শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

কিশোর রিফাতের কাঠগড়ায় গণমাধ্যম

ধর্ম অবমাননার খবর প্রচার

প্রকাশের সময় : ২৭ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টালিন সরকার : ক্ষমা করো রিফাত হাসান। আমাদের রুটি-রুজির অবলম্বন গণমাধ্যমকে তুমি কাঠগড়ায় দাঁড় করে দিয়েছ। বিবেকের দংশন থেকেই তোমার প্রতি এই নিবেদন। কিশোর বয়সে তোমার মধ্যে রাষ্ট্রের চতুর্থস্তম্ভ গণমাধ্যম সম্পর্কে যে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হলো তা সর্বই সত্য নয়। মিডিয়া ভুবনে কর্পোরেট কালচার, প্রতিবেশি দাদাদের প্রতি নতজানু আনুগত্য আর তথাকথিত প্রগতিশীলতার চাদর মিডিয়ার কুশিলবরা গায়ে জড়ানোয় গোয়েবলসীয় কায়দায় তোমার কথা উল্টে দিয়ে মানুষকে মিথ্যা খবর দিয়েছে। কাউকে না কাউকে খুশি করতে ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ দিতেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। মহান আল্লাহ এবং ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করায় নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার কল্যান্দি এলাকার পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে ভাগ্যিস কান ধরে উঠবস (শিক্ষকরা গুরুজন; কোনো শিক্ষককের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ কাম্য নয়) করেছে। এমপি দাবি করেছে জনরোষ থেকে বাঁচতে এ ছাড়া উপায় ছিল না। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায় বলে মন্তব্য করেন। এ ঘটনায় যাদের বিবেক কেঁদে উঠেছে তারা মানববন্ধন করছেন; নিজেরা প্রতিকীয় প্রতিবাদে কান ধরে উঠবস করছেন। সে দৃশ্য ইলেক্ট্রোনিক্স মিডিয়াগুলোতে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। ইসলামবিদ্বেষী একজন শিক্ষককে অপমান করার প্রতিবাদে দেশের বুদ্ধিজীবী-সুশীল-সাংস্কৃতিকর্মী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীরা এভাবে ধিক্কার জানাচ্ছেন। কিছু মানুষ দীর্ঘ সময় কান ধরে উঠবস করেছেন এমন চিত্র মিডিয়ার বদৌলতে দেশের মানুষ দেখতে পেয়েছে। যদি হেডমাস্টার শ্যামল কান্দির ভক্তকে এমপি সাহেব কান ধরে উঠবসের বদলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহর নাজেহালের মতো জামা-কাপড় ছিঁড়ে রক্তাক্ত করতেন; যদি বরিশালের বজ্রমোহন কলেছেন অধ্যক্ষ প্রফেসর শংকর চন্দ্র দত্তের মতো জামা-কাপড় ধুলে জঙ্গিয়া পড়াবস্থায় চ্যাংদোলা করে পানিতে ফেলে দিতেন; তাহলে এই ছাত্রছাত্রীরা প্রতীকী প্রতিবাদে নিজেদের জামা-কাপড় নিজেরাই ছিঁড়ে রক্তাক্ত করে প্রতিবাদ করতেন? নাকি প্রতীকী প্রতিবাদে কাপড়-চোপড় খুলে পানিতে ঝাপ দিয়েন?
মিশাইল ক্ষেপণাস্ত্র, এ্যাটমবোমা, হাইড্রোজেন বোমার চেয়েও এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী এবং ক্ষমতাধর হলো ‘গণমাধ্যম’। প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে জনমত গঠনে গণমাধ্যম যা পারে পৃথিবীর আর কোনো শক্তি ও ক্ষমতাধরের পক্ষে তা সম্ভব নয়। উত্তর-আধুনিক বিশ্বে গণমাধ্যম যা দেখায়, তাই মানুষ দেখে! এর বাইরে যেসব সত্য, তার বেশিরভাগ আড়ালেই থেকে যায়; গণমাধ্যম হল তাই যার মাধ্যমে আমরা বিশ্ব দেখি, বুঝি কিংবা জানি। ফলে গণমাধ্যম মানুষকে যেভাবে প্রভাবিত করতে পারে অন্য কোনো মাধ্যমে তা সম্ভব নয়। তুমি অভিযোগ করেছো শ্যামল চন্দ্র ভক্তের ইসলাম ধর্ম কটূক্তির ঘটনায় মিডিয়া সত্য প্রকাশ করছে না। তোমার বক্তব্য সরাসরি প্রচার না করে নিজেরাই কথাজুড়ে দিচ্ছে। আবার কোনো কোনো মিডিয়া খ-িতভাবে বক্তব্য প্রচার করছে। ঘটনা ৮ মে’র অথচ তিন চার দিন পর মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার শুরু হয়। তোমার অভিযোগ তোমার বক্তব্যই শুধু নয়, ঘটনার সময় উপস্থিত থাকা ইংরেজি শিক্ষক উত্তম কুমার গুহ, তোমার সহপাঠী রুপন্তি, মাকসুদ, আসিফ, রাহিম রমজান কারো বক্তব্য মিডিয়া সঠিকভাবে তুলে ধরেনি। এমনকি ঘটনা যারা দেখেছেন তাদের একজন আবদুল হাই এবং তোমার মায়ের বক্তব্যও সঠিকভাবে তুলে ধরেনি মিডিয়া। তোমাকে চাপ দিয়ে অন্য ধরনের কথা বলানোর চেষ্টা করেছে এমন দু’টি ইলেক্ট্রোনিক্স মিডিয়ার নামও তুমি প্রকাশ করেছে। তোমার কাছে প্রথমেই এ কারণেই ক্ষমা চেয়েছি; যারা তোমার বক্তব্য সঠিকভাবে তুলে ধরেনি এবং তোমাকে অন্য ধরনের বক্তব্য দেয়ার জন্য প্রভাবিত করেছে তারা একটি বিশেষ গোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। দশম শ্রেণীতে পড়ো অথচ ‘বাঁদর নাচে খুঁটির জোরে’ প্রবাদ পড়নি? ঘটনার পর কয়েকদিন ঘুমিয়ে থাকা ব্যক্তিদের ‘বিবেক’ হঠাৎ জেগে উঠলো কেন?  
ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে তুমি বলেছ- ৮মে দশম শ্রেণীর চতুর্থ পিরিয়ডে (ইংরেজি) উত্তম স্যার পড়াচ্ছিলেন। ক্লাসে হইচই। এ সময় হেডস্যার (শ্যামল কান্তি ভক্ত) উত্তেজিত হয়ে রুমে ঢুকলেন। প্রথমে মেয়েদের বলেন ‘তোরা অমানুষ, শিক্ষার যোগ্যতা অর্জন করবি কীভাবে?’ অতঃপর ছেলেদের পাশে গিয়ে বলেন, ‘তোরা অমানুষ, মানুষ হবি কীভাবে? তোরা নাপাক, তোদের আল্লাহও নাপাক।’ এ সময় উত্তম স্যার ছিল। ছাত্ররা বলেন, ‘হেড স্যার আমাদের ধর্মের বিষয়ে এভাবে কথা বলেন কেন?’ জবাবে উত্তম স্যার (হেড স্যারকে) বলেছেন, ‘স্যার, ওদের ধর্ম ওরা পালন করবে, আমাদের ধর্ম আমরা পালন করব।’ এ সময় সামনের বেঞ্চে বসা রুপন্তি উত্তম স্যারকে প্রশ্ন করে বলে, ‘স্যার, আমাদের ধর্মের বিষয়ে (হেডস্যার) এ রকম কথা কীভাবে বললেন?’ তখন উত্তম স্যার বললেন, ‘উনি হেডস্যার (শ্যামল কান্তি ভক্ত) যা ভালো মনে করছেন, বলছেন।’ পঞ্চম পিরিয়ডে আবার হেডস্যার আমাদের রুমে আসেন। শিক্ষক ছিলেন মোশাররফ স্যার। তাকে বিদায় দিয়ে হেডস্যার নিজেই ক্লাস নেন। তখন আমার পেছনের একজন শব্দ করে হাসে। আমি লিখছিলাম। স্যার ডাক দিয়েছেন বুঝতে পারিনি। আমার কাছে এসে শার্টের কলার ধরে বললেন, ‘তোমাকে ডাকছি শুনছো না? আমাকে কি হেডমাস্টার মনে হয় না?’ এরপর এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি শুরু করেন। তলপেটে ঘুষি লাগায় আমি বসে পড়ি। ‘ওরে বাবা, ওরে মা, আল্লাহরে বাঁচাও’ বলে চিৎকার করে কাঁদছিলাম। তখন স্যার বলেন, ‘কিসের আল্লাহ? আল্লাহ বলতে কিছু নেই, তোরা নাপাক, তোদের আল্লাহও নাপাক।’ এর কিছুক্ষণের মধ্যে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। ক্লাসের ক্যাপ্টেন রাহিম রমজানকে দিয়ে হেড স্যার আমার জন্য ট্যাবলেট নিয়ে আসেন। বিকেলে স্কুল ছুটির পর ইসলাম ধর্ম অবমাননার খবর প্রচার হলে সবাই বিক্ষুব্ধ হন। মা কমিটিকে বিচার দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরের দিন ৯ মে স্যার আমাদের বাড়িতে আসেন। আম্মাকে বলেন, ‘ধর্মের বিষয়টা, যেটা রিফাতকে ক্লাসে বলছি, দয়া করে কমিটির লোকদের বলবেন না।’ স্যার আম্মার কাছে মাফ চাওয়ায় দরখাস্তে ধর্ম অবমাননার কথা লিখিনি। আমার সামনে এসএসসি পরীক্ষা। স্যারের হাতে অনেক ক্ষমতা, এটা ভেবে আমার দুলাভাই (সাদেক) ধর্মের বিষয়টা উল্লেখ করতে নিষেধ করেন। অবশ্য সহপাঠীরা বলছিল তুমি মারের বিচার চাও, আমরা ধর্মের বিষয়ে এক সাথে বলব। স্কুলে হেডস্যারকে ঘেড়াও করলে এমপি হেডস্যারের কান ধরে উঠসব করে। এ ঘটনার তিন চারদিন পর প্রথম দিকে মিডিয়ার বিভিন্ন লোকজন দশ-বিশবার আমাদের বাড়িতে আসত ঘটনা জানতে। ধর্ম নিয়ে কটূক্তির কথাটা আমি তাদেরকে বলি কিন্তু তারা (মিডিয়া) তুলে ধরে না। একাত্তর টিভি আমাকে জিজ্ঞেস করছিল তুমি কি মাইকিং করছিলা? আমি বলি, না। তুমি কি লোকজন নিয়ে গিয়েছিলে? বললাম, না। এই কথাটাই ওই কথাটার (ধর্মের অবমাননা) সঙ্গে ভাঁজ খাইয়ে ওই ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে। আমার কথা প্রচার না করে তারা হেডস্যারের পক্ষে নিজেরাই বক্তব্য প্রচার করে। আমি যখন মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলছিলাম তখন এলাকার অনেক লোক উপস্থিত ছিল। তারা শুনছে। আর যত মিডিয়া আসছে তাদের কেউ সত্যটা প্রকাশ করছে না। সরকারী লোকজনও এসেছে। তাদের কাছে রূপন্তি মাকসুদ, আসিফ, রাহিম রমজান এবং আমি ধর্ম অবমাননাসহ সব বলেছি। এটা পরে কী হলো বুঝতে পারলাম না।
কর্পোরেট হাউজ পরিচালিত মিডিয়াগুলো কাউকে খুশি করতে বা কারো চোখ রাঙানীতে নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ে সৃষ্ট ঘটনার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার পরিবর্তে মানুষের মধ্যে যে বিভ্রান্তি ছড়ালো তা কি সাংবাদিকতার নীতিমালায় পড়ে। কাউকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করা কি মিডিয়ার নীতি নৈতিকতা হতে পারে? অপরাধের বিচার হওয়া উচিত প্রচলিত আইনেই। ক্লাসে শিক্ষার্থীদের পেটানো দ-নীয় অপরাধ। আর ধর্ম নিয়ে কটূক্তি ক্ষমার অযোগ্য। শুধু ইসলাম ধর্ম নয়, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য কোনো ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করা উচিত নয়। মিডিয়াগুলো প্রকৃত চিত্র তুলে ধরলে মানুষ জানতে পারতো আসলে নারায়ণগঞ্জে সেদিন কি ঘটেছিল। ছাত্র রিফাত হাসান ছাড়াও ঘটনার সময় যারা ক্লাসে ছিলেন ইংরেজি শিক্ষক উত্তম কুমার গুহ, ছাত্রী রুপন্তি, ছাত্র মাকসুদ, আসিফ, রাহিম রমজান তাদের মুখেও প্রকৃত চিত্র জানা যেত। অভিযুক্ত শ্যামল কান্তি ভক্ত আর অভিযোগকারী রিফাত হাসান নয়, বরং উপস্থিত অন্যান্যদের বক্তব্য মিডিয়ায় তুলে ধরাই হতো সৎ সাংবাদিকতা। প্রশাসনের নাকের ডগায় এতোগুলো পুলিশের উপস্থিতিতে একজন এমপি মানুষ বানানোর কারিগর শিক্ষককে কান ধরে উঠবস করার সাহস দেখায় কেন? পরিস্থিতি কেমন ছিল? আবার একজন প্রধান শিক্ষক হয়ে একজন মন্ত্রীর পায়ে লুটিয়ে পড়ে প্রণাম করা কোন ধরনের ব্যক্তিত্ব? মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের পায়ে প্রণাম করার দৃশ মিডিয়ায় দেখে নারায়ণগঞ্জের মানুষ মন্তব্য করেছেন, ওই শ্যামল এক সময় সেলিম ওসমানকে প্রণাম করতো; এখন নাসিমকে প্রণাম করছে। নারায়ণগঞ্জের ইসলাম ধর্মকে কটূক্তি করায় সেখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতারা ঐকবদ্ধ। কোনোভাবেই ইসলাম ধর্ম অবমাননা তারা মেনে নিতে চাচ্ছেন না। অথচ রাজধানী ঢাকায় উল্টো চিত্র। কয়েকজন মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের নেতারা ধর্ম অবমাননার খবর মিথ্যা অবিহিত করে এমপি সেলিম ওসমানের বিচার দাবি করছেন। এরশাদের জাতীয় পার্টি ‘যেদিকে বৃষ্টি সেদিকে ছাতা’ ধরার পুরনো কৌশল নিয়েছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ ইসলাম ধর্ম অবমাননাকারী শিক্ষকের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। প্রশ্ন হলো রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রের এই নেতারা কি প্রকৃত সত্য জানার প্রয়োজন মনে করেছেন? তারা তো ঘটনার সত্যতা জানতে দলের লোককে নারায়ণগঞ্জে পাঠাতে পারতেন। সবার সঙ্গে কথা বলে তারা প্রকৃত ঘটনা জেনে ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কিন্তু সেটা কোনো দলই করেনি। আর বিএনপি প্রকত ঘটনা না জেনেই কি কারণে ইসলামবিদ্বেষীর পক্ষে কোমড় বেঁধে নামলো তা রহস্যজনক। দেশের মানুষ প্রকৃত ঘটনা জানতে চায়। নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে রিফাতের এই প্রশ্নবিদ্ধ বক্তব্যের জবাব কে দেবে?

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Shohag ২৭ মে, ২০১৬, ৩:৫৬ পিএম says : 0
আল্লাহ্ তুমি বিচার করো।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন