স্টালিন সরকার : জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এখনো বাংলাদেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি, সমাজনীতি, প্রাত্যহিক জীবন-যাপনে প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে সার্বভৌমত্ব, জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম, জনসেবা, মানুষের মুক্তি, ভোটের অধিকার, ক্ষমতাসীনদের জুলুমবাজির বিরুদ্ধে মানুষকে জাগিয়ে তোলায় নজরুলের রচনা তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নজরুল বৃটিশরাজ কাঁপিয়েছেন। সময়ের ¯্রােতে শত বছর পর এখনো কাঁপানো সম্ভব। দেশের বিভাজিত রাজনীতি চর্চার মধ্যে নজরুলকে কেন্দ্র করে অগ্রসর হওয়ার প্রচেষ্টা হলে তার রচনাই পথ খুঁজে দেবে। কিন্তু দেশের জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দলগুলো কি সে চেষ্টা করছে? কাজী নজরুল ইসলামের ১১৭তম জন্মজয়ন্তীতে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি কি? বিশেষ করে জাতীয় কবিকে নিয়ে বিএনপির অবস্থান কোন পর্যায়ে?
রাজনীতিতে আদর্শ, নীতি, দর্শনে কিছু কিছু বিন্দু থাকে। সে বিন্দুকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় রাজনীতি। জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে দেশের স্বার্থ ও নজরুলের প্রেরণায় কিছু কিছু ইস্যু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তেমনি ইস্যু কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী ও ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। গুরুত্বপূর্ণ এ দিবস দু’টিকে ইস্যু করে যাদের সরব হওয়ার কথা তারা কার্যত ঘুমিয়েই আছেন। অথচ গুরুত্বপূর্ণ দিবস দু’টিকে ইস্যু করে দেশের রাজনীতিতে জাগরণ তোলা যায়; নিজ দলের ঘুমন্ত-নিস্তেজ-পথহারা নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত করা যায়। বিএনপির রাজনীতির পরতে পরতে নজরুলের উপস্থিতি। সেই দলটি কি সেটা করতে পেরেছে বা করার চেষ্টা করেছে?
বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের অনেক নেতার অভিযোগ সরকার বিএনপিকে রাজপথে নামতে দেয় না। মাঠের কর্মসূচি পালন করতে দেয় না। দলটিকে খ--বিখ- করার চেষ্টা করছে। দলের নেতাদের ভাগিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। মাঠে নামলে পুলিশের পিটুনী খেতে হয়। সরকার জুলুম-নির্যাতনের কথা বলার গণতান্ত্রিক স্পেস সরকার রাখেনি। যার জন্য সমাবেশ, মিটিং করতে গেলেও আগে অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু নজরুলের জন্মজয়ন্তী পালন ও ফারাক্ক দিবস পালনে কি সরকারের বাধা দেয়ার হেতু আছে? বাস্তবতা হলো যে নদীতে ¯্রােত নেই সে নদীর পানি এমনিতেই পচে যায়। মজা নদীর মাছ ¯্রােতধারা নদীতে যাওয়ার সুযোগ পেলে তা কাজে লাগাবেই। যাদের রক্তে রাজনীতির ¯্রােত সেই মানুষ নিস্তেজ হয়ে কতদিন বাঁচতে পারে?
গতকাল পালিত হলো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী। দিবসটি সরকারি পর্যায়ে এবং বিভিন্ন সংগঠন পালন করেছে। মিডিয়াগুলোও দিবসটি পালনে নানান আলোচনা, অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করে। কিন্তু বিএনপি কি দিবসটির গুরুত্ব বুঝেছে এবং দিবসটিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে? নজরুল আমাদের কবি নন কি? সরকার জুলুম-নির্যাতন করে; মিছিল-মিটিং করতে দিচ্ছে না। কিন্তু নজরুলের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আলোচনার আয়োজন করলে বাধা দেয়ার সুযোগ ছিল কি? জাতীয় কবির লেখা আমার ‘কৈফিয়ত’ কবিতার ‘প্রার্থনা করোÑযারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস/ যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ!’ বা ‘চল চল চল/ ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল/ নি¤েœ উতলা ধরণী তল/ অরুণ প্রাতের তরুণ দল/ চলরে চলরে চল।’ অথবা ‘বল বীর- বল উন্নত মম শির/ শির নেহারি আমারি নতশির ঐ শিখর হিমাদ্রির!/ ---’ বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি/ চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি/---/ উঠিয়াছে চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাত্রীর!’ অথবা ‘আমি সেই দিন হব শান্ত/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/ অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম-রণভূমে রণিবে না’ নজরুলের জন্মজয়ন্তীতে এ সব কবিতা পড়লেও সরকার কি বাধা দিত? বরং নজরুলের মঞ্চে এসব পড়া হলে জনতার গা শিউরে উঠতো। নিস্তেজ নেতা-কর্মীরা চাঙ্গা হতেন এবং তা মিডিয়ায় প্রচার হতো। সরকার এতে ম্যাসেজ পেত। মাঠের ১০টি বিক্ষোভ মিছিলের কাজ একটি আলোচনা সভায় হতো। নজরুলের কবরে ফুলের মালা দিয়েই কি নজরুলের ওপর দায়িত্ব শেষ?
১৬ মে গেল ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ১৯৭৬ সালের এ দিনে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে সারা দেশের লাখ লাখ মানুষ রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদরাসা ময়দান থেকে মরণ বাঁধ ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চে অংশগ্রহণ করেন। সেই থেকে দিনটি ফারাক্কা দিবস হিসেবে পালিত হয়। মূলত ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহারের উদ্দেশ্যে ১৯৬১ সালের ৩০ জানুয়ারি পদ্মার উজানে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। ১৯৭০ সালে শেষ হয় নির্মাণ কাজ। তখন পরীক্ষামূলকভাবে ভারত পানি ছাড়ে। ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির মাধ্যমে ফারাক্কা বাঁধ চালু হয়। আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে ভারত ১৯৭৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ফারাক্কা বাঁধের সবকটি গেট খুলে দেয়। ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত চাহিদানুযায়ী পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ। ফারাক্কার কারণে বাংলাদেশ মরুভূমি হওয়ার উপক্রম হয়েছে। দেশের কৃষকের মরণদশা। সেই ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবসকে কি তেমন গুরুত্ব দিয়েছে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দল বিএনপি? সেই ’৭৬ সালে মওলানা ভাসানী আন্তর্জাতিক মিডিয়া কাঁপিয়ে দিয়েছেন লংমার্চ করে। সেই দিবস পালনে কর্মসূচি হলে মিডিয়াগুলো কি নীরব থাকত! দেশপ্রেম আর রাজনীতি কি শুধু মাঠের সভা-সমাবেশ করা? আর ২০ দলের অন্যান্য শরিক ও ইসলামী ধারার দলগুলো কি শুধুই নীরব দর্শক!
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন