বিশেষ সংবাদদাতা : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের দেয়া সুবিধা কাজে লাগিয়ে নিজেদের শিক্ষিত, স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তুলতে অভিভাবকসহ শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, মন দিয়ে লেখাপড়া করতে হবে। জ্ঞানই সব থেকে বড় সম্পদ। এই সম্পদ কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। বাড়ি-গাড়ি, টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত হারাতে পারে। কিন্তু, শিক্ষা কোনদিন হারাবে না। জ্ঞান অর্জন করতে পারলে সেই জ্ঞানই হয় শক্তি। শিক্ষার্থীদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, দেশকে ভালভাবে গড়ে তুলতে হবে। জাতির পিতা যে সোনার বাংলা গড়ার জন্য সোনার ছেলে-মেয়ে চেয়েছিলেনÑ এইতো আমার সোনার ছেলে-মেয়ে সবাই। এরাই তো দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। দেশকে উন্নত করবে, সমৃদ্ধশালী করবে।
গত রোববার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাশিক্ষার্থীদের ‘সুপ্ত প্রতিভা’ খুঁজতে জাতীয়ভাবে আয়োজিত সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দিতে ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজিত দেশব্যাপী সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ ২০১৬ এবং ২০১৫ সালের এর নির্বাচিত জাতীয় পর্যায়ের সেরা ২৪ জন মেধাবীদের হাতে এক লাখ টাকার চেক, মেডেল এবং সার্টিফিকেট তুলে দেন তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রত্যেকটি উপজেলায় একটি সরকারি স্কুল, সরকারি কলেজ আমরা করব, সেই সিদ্ধানমশ আমরা নিয়েছি এবং যেসব এলাকায় কোন সরকারি স্কুল-কলেজ নাই তারা একটা তালিকা আমরা করে ফেলেছি। পরে বিভিন্ন ইউনিয়নের জনসংখ্যা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বিবেচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়ার ইচ্ছেও আমাদের রয়েছে।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সারাদেশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যেই তাঁর সরকার কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেমন দেশের দুর্গম চরাঞ্চলে এবং পাহাড়ি অঞ্চলে বসবসকারি জনগণ রয়েছে, যেখানে যাতায়াত করা অত সহজ নয়, সেইসব জায়গাতেও আমরা শিক্ষার আলো জ্বালার পদক্ষেপ নিচ্ছি।
শিক্ষাখাতে সরকারের অর্থ ব্যয় প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটাকে কখনও আমি খরচ মনে করি না। এটা হচ্ছে একটা বিনিয়োগ। যেটা জাতির পিতাই আমাদের শিখিয়ে গেছেন।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন- মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফাহিমা খাতুন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব সোহবার হোসাইন অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা শিক্ষানীতিমালা প্রণয়ণ করেছি, সেই নীতিমালায় প্রযুক্তি শিক্ষা, আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষার ওপর যেমন গুরুত্ব দিয়েছি তেমনি ধর্ম শিক্ষাটাকেও বাধ্যতামূলক করে দিয়েছি। অর্থাৎ সার্বজনীন একটা শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি। তিনি এ প্রসঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে স্বাধীনতার পর ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করে তার রিপোর্ট বাস্তবায়নে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগের কথাও তুলে ধরেন।
জাতীয় শিক্ষানীতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৯৬ সালেই শিক্ষানীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নিলেও তা মেয়াদ চলে যাওয়ায় আর বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। তিনি বলেন, পরবর্তীতে ’৯৮ সালে ক্ষমতায় এসে তাঁরা সেই শিক্ষানীতিমালা শুধু গ্রহণই করেননি, বাস্তবায়নের প্রচেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান।
তিনি শিক্ষা সম্প্রসারণে সরকারের উদ্যোগ সম্পর্কে বলেন, আমরা বিনে পয়সায় মাধ্যমিক শ্রেণী পর্যন্ত সারাদেশে বিনামূল্যে বই দিয়ে যাচ্ছি, বৃত্তি দিচ্ছি, আগে বাবা-মা’র যেই বোঝাটা ছিল বই কেনার, এখন সেই দায়িত্ব আমরা নিচ্ছি। এটাও কিন্তু স্বাধীনতার পর জাতির পিতা প্রথম শুরু করেছিলেন। তিনি সীমিত আকারে বিনা পয়সায় বই দেয়া শুরু করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বিনামূল্যে বই বিতরণের কারণ সম্পর্কে বলেন, বই বিনামূল্যে দেয়ার ইচ্ছা এই কারণে যাতে, কোনভাবেই ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা যেন অবহেলার স্বীকার হয়ে বন্ধ না হয়ে যায়।
তিনি বলেন, দেখা যাবে যে ছেলেকে বই কিনে দেবে (অভিভাবকগণ), মেয়েকে দেবে না। ছেলে কে পড়াবে, মেয়েকে পড়াবে নাÑ এই বৈষম্যটা কিন্তু আমাদের সমাজে এক সময় ছিল। সেজন্যই আমরা বিনামূল্যে বই প্রদানের এই উদ্যোগ নেই। যদিও আল্লাহ’র রহমতে আমাদের সমাজ সেই বৈষম্যমূলক অবস্থান থেকে অনেক এগিয়ে এসেছে।
মেয়েদের শিক্ষা ইতোমধ্যেই দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও সরকার বৃত্তি প্রদানের উদ্যাগ নিয়েছে। পয়সার অভাবে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহীদের লেখাপড়া যাতে বন্ধ না হয় সেজন্য সরকারের এই উদ্যোগ।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর রাজনৈতিক অঙ্গীকার অনুযায়ী, ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে অবশ্যই সক্ষম হবেন মর্মে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, যদি কারো নিয়ত থাকেÑ হ্যাঁ এটা আমি করব, তাহলে পথও নিশ্চই খুঁজে পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, ‘সীমিত সম্পদ দিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু। কিন্তু বাংলাদেশকে এখন আর কেউ দরিদ্র বলে অবহেলার চোখে দেখতে পারে না। দুর্ভিক্ষের দেশ,দুর্যোগের দেশ বলে অবহেলা করতে পারে না।
পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের দুর্দশার চিত্র স্মরণ করে তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর আমাকে এবং ছোট বোন রেহানাকে ৬ বছর বিদেশ থেকে দেশে ফিরতে দেয়া হয়নি। কিন্তু, ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসার পর দেশের গ্রাম-গঞ্জে, আনাচে-কানাচে ঘুরে দেখেছি মানুষের হাহাকার, তাদের কষ্ট। মানুষের পেটে ভাত নেই, পরনে বন্ত্র নেই, রোগে পথ্য নেই। অথচ, এই দুঃখী মানুষগুলোর জন্যই বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলায় আপ্রাণ পরিশ্রম করছিলেন। কিন্তু, তাঁকে হত্যার পর উন্নয়নের সেই চাকাকে স্তব্ধ করে দিয়ে বাংলাদেশকে ভিক্ষুকের দেশে পরিণত করা হয়।
বৈশ্বিক মন্দার প্রেক্ষাপট স্মরণ করে দেশিয় অগ্রগতির তুলনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উন্নত অনেক দেশই যা পারে নাই। আমরা তা পেরেছি। চিকিৎসা সেবা মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দিয়েছি। আরও স্কুল-কলেজ ব্যাপকভাবে করে দিচ্ছি। বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চলগুলো দুর্গম এলাকাÑ সেখনে আবাসিক স্কুল তৈরী করে দেয়ার উদ্যোগ শুরু করেছি। চরাঞ্চল বা দ্বিপাঞ্চল-যেখানে যাতায়াত ব্যবস্থার অসুবিধা সেখানেও আমাদের উদ্দেশ্যে সরকারী স্কুল করে দেয়া এবং আবাসিক করে দেয়া যাতে শিক্ষার্থীদের কোন অসুবিধা না হয়। প্রতিদিন বড়ো বড়ো খাল-বিল, নদী-নালা পার হয়ে কষ্ট করে স্কুলে যাতায়াত করতে না হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের সকল দেশে যখন সময়ের সাথে সাথে শিক্ষার হার বাড়ে, তখন বিএনপি-জামাতের ২০০১-২০০৬ আমলে শিক্ষার হার কমে দাঁড়িয়েছিল ৪৩ শতাংশে। অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আমরা আজ দেশের শিক্ষার হার ৭১ শতাংশে উন্নীত করেছি।
প্রধানমন্ত্রী সরাদেশে ইন্টারনেট সার্ভিস চালুর সরকারী উদ্যোগ সম্পর্কে বলেন, এখন সারাদেশেই আমরা ইন্টারনেট সার্ভিস করে দিয়েছি। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণ হয়ে গেলে এই ইন্টারনেট সুবিধা আরো দ্রুতগতির হবে। যেকোন কাজের জন্য আর রাজধানীমুখী না হয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থান করেই সেসব কাজ সমাধা করা যাবে বলেও তিনি জানান।
তিনি তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগকে এই প্রজন্মের জন্য সৌভাগ্য উল্লেখ করে বলেন, আজ কালকার ছেলে-মেয়েদের তো সৌভাগ্য তারা এক জায়গায় বসে সমগ্র বিশ্বের সাথে যুক্ত হতে পারছে। প্রযুক্তির মাধ্যমে জানার বা জ্ঞানার্জনের যে সুযোগ, সেই সুযোগটা যেন আমাদের ছেলে-মেয়েরা আরো বেশি করে পেতে পারে, সেই সুযোগটা আমরা করে দিতে চাই।
বেগম পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহানের বেগমের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর শোক ঃ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপমহাদেশের নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগমের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। গতকাল সোমবার এক শোকবাণীতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার মৃত্যুতে জাতি আজ এক মহিয়সী নারীকে হারালো। উপমহাদেশের নারী জাগরণে যিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রী শোকবাণীতে মরহুমার শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান এবং তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন।
উল্লেখ্য, বেগম সম্পাদক নূরজাহান বেগমকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় গত ৫ মে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হলে তার চিকিৎসার পুরো ভার নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন