ছয়
সুতরাং এখন পরিস্কারভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে, বর্তমানে ইয়াহুদী ধর্মে যে একত্ববাদের পরিবর্তে বহু দেবদেবী এবং পূর্ববর্তী অনেক নবী-রাসূলদের তাঁরা উপাস্য হিসেবে মেনে নিয়েছে- এটা মূলত তাদের মনগড়া চিন্তারই ফলশ্রæতি। আদতে মুসা (আ)-এর আনীত প্রকৃত তাওরাতের সাথে বর্তমান তাওরাতের মিল খুব কমই পাওয়া যায়। বর্তমান তাওরাতের অনুসারীদের মধ্যে যারা ইয়াহুদী পন্ডিত নামে খ্যাত স্বয়ং তাদের সম্পর্কেই কুরআনে বলা হচ্ছে, “অধিকাংশ ইয়াহুদী আলেম, পীর, দরবেশ লোকদের ধন-সম্পদ অবৈধভাবে ভোগ করতো এবং তাদেরকে আল্লাহ্র পথ থেকে সরিয়ে রাখতো।” “সূরা ৯, আয়াত ৩৪”। ইয়াহুদীদের বাড়াবাড়ি ও পথভ্রষ্টতা সম্পর্কে কুরআনে অন্যত্র বলা হচ্ছে, ইহুদীরা বলে যে, “হযরত ওযাইর আল্লাহ্র পুত্র।” তারা হযরত মুসা (আ)-এর একত্ববাদের শিক্ষা ভুলে যেয়ে পয়গম্বরগণের প্রতি মিথ্যা আরোপ করা এবং হত্যাকান্ড করতেও কুন্ঠিত না হওয়া, অথবা তাঁদেরকে স্বয়ং আল্লাহ্ কিংবা আল্লাহ্র পুত্র বলে পরিচয় দেয়া ইহুদীদের স্বভাবে পরিণত হয়। “মুফতী মুহামম্দ শাফী, তাফসীর মা’আরেফুল কুরআন, অনুবাদ-মুহিউদ্দীন খান (মদীনা : খাদেমুল হারামাইন শরীফাইন বাদশাহ ফাহদ কুরআন মুদ্রণ প্রকল্প, ১৪১৩ হি.), পৃ. ৩৪৮”।
উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে বলেন, “তোমার প্রভু তোমার জন্যে তোমারই মধ্যে থেকে অর্থাৎ তোমারই ভাইদের মধ্যে থেকে আমার মত একজন নবীর আবির্ভাব ঘটাবেন।” এখানে তোমার প্রভু বলতে এক লা-শারীক আল্লাহ্কে বোঝানো হচ্ছে এবং একজন নবী বলতে সেই নবীকে বোঝানো হচ্ছে স্বয়ং কুরআনে যে নবী সম্পর্কে বলা হচ্ছে, যে, “মুহাম্মদ (সা) তোমাদের পুরুষদের কারো পিতা নন।” সূরা ৩৩, আয়াত-৪০”।
অতএব, এখন একথা বলা যেতে পারে যে, মূল তাওরাতের শিক্ষা ছিল একত্ববাদের দিকে, যদিও পরবর্তীতে উক্ত গ্রন্থে সেই শিক্ষাকে বিকৃত করে বহু দেববাদ ও শিরকবাদের অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে।
বিশ্বের সমগ্র মানব সমষ্টির একটা বড় অংশ হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী। বহু দেববাদে বিশ্বাসী হলেও গবেষণায় জানা গেছে যে, প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে বৈদিক যুগে মূর্তিপূজা তথা বুহু দেব-দেবীর পূজা ছিল না। “সুশান্ত ভট্ট্রাচার্য, বেদ-পূরাণো আল্লাহ্ ও হযরত মুহাম্মদ (সাঃ), নও-মুসলিম কল্যাণ সংস্থা, ঢাকা : পঞ্চম সংস্কার ১৯৯৭), পৃ.৫৮”। এমনকি পবিত্র বেদে যে ‘ব্র²’ শব্দটি রয়েছে সেই শব্দটিকে ‘একমেবাদ্বিতীয়ম ব্র²’ অর্থাৎ ব্র² এক এবং অদ্বিতীয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে। “নূর নবী, আল্লাহ্তত্ত¡ পৃ.৮” কিন্তু দুঃখের বিষয় উক্ত বেদই আবার ব্র²ের স্বরূপ বর্ণনা করতে দিয়ে দ্বিত্ববাদ, ত্রিত্ত¡বাদ, প্রকৃতিবাদ, বহুদেববাদ, সর্বেশ্বরবাদ প্রভৃতি মতবাদের জন্ম দিয়েছে। এই যদি হয় অবস্থা তাহলে প্রশ্ন জাগে আমরা যে এক, লাÑশরীক আল্লাহকে বুঝি যিনি সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী, যিনি যাবতীয় গুণাবলীর আধার পবিত্র বেদে কি সেই ধরণের গুণ প্রকাশক কোন শব্দ নেই? যে শব্দের দ্বারা এক ও লাÑশরীক আল্লাহকে বোঝাবে?
১৩৩৩ সালে কলিকাতার “বসুমতি সাহিত্য মন্দির” থেকে শ্রীযুক্ত পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায় মহাশয় কর্তৃক মুদ্রিত এবং উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় “শ্বেতাশ্বতরোনিষৎ” ঠড়ষ. ১১ নামে যে মূল্যবান গ্রন্থখানা প্রকাশিক হয়েছে সেখানে অন্যান্য বেদের সাথে “অর্থববেদ” নামে একটি গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে। এই “অথর্ব” বেদে চারখানা উপনিষৎ রয়েছে। যার মধ্যে ‘অল্লোপনিষৎ’ অন্যতম। এই ‘অল্লোপনিষৎ’Ñ ১৯-৩০ পৃ. যে মন্ত্রগুলোর উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে একটি অন্যতম মন্ত্র হলো,
“হ্রং হোতার মিন্দ্রো হোতা ইন্দ্রো রামা হাসু রিন্দ্রাঃ।
অল্লো জ্যেষ্ঠং শ্রেষ্ঠং পরমং পূর্ণং ব্রক্ষণ অল্লাম।”
এ মন্ত্রে জ্যেষ্ঠ, পরম এবং পূর্ণ সত্তা বলতে যে অসীম অনন্ত বিশ্ব প্রভুকে বুঝানো হয়েছে, তাঁর আসল নাম “অল্ল” বলে উল্লেখ করা হয়েছে। “বেদ-পুরাণো আল্লাহ ও হযরত মুহাম্মদ” নামক বই-এ দেখানো হয়েছে য, সংস্কৃত ভাষায় ‘অল্ল’. বাইবেলে ‘এল’ বা ‘এলী’ এবং কুরআনে ‘আ্ল্লাহ্’Ñ এর নামগুলো একই ধাতু মূল থেকে ব্যুৎপন্ন হয়েছে এবং একই তাৎপর্য বহন করছে এবং সেই তাৎপর্য হলো, ‘অল্ল’ ‘এল’ বা ‘এলী’ এবং ‘আল্লাহ্’ হলেন তিনি যিনি অসীম, অনন্ত বিশ্বপ্রভু এবং এই নামটি কোন সময়ে কোন মানুষ, দেব-দেবী, বস্তু বা সত্তার উদ্দেশ্য ব্যবহৃত হয়নি। “সুশান্ত ভট্টাচার্য বেদ-পূরাণে আল্লাহ্ ও হযরত মুহাম্মদ (সা.) পৃ. ৯৫”।
পবিত্র কুরআন অধ্যয়ন করলে একই সত্যের আভাস মেলে। আর সেই সত্যটি হলো, বহুদেববাদে বিশ্বাসী আরব মুশরিকরাও ‘সৃষ্টি’র ব্যাপারে এক আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন দেব-দেবীকে স্থান দিত না।” “সূরা ২৯, আয়াত ৬১, ৬৩ ; সূরা ৪৩, আয়াত ৮৭ ; সূরা ২৩, আয়াত ৮৪-৮৯”।
কিন্তু কালক্রমে হিন্দুরা প্রকৃত শিক্ষাকে ভূলে তারা বহু দেব-দেবীর পূজা-অর্চনা করতে শুরু করে।
প্রাচীন ভারতে ইতিহাস অন্তিমযুগ অন্ধকার এবং অত্যাচারে যুগ হবে বলে উল্লেখ রয়েছে। সেই অস্তিমযুগ পঞ্চম খ্রীষ্টাব্দ হতে শুরু হয়। বলা হয়ে থাকে যে, বৈদিক যুগে মূর্তি পূজা ছিল না পরবর্তীতে সেই মূর্তি পূজা শুরু হয়। যার ফলশ্রæতিতে এক আল্লাহকে কেউ কেউ মাতৃরূপী জননী ভেবে জগদ্বাত্রী, কালী, দূর্গা, ভৈরবী প্রভৃতি নামকরণ করে। এবং কল্পনায় মাটির মূর্তি তৈরি করে তাদের পূজা অর্চনা করতে থাকে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন