকে যা আদেশ করেছেন সে তা পূর্ণ করেনি। মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ্য করুক। আমি অলৌকিকভাবে তাতে পানি বর্ষণ করেছি, তারপর আমি ভূমিকে বিদীর্ণ করেছি। যেখানে উৎপন্ন করেছি শস্য, আঙ্গুর, শাক সবজি, যয়তুন, খেজুর, ঘন ঘন বাগান, ফল ও ঘাস। তোমাদের ও তোমাদের চতুষ্পদ প্রাণীদের উপকারার্থে-সূরা আবাসা-১৭-৩২।
আরও কিছু নেয়ামতের কথা আল্লাহ্ বলেছেন-
তিনিই তো আল্লাহ যিনি তোমাদের জন্য সমুদ্রকে অনুগত করে দিয়েছেন যাতে তাঁর নির্দেশে জাহাজসমূহ সেখানে চলে আর তোমরা তাঁর অনুগ্রহ অনুসন্ধান করতে এবং কৃতজ্ঞ হতে পার-আল জাসিয়াহ-১২
ঠিক একইভাবে পশু পাখিকেও মানুষের পোষ্য অনুগত করে দিয়েছেন। এভাবে বিভিন্ন নিয়ামত শুধু মানুষের জন্যই নিদিষ্ট করে দিয়েছেন। মানুষ ছাড়া সৃষ্টি জগতের এমন কোন জীব নেই যার জন্য পৃথিবীর সব নিয়ামত কে সৃষ্টি করা হয়েছে। কাজেই এটি ইসলাম প্রদত্ত আল্লাহর পক্ষ থেকে এক অনন্য মর্যাদা।
অধিকার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে ‘হাক্কুল ইবাদ’
‘হাক্কুল ইবাদ’কে ইসলামের একটি মৌলিক শর্ত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যার মাধ্যমে ব্যক্তি হিসেবে সে দুনিয়া ও আখেরাতে মর্যাদা পেতে পারে এবং দুনিয়ার সম্মান ও অধিকার প্রাপ্তির মাধ্যমে পরিপূর্ণ হতে পারে। আল্লাহর হকের পরপরই বান্দার হককে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এমনকি কোন ব্যক্তি যদি আল্লাহর হক আদায় করে কিন্তু বান্দার হককে অগ্রাহ্য করে তাহলেও তার জান্নাত প্রাপ্তি সম্ভব নয়। আল্লাহ তার সংশ্লিষ্ট হক মাফ করেন কিন্তু বান্দার হক নষ্ট হলে তিনি মাফ করেন না। এক্ষেত্রে ব্যক্তি ব্যক্তির কাছে, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে কিছু ব্যাপারে হকদার।  
ব্যক্তি হিসেবে রাষ্ট্র মানুষের কিছু অধিকার নিশ্চিত করতে বাধ্য:
যেমন-মৌলিক অধিকার -খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
মালিকানার নিরাপত্তার অধিকার-এক্ষেত্রে প্রাণ হত্যাকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে।
সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করাকে হারাম বলা হয়েছে। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ বলেছেন-
আর তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের সম্পদ অবৈধ পদ্ধতিতে খেয়ো না এবং শাসকদের সামনেও এগুলোকে এমন কোন উদ্দেশ্যে পেশ করো না যার ফলে ইচ্ছাকৃতভাবে তোমরা অন্যের সম্পদের কিছু অংশ খাওয়ার সুযোগ পেয়ে যাও-সুরা বাকারা-১৮৮
ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ধর্ম পালনে স্বাধীনতা
প্রত্যক ধর্মের অনুসারীরাই পূর্ণ স্বাধীনতার সাথে ধর্ম পালন ও উৎসব আয়োজন করতে পারবে। এমনকি ভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা নিদিষ্ট সীমার মধ্যে থেকে তার ধর্ম পালন ও প্রচার করতে পারবে।
“যেহেতু এরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাই হে মুহাম্মাদ এখন তুমি সেই দ্বীনের দিকেই আহ্বান জানাও এবং যেভাবে তুমি আদিষ্ট হয়েছো সেভাবে দৃঢ়তার সাথে তা আঁকড়ে ধরো এবং এসব লোকের ইচ্ছা আকাংখার অনুসরণ করো না। এদের বলে দাও, “আল্লাহ যে কিতাব নাযিল করেছেন আমি তার ওপর ঈমান এনেছি। আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে যেন তোমাদের মধ্যে ইনসাফ করি। আল্লাহই আমাদেরও রব এবং তোমাদেরও রব তিনিই। আমাদের কাজকর্ম আমাদের জন্য আর তোমাদের কাজকর্ম তোমাদের জন্য। আমাদের ও তোমাদের মাঝে কোন বিবাদ নেই। একদিন আল্লাহ আমাদের সবাইকে একত্রিত করবেন। তাঁর কাছেই সবাইকে যেতে হবে।”-সূরা শূরা-১৫
মানইজ্জতের নিরাপত্তার অধিকার
এক্ষেত্রে নিন্দা, গীবত, গোয়েন্দাগিরী, অশ্লীল ভাষাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, চক্ষু সংযত রাখতে বলা হয়েছে।
ইনসাফ ও আদল পাওয়ার অধিকার
অমুসলিম বা মুসলিম প্রত্যেকেই সাথেই ন্যায়বিচার করতে হবে। সুবিচার ও সমানাধিকার দিতে হবে। আল্লাহ্ বলছেন-
হে মানবজাতি, আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। তারপর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে দিয়েছি যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার। তোমাদের মধ্যে যে অধিক পরহেজগার সে-ই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদার অধিকারী। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও সবকিছু সম্পর্কে অবহিত - সূরা হুজরাত-১৩
এছাড়া অমুসলিম ব্যক্তিকে জিম্মী হিসেবে, নাগরিক প্রতিবেশী হিসেবে এমনকি আত্মীয় হিসেবে যেটুকু ইসলাম প্রদত্ত অধিকার তা তাকে দিতে হবে।
রাষ্ট্রের পর পরিবার ও সমাজ জীবনে একজন ব্যক্তি যে অধিকার লাভ করার দাবীদার তা হল:
১. পিতা/মাতা হিসাবে সন্তানের কাছে প্রাপ্য অধিকার সম্মান ও মর্যাদা
* ভরণপোষণ * আশ্রয় ও যতœ * ভাল ব্যবহার, সদাচরণ * আনুগত্য ও ভালবাসা
২. কন্যা/পুত্র সন্তান হিসাবে বাবা-মার কাছে প্রাপ্য মর্যাদা
* ভরণপোষণ * নৈতিক, ব্যবহারিক শিক্ষা
* আনুষ্ঠানিক হক [আকীকা, বিয়েশাদী সম্পদ ও অর্থ সম্পদ সংক্রান্ত অধিকার]
৩. স্বামী-স্ত্রী
* একে অপরের প্রতি দায়িত্ববোধ * ভরণপোষণ, আনুগত্য * সন্তান ও পরিবারের দেখাশোনা * আচরণগত বিষয়ে সৌন্দর্য
৪. ভাইবোন হিসেবে
* ছোট হিসেবে ¯েœহ পাওয়া * বড় হলে সম্মান পাওয়া * পারিবারিক সম্পর্ক
৫. প্রতিবেশী /আত্মীয়স্বজন
* বিপদ-আপদে সহযোগিতা * সুসম্পর্ক
* খোঁজ রাখা। * দাওয়াত প্রদান।
একজন মানুষ প্রতিটি ক্ষেত্রে অধিকার প্রাপ্তির মাধ্যমে নিজের সম্মান ও মর্যাদা সুনিশ্চিত করতে পারে। ইসলাম মানুষের কোন সেক্টর বাদ দেয়নি। পরিবারের, সমাজের সদস্য, রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে সকল মর্যাদা তাকে দেওয়া হয়েছে। এমনকি শ্রমজীবী, পেশাজীবী বা দিনমজুর প্রত্যেকেরই অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করেছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন