দিল্লীর সুলতানদের মধ্যে গিয়াসউদ্দীন বলবন ছিলেন নবম। তিনি ছিলেন তুর্কী মামলুক (কৃতদাস)। তাঁর পিতা ছিলেন তুর্কিস্তানের এক কাবায়েলী গোত্রের সর্দার। তাতাররা তাকে গ্রেফতার করে গোলাম বানিয়ে বিক্রি করে দেয়। খাজা জামাল উদ্দীন বসরী তাকে নিজের পুত্রদের মতো লালন পালন করেন। পরে তাকে মুক্ত করে দেন। অতঃপর বলবন দিল্লীতে পৌঁছেন এবং ১২৩৩ সালে সুলতান শামসুদ্দীন আলতামাশ (১২১১-১২৩৬) তাকে খরিদ করেন। অল্প দিনের মধ্যে তিনি উন্নতি করেন এবং ‘চেহেল গানি’ আমিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান। সুলতান শামসুদ্দীনের কনিষ্ঠ পুত্র সুলতান নাসের উদ্দীন মাহমুদ (১২৪৬-১২৬৬) তাকে স্বীয় নায়েব মনোনীত করেন। ১২৬৬ সালে নাসির উদ্দীন মাহমুদের ওফাতের পর বলবন সুলতান হিসেবে ক্ষমতা লাভ করে এবং ‘গিয়াসউদ্দীন’ উপাধি ধারণ করেন।
গিয়াসউদ্দীন বলবন ১২৬৬ থেকে ১২৮৭ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন। কোনো কোনো বর্ণনা অনুযায়ী ইন্তেকালের সময় তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর এবং ৪০ বছর ছিল তার রাজত্বকাল। গিয়াসউদ্দীন বলবনের দুই পুত্রের নাম জানা যায়। তারা হচ্ছেন যথাক্রমে শাহজাদা মোহাম্মদ ও শাহজাদা বোগরা খান। শাহজাদা মোহাম্মদের পুত্র কায়খসরু এবং শাহজাদা বোগরা খানের পুত্র মোয়েজুদ্দীন কায়কোবাদ। তার তিন বছর বয়স্ক পুত্র মুরাদকে শামসুদ্দীন উপাধি দিয়ে ক্ষমতাসীন করা হলেও ১২৯০ সালের ১৩ জুন জালালউদ্দীন ফিরোজ খিলজী সত্তর বছর বয়সে নিজেকে সুলতান ঘোষণা করেন, যার ফলে বলবন বংশের পতন ঘটে এবং খিলজী সুলতানদের রাজত্বের সূচনা হয়।
গিয়াসউদ্দীন বলবন তাঁর চল্লিশ বছর রাজত্বকালে কুড়ি বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং কুড়ি বছর একজন প্রভাব প্রতিপত্তিশালী সুলতান হিসেবে রাজত্ব করেন। তিনি সকল ক্ষেত্রেই তার শত্রু নির্মূল করেন এবং রাষ্ট্রে পূর্ণ শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার দৃঢ় সংকল্প করেন। তাঁর প্রথম অংশ ছিল মেওয়াতীদের দমন। ওরা চলাচলকারী মোসাফিরদের লুট করত এবং রাতে দিল্লীতে প্রবেশ করে লোকদের মাল সামান ছিনতাই করত, এমনকি দিন দুপুরে প্রকাশ্যে লোকদের মারধর করত। বলবন সিংহাসন লাভ করার সাথে সাথে দস্যু ডাকাতদের অভয় কেন্দ্র বনজঙ্গল কর্তন করে ডাকাতদের শস্তি প্রদান করেন এবং চতুর্দিকে পুলিশের চৌকি নির্মাণ করেন। তিনি গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে দুর্গ নির্মাণ করেন। ‘দোওয়াব’ এর হিন্দুরা দিল্লী ও বাঙলার মধ্যে যাতায়াতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছিল। বলবন আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ কসবা এবং জনপদগুলো দেখভাল করার দায়িত্ব অর্পণ করেন শক্তিশালী আমিরদের ওপর, যারা বন জঙ্গল কেটে রাহজানি সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ করেন এবং ডাকাত দস্যুদের কঠোর হস্তে দমন করেন। এ ব্যবস্থার ফলে দিল্লী ও বাঙলার সড়ক মহাসড়কগুলো প্রায় এক শতাব্দী পর্যন্ত নিরাপদ থাকে।
সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবন তাতারি হামলা প্রতিহত করে বাঙলার বিদ্রোহ দমন করেন। তিনি উৎকৃষ্ট শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন, যাতে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। সকল শ্রেণির লোকের সাথে তাঁর আচরণ ছিল সমান এবং ন্যায় ভিত্তিক। তাতারদের অত্যাচার নির্যাতনের ফলে যে সব উলামা মাশায়েখ, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী প্রভৃতি ইসলামী বিশে^র নানা স্থান থেকে আত্মরক্ষার জন্য বের হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, তারা সবাই গিয়াসউদ্দীন বলবনের নিকট এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ কারণেই তার রাজত্বকালে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিশেষ উন্নতি সাধিত হয়।
সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবন একজন ন্যায়পরায়ণ দ্বীনদার বাদশাহ ছিলেন। তাঁর ন্যায় বিচার হতে কেউ বঞ্চিত হত না। তিনি স্বজন প্রীতির বশবর্তী হয়ে পক্ষপাতদুষ্ট বিচার করেছেন এমন দৃষ্টান্ত নেই। বরং উচ্চ পদমর্যাদায় অধিকারী ব্যক্তিকেও তিনি অপরাধের দায়ে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেছেন। এমন একটি ঘটনা রয়েছে। সেই ঘটনাটি ছিল এরূপ:
শাহজাদা মোহাম্মদ ছিলেন সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবনের অতি আদুরে। সিন্ধু অভিযানে সামান্য ভুলের জন্য শত্রু পক্ষের হাতে শাহজাদা বন্দি হন। মোগলদের আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে সুলতান বলবনের সৈন্যবাহিনী এই অভিযানে বের হয়েছিলেন।
বদায়ুন প্রদেশের সুবাদার আমির জামদার মোগল বাহিনীর সাথে এই যুদ্ধে যে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন তাতে গোটা দরবার ও উপদেষ্টা মহল অতিশয় আনন্দিত হয়েছিল। এ ছাড়া সৈন্যবাহিনীর বহু উল্লাসের অন্ত ছিল না।
সুবাদার জামদারের প্রবল আক্রমণের মুখে মোগল বাহিনী টিকতে পারেনি, তিনি তাদেরকে সিন্ধু হতে বিতাড়িত করেই ক্ষান্ত হননি, বরং শাহজাদা মোহাম্মদকেও তাদের কবল হতে মুক্ত করে আনেন। এই যুদ্ধে শত্রুদের পরাজিত করা ছাড়াও শাহজাদাকে মুক্ত করে আনতে পারাই ছিল একটি গৌরবময় কীর্তি। কেননা সুলতানের আদরের দুলালকে নিরাপদে মুক্ত করতে না পারলে যুদ্ধের বিজয় সংবাদে সুলতান বলবন আনন্দিত হতে পারতেন না। সৈন্যরা স্বাভাবিকভাবেই এ ধারণা পোষণ করে শাহজাদার মুক্তির পূর্ব পর্যন্ত খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। আমির জামদার নিজের প্রাণের তোয়াক্কা না করে যে বিপদসংকুল অবস্থায় নিজেকে নিক্ষিপ্ত করে অসীম বীরত্বের সাথে শাহজাদাকে শত্রুর কবল হতে ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হন, তাতে সুলতান বলবনের অভিযানকারী দলের আনন্দের আত্মহারা হয়ে যাওয়ারই কথা। কেননা আমির জামদারের দুঃসাহসিকতার দরূণ শাহজাদা অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসতে সক্ষম হন।
যুদ্ধ শেষে ঘটনার আনুপূর্বিক বিবরণ দানের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলেই সুলতানের সমীপে উপস্থিত হলেন। দরবার শুরু হলো। দরবারে সুলতান বলবনকে যুদ্ধের বিজয় কাহিনী এবং শাহজাদার মুক্তির ঘটনা বিবরণী শোনানোর জন্য সকলেই উদগ্রীব ছিল। সুলতানের দরবারে আরোহণ করার মুহুর্তটির অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে ছিল দরবারের কর্মকর্তা, আমির, ওমরা সবাই। কেননা আমির জামদার শাহজাদাকে রক্ষা করে সুলতানের যে মহাউপকার সাধন করেছিলেন সুলতান তা বিস্মৃত হতেই পারেন না। এই জন্য সুলতান কি সম্মান করেন তা দেখার আশায় বিপুল উৎসাহ নিয়ে সকলেই তার আগমনের প্রতীক্ষা করছিল।
প্রতিদিনের মতো সুলতান নির্ধারিত সময়ে সিংহাসনে আরোহণ করলেন এবং রাজকীয় রীতিনীতির মাধ্যমে দরবারের কার্যক্রম শুরু হলো, আমির জামদার যুদ্ধ ক্ষেত্রের অবস্থা বর্ণনা করতে লাগলেন। জামদারের বর্ণনা কেবলমাত্র শুরু হয়েছে, ইত্যবসরে জনৈক্য মহিলা হাপাতে হাপাতে দরবারে প্রবশে করে এবং সুলতানবলবনের সামনে এসে দাঁড়ায়। সুলতান মহিলাটিকে এত বিচলিত ও বিষণ্ন অবস্থায় দেখে অতি বিন¤্রভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার কি বক্তব্য আছে বল।’ মহিলা বললেন, ‘জামদারের বিরুদ্ধে আপনার দরবারে আমার একটি নালিশ আছে।’ এ কথা শুনে দররবারে মহা হুলুস্তুল পড়ে গেল। মহিলাটি সম্পর্কে নানা জন নানা মন্তব্য করতে লাগল। কেউ মাতাল-উম্মাদ, কেউ বা বিভিন্ন বিশ্রী মন্তব্য করে মহিলাটিকে নাজেহাল করতে লাগল। সুলতান এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতি দেখে সকলকে চুপ থাকতে বললেন এবং তিনি মহিলাটির উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোমার কি অভিযোগ তা এবার বল।’ ফরিয়াদী মহিলা বলতে লাগল, ‘আমি একজন সাধারণ পেশাদারের স্ত্রী। আমার স্বামীর নাম সাহের। তাঁকে আমির জামদার কোরবান খানের সাহায্যে হত্যা করেছেন এবং আমাকে তার অন্দর মহলে আনতে চান। এ জন্য আমি সুলতানের দরবারে বিচারের প্রার্থনা করতে এসেছি।’ সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবন মহিলাটিকে বললেন, ‘তোমার সাথে ইনসাফ করা হবে।’ অতঃপর তিনি আমির জামদারের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘যুদ্ধের অবশিষ্ট অবস্থা বর্ণনা কর।’
সুলতানের চেহারায় কোনো পরিবর্তন পরিলক্ষিত হলো না, তিনি ধীর স্থিরভাবে সিংহাসনে উপবিষ্ট। আমির জামদার কাঁপতে কাঁপতে যুদ্ধের অবশিষ্ট অবস্থা শোনাতে লাগলেন। আমির জামদারের বর্ণনা সমাপ্ত হলে সুলতান বলবন কর্মচারীদের প্রতি ইশারা করলেন। তারা আমির জামদারকে সোনালি পোশাক পরিধান করালো, তার গলায় জমররদ পাথরের মালা পরালো, হাতের উভয় বাহুতে বিশেষ ধরনের বাজুবন্দ বাঁধলো। এরপর রাজভাণ্ডারের অর্থ সচিব উঠে ঘোষণা করলেন; ‘সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবন বদায়ন প্রদেশের বীর শ্রদ্ধেয় আমির জামদারকে তার অসাধারণ উচ্চ সামরিক কীর্তির অবদানের পুরস্কার হিসাবে রাজকোষ হতে এক কোটি টাকা নগদ অর্থ দানের আদেশ করেছেন।’ অর্থ সচিবের বক্তব্য শেষ হওয়া মাত্র সুলতান বলবন তার পাশর্^ পরিবর্তন করে বললেন, ‘আমি একটি দায়িত্ব পালন করলাম। কিন্তু এখনও আমার আরও একটি দায়িত্ব পালন বাকী আছে। আজ জনৈক্য মহিলা আমাদের ইনসাফ চেয়েছেন। অনুমতি দান করা হলো এবং তোমাদের কিছু বলার থাকলে বলতে পার।’ আমির জামদার আরজ করলেন, ‘জাহাপানাহ! আমি অন্যায় করেছি, আমাকে ক্ষমা করুন।’ সুলতান বলবন গর্জন করে বললেন, ‘মহিলা ইনসাফের জন্য এসেছে, ক্ষমা করতে আসেনি।’ সুলতানের নির্দেশক্রমে আমির জামদারকে লৌহ শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হলো। সুলতান বলবন প্রধান বিচারপতিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী এই অপরাধের কি শাস্তি হওয়া উচিত?’ প্রধান বিচারপতি অত্যন্ত বিনীতভাবে আরজ করলেন, ‘ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী, প্রাণের বদলে প্রাণ। কিন্তু অপরাধী তার অপরাধ স্বীকার করেছে, অতঃপর এটাকে কিছুটা শিথিল করা উচিত। সুলতান প্রধান বিচারপতির দিকে ক্রোধান্বিত হয়ে তাকালেন এবং বললেন, ‘তুমি এটা এজন্যই বলছো যে, আমির জামদার সুলতানের একজন বিশ^স্ত লোক। কিন্তু ইনসাফের ব্যাপারে আমার নিকট সকলই সমান। ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী তার শাস্তি হওয়া উচিত।’ এই বলে সুলতান দরবারের মীর মুন্সীকে লিখিত নির্দেশ দান করলেন, ‘হত্যাকারীকে শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হোক এবং নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের থাকা খাওয়ার খরচ রাজকোষ হতে বহন করা হোক।’ রায় শ্রবণ করে মহিলা সুলতানের পায়ে পড়ে বললেন, ‘আমি বিচার পেয়েছি, জামদারকে আমি ক্ষমা করে দিলাম।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন