রোববার, ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতার নয়

প্রকাশের সময় : ২৫ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৩৫ পিএম, ২৪ মে, ২০১৬

শেখ জামাল : দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর হাইকোর্টের নির্দেশনা বহাল রেখেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। গতকাল রায়ের ফলে আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেওয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করতে পারবে না। কাউকে গ্রেপ্তার করার সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে। এছাড়াও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের হাতে গুম, হত্যা ও নির্যাতন বন্ধে সতর্ক করেছেন সর্বোচ্চ আদালত। পাশাপাশি পূর্ণাঙ্গ রায়ে একটি নীতিমালা ঠিক করে দেবেন বলেছেন আপিল বিভাগ। আপিলের এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন দেশের শীর্ষ স্থানীয় আইনজীবীরা। সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন বলেছেন, মনে হচ্ছে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে আমরা একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করছি। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে। আদালতের এই নির্দেশনা প্রতিপালন করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি অবশ্যই কর্তব্য বলে মনে করেন সংবিধানের আরেক প্রণেতা ব্যারিস্টার এম. আমীর উল ইসলাম। তিনি বলেন, আইনের শাসন রক্ষার জন্যই তাদের এটি করতে হবে। রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম বলেন, সাদা পোশাকে নিজেদের পরিচয় না দিয়ে পৃথিবীর কোথাও এভাবে গ্রেপ্তার করে না। এখন দেখা যাচ্ছে, একজনকে শত্রুতাবশত গায়েব করে ফেলছেন। পরিচয় দিচ্ছেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোক। আশা করি, এটা বন্ধ হবে। এদিকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা খারাপ বলে মনে করেন না আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তবে আদালত নির্দেশনা দিলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে সরকার বলে তিনি জানান। অতীতে ‘সময়ে সময়ে’ ৫৪ ধারাটি অপব্যবহার করা হয়েছে বলেও আইনমন্ত্রী জানান।
ফৌজদারি কার্যবিধির বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার (৫৪ ধারা) ও হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ধারা (১৬৭ ধারা) প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা দেওয়ার কথা জানিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল খারিজ করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ গতকাল মঙ্গলবার এই রায় দেন।
রায়ে আদালত বলেছে, “আপিল খারিজ করা হল। হাইকোর্টের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে ৫৪ ধারা ও ১৬৭ ধারার কিছু বিষয় সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ কারণে হাইকোর্ট কয়েক দফা সুপারিশ করেছে। এ বিষয়ে কিছু সংশোধনী থাকবে। আমরা একটি নীতিমালা ঠিক করে দেব।”
আদালত থেকে বেরিয়ে রিট আবেদনকারী পক্ষের অন্যতম আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, “হাইকোর্টের নির্দেশনাগুলি বহাল থাকছে। তা মানায় এক ধরনের বাধ্যবাধকতা তৈরি হল। ১৮ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটল।”
রিট আবেদনকারী পক্ষের আরেক আইনজীবী ইদ্রিসুর রহমান বলেন, “অন্য একটি মামলায় আদালত ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৩৯ এবং ৪৩৯ এ ধারা পরস্পরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে তা সংশোধনের পক্ষে রায় দিয়েছিল। কিন্তু ৩৩ বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি বলে আপলি বিভাগ দুঃখ প্রকাশ করেছে।’’
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে ড. কামাল হোসেন বলেন, “মনে হচ্ছে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে আমরা একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করছি।” তিনি বলেন, ‘এতে করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার ও ১৬৭ ধারার রিমান্ড সংক্রান্ত বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ে যে ১৫ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল সেগুলোই আপিল বিভাগ বহাল রেখেছেন। তবে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে।’
এ বিষয়ে হাইকোর্টের দেয়া ১৫ দফা নির্দেশনা আপিল বিভাগ কখনও স্থগিত করেনি। সরকারের আপিল খারিজ হওয়ায় এই সব নির্দেশনা প্রতিপালন করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি অবশ্যই কর্তব্য বলে মনে করেন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এম. আমীর উল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আইনের শাসন রক্ষার জন্যই তাদের এটি করতে হবে।’ আইন সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত এই নির্দেশনাগুলোই কার্যকর থাকবে বলে মনে করেন সিনিয়র এই আইনজীবী ।
সাদাপোশাকে কাউকে গ্রেফতার করতে হলে পুলিশের পরিচয় দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘সাদাপোশাকে নিজেদের পরিচয় না দিয়ে পৃথিবীর কোথাও এভাবে গ্রেফতার করে না। এখন দেখা যাচ্ছে, একজনকে শত্রুতাবশত গায়েব করে ফেলছেন। পরিচয় দিচ্ছেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোক। আশা করি, এটা বন্ধ হবে’। তিনি বলেন, ‘সাদাপোশাকে যারা (গ্রেফতার) করবেন, তাদের কাজ হবে আসামিকে অনুসরণ করা, গতিবিধি লক্ষ্য করা। তাকে গ্রেফতার করার ব্যাপারে নিশ্চয়ই পরিচয় দেওয়া উচিত। আমার মনে হয় না, নিজেদের পরিচয় না দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কাউকে গ্রেফতার করতে যায়। এগুলো যারা করে যাচ্ছেন, তারা নিশ্চয়ই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোক না। তারা (আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য) ইউনিফর্ম ছাড়া ডিউটিতে যান না। সাদাপোশাকের কাজ হচ্ছে, গতিবিধি ও গোয়েন্দার কাজে নিয়োজিত থাকা। যখন গ্রেফতারের প্রসঙ্গ আসবে তখন পরিচয় দেওয়ার বিষয়টা আসবে।
মাহবুবে আলম বলেন, ‘সংবিধানের কিছু অনুচ্ছেদ আছে, ৩১,৩৫ বা মানবাধিকার সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলো। আদালতের অভিমত হলো যে, আমাদের ফৌজদারি কার্যবিধি, এভিডেন্স অ্যাক্ট বা পুলিশদের কাজ করা সংক্রান্ত পিআরবি- এ সমস্ত আইনগুলো আর সংবিধান এটা পরিপন্থী হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিলেন, সে রায়টি ছিলো কিছু মন্তব্য বা কিছু রিকমান্ডেশন। সংবিধানের যে বিধি-বিধান, তার আলোকে ফৌজদারি কার্যবিধি, এভিডেন্স অ্যাক্ট ইত্যাদি এগুলোতে সংশোধনের প্রয়োজন মনে করে কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে আপিল করেন রাষ্ট্রপক্ষ। এটি আজকে খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। আপিল বিভাগ এ বিষয়ে নিজের আবার কিছু মডিফিকেশন দেবেন এবং রদবদল করবেন বলেও উল্লেখ করেছেন’। তিনি বলেন, ‘এখন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আপিল বিভাগ যে রায় দেবেন বা যে সমস্ত নির্দেশনা দেবেন, তার আলোকে আশা করি, সরকার পদক্ষেপ নেবে’।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা খারাপ বলে মনে করেন না তিনি। তবে আদালত নির্দেশনা দিলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে সরকার। ফৌজদারি কার্যবিধির বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার (৫৪ ধারা) ও হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ধারা (১৬৭ ধারা) দুটি ধারা প্রয়োগ সংক্রান্ত একটি রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল সর্বোচ্চ আদালতে খারিজ হওয়ার পর তিনি একথা বলেন। প্রয়োজনে ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করা হবে বলেও জানান মন্ত্রী। ৫৪ ধারা নিয়ে তিনি বলেন, “আইনে কিছু কিছু ইমার্জেন্সি প্রভিশন থাকে। ফৌজদারি কার্যবিধিতে যখন ৫৪ ধারা রাখা হয়েছে, তখন সেটা ইমার্জেন্সি প্রভিশন হিসাবেই রাখা হয়েছে। এটা ভাল নাকি মন্দ, সেটা ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে। “এখন বাস্তবায়নের দিক থেকে অতিরিক্ত মাত্রায় যদি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সেই জায়গায় যদি কোনো প্রভিশন (নির্দেশনা) হয়ে থাকে, সেটা ন্যায্য। কিন্তু সেকশন ৫৪ ধারা খারাপ বলা আমার পক্ষে কঠিন।” অপব্যবহার হয়েছে কি না- এ প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, অতীতে ‘সময়ে সময়ে’ হয়তো এটা হয়েছে। তার ভাষায় ৫৪ ধারা হলো- বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার, সন্দেহ করে গ্রেপ্তার। “এখন আপনারা যদি বলেন, পুলিশ এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সক্রিয় হবে কেবল অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর, তাহলে তো হয় না। পুলিশ যদি মনে করে, কেউ একটা অপরাধ করতে যাচ্ছে, তাকে গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা পুলিশের আছে।”
মামলার বিবরণে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে বেসরকারি ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র শামীম রেজা রুবেলকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করার পর ওই বছরের ২৩ জুলাই মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশ-কার্যালয়ে তার মৃত্যু হয়। ওই ঘটনার পর বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানের নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। তদন্ত শেষে কমিটি ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের পক্ষে কয়েকটি সুপারিশ করে। সেসব সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করে। তার চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল হাই কোর্ট এ বিষয়ে কয়েকদফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেয়। রায়ে ছয় মাসের মধ্যে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার ও হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে প্রচলিত বিধি সংশোধন করার পাশাপাশি ওই ধারা সংশোধনের আগে কয়েক দফা নির্দেশনা অনুসরণ করতে বলা হয় সরকারকে। রাষ্ট্রপক্ষ ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন করলে ২০০৪ সালে তা মঞ্জুর হয়। তবে হাইকোর্টের নির্দেশনা সে সময় স্থগিত করা হয়নি। এর ধারাবাহিকতায় গত ২২ মার্চ আপিল বিভাগে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের ওপর শুনানি শুরু হয়। দুই কার্যদিবস শুনানি করে গত ১৭ মে আদালত রায়ের জন্য ২৪ মে দিন ঠিক করে দেয়। সেই অনুযায়ী গতকাল রায় দেয়া হয়।
হাইকোর্টের নির্দেশনা হলো- ক. আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেওয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করতে পারবে না। খ. কাউকে গ্রেপ্তার করার সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে। গ. গ্রেপ্তারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে কারণ জানাতে হবে। ঘ. বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেপ্তার ব্যক্তির নিকট আত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে বিষয়টি জানাতে হবে। ঙ. গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে তার পছন্দ অনুযায়ী আইনজীবী ও আত্মীয়দের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে। চ. গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে কারাগারের ভেতরে কাচের তৈরি বিশেষ কক্ষে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। ওই কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকট আত্মীয় থাকতে পারবেন। ছ. জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে। ট. পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল বোর্ড গঠন করবে। বোর্ড যদি বলে ওই ব্যক্তির ওপর নির্যাতন করা হয়েছে তাহলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা নেবেন এবং তাকে দ-বিধির ৩৩০ ধারায় অভিযুক্ত করা হবে। এসব নির্দেশনা ৬ মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছিল হাইকোর্টের সেই রায়ে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
rafiq ২৫ মে, ২০১৬, ৯:৫৬ পিএম says : 0
thanks ......
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন