সাখাওয়াত হোসেন বাদশা : গ্যাস সংকট নিয়েই চলছে শিল্প কারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন। সমুদ্রে নতুন এলাকায় গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। স্থলভাগেও নতুন বড় গ্যাসের আধার সাম্প্রতিক সময়ে পাওয়ার কোন লক্ষণ নেই বললেই চলে। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্যাসের এখন তীব্র সংকট। সমস্যা মোকাবেলায় সরকার শিল্প কারখানায় ধীরে চলো নীতিতে গ্যাস সরবরাহ করছে। একইসাথে জোড়াতালি দিয়ে কিম্বা রেশনিং করে কোনমতে গ্যাসের চাহিদা মেটানো হচ্ছে।
এই অবস্থায় গ্যাসের একমাত্র বিকল্প জ্বালানি হচ্ছে কয়লা। কিন্তু দেশীয় এই কয়লা উত্তোলনে সরকার এখনও উদাসীন। বরং কয়লা উত্তোলনের উদ্যোগটি নীতিগত স্তরেই আটকে আছে। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়লা উত্তোলন এখন টেকনিক্যাল বা ইকোনমিক্যাল কোন ইস্যু নয়, সরকার এটিকে পুরোপুরি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। এটা এখন পলিটিক্যাল ফুটবল।
এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে গ্যাস সঙ্কট যেমন আরও তীব্র হচ্ছে; তেমনি বাড়ছে জ্বালানি তেল আমদানি। যার বিরূপ প্রভাব পড়েছে বিদ্যুৎ খাতের ওপর। দফায় দফায় বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের মূল্যও। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম যেহারে কমেছে, দেশীয় বাজারে তেলের মূল্য সেভাবে কমানো হয়নি। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের ব্যবহারযোগ্য ডিজেল ও কেরোসিনের দাম কমানো হয়েছে একেবারেই নামমাত্র।
সাধারণ মানুষ যেখানে প্রত্যাশা করেছে আন্তর্জাতিকবাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার কারণে দেশীয় বাজারে তেলের মূল্য কমানোর পাশিপাশি বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম কমানো হবে। কিন্তু তা না করে সরকার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম আরও একদফা বাড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েই রেখেছে। বাকী আনুষ্ঠানিতকা সম্পন্ন হলেই বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা আসবে।
এমন পরিস্থিতিতে শিল্পখাতের নিরাপত্তা আরও হুমকির মুখে পড়েছে। আর আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে শিল্প উৎপাদন ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে আশঙ্কাজনক হারে। পরিস্থিতি সামলে উঠতে দেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা সরকারকে কয়লা উত্তোলনের ওপরই গুরুত্বারোপ করছেন সবচেয়ে বেশি। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্তহীনতায় জ্বালানি সঙ্কট বাড়ছেই।
গ্যাস সঙ্কট নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেছেন, দেশে গ্যাসের মজুদ কিন্তু অফুরন্ত নয়। আর গ্যাসের এই মজুদ ১৫ বছর একেবারেই নিঃশেষ হয়ে যাবে। দু’চার বছর পর থেকে বিভিন্ন কূপে গ্যাস কমতে শুরু করবে। অথচ চাহিদা বেড়েই চলেছে। নতুন নতুন সংযোগও দেয়া চলছে। ফলে ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের গ্যাস ব্যবহার নিয়ে নতুন করে ভাবার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এক্ষেত্রে তিনি বিকল্প জ্বালানির ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
অন্যদিকেÑ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু জানান, ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। আর এর মধ্যে ২৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎই উৎপাদন হবে কয়লা পুড়িয়ে। এতে প্রতিদিন প্রয়োজন হবে বিপুল পরিমাণ কয়লা। এজন্য অবশ্যই দেশীয় কয়লা উত্তোলনের উদ্যোগ নিতে হবে। তবে আপাতত আমদানিকৃত কয়লার ওপরই জোর দিচ্ছে সরকার। তিনি বলেন, দেশীয় কয়লা উত্তোলনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু ঝামেলাও রয়েছে। বিশেষ করে কয়লাসমৃদ্ধ এলাকার মানুষের জীবন ও জীবিকার বিষয়টি মাথায় রেখে বর্তমানে দেশের কয়লা উত্তোলনের কোনো পরিকল্পনা সরকার নিচ্ছে না।
তবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা ড. ম তামীম বলেন, কয়লা উত্তোলন এখন টেকনিক্যাল বা ইকোনমিক্যাল ইস্যু নয়, পুরোপুরি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। এটা এখন পলিটিক্যাল ফুটবল। তার মতে, তিন থেকে চার বছরের মধ্যে গ্যাসের উৎপাদন আরও কমে যাবে। ফলে বিকল্প জ্বালানি হিসাবে কয়লা উত্তোলন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
আর দেশীয় কয়লা উত্তোলনের ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা তপন চৌধুরী বলছেন, কয়লানীতি না হওয়ায় দেশের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। তাই জাতীয় স্বার্থেই রাজনীতিকদের কয়লানীতি চূড়ান্ত করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, শুধুমাত্র আমদানি নির্ভর কয়লার উপর নির্ভর করে বড় বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা ঠিক হবে না।
এদিকে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, একমাত্র বড়-পুকুরিয়া ছাড়া আর কোন খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে না। তবে দীঘিপাড়া খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাংলাদেশের কয়লার মান বিশ্বের যেকোন কয়লার চেয়ে উন্নত। দেশের ১ টন বিটুমিনাস কয়লার ‘প্রজ্জ্বলন ক্ষমতা’ বিদেশ থেকে আমদানি করা ২ টন কয়লার সমান। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে অন্যান্য দেশের কয়লার চেয়ে বাংলাদেশের কয়লার দামও বেশি। দেশের একমাত্র কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে তাও বড়পুকুরিয়ায়। এখানকার কয়লা খনির কয়লা থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ২৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন দু’টি ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে।
পেট্রোবাংলার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ গ্যাস মজুদ আছে তা দিয়ে ২০১৫ সালের পর আর চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে না। কিন্তু কয়লা এমন পরিমাণ মজুদ আছে যে, তা থেকে দৈনিক ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ৫০ বছর পর্যন্ত অনায়াসে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব।
এ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়কে যে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছেÑ তাতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, দেশের খনিগুলো থেকে কয়লা উত্তোলনের উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় জ্বালানি সঙ্কট আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, লামার ছৌলুম ঝিরি কয়লা খনি ছাড়াও জামালগঞ্জ, বড়পুকুরিয়া, ফুলবাড়ী, খালিসাপাড়া, দীঘিপাড়া কয়লা খনি রয়েছে। এসব কয়লা খনিতে মোট মজুদকৃত কয়লার পরিমাণ ২৫০ কোটি মেট্রিক টন।
জানা যায়, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিটি ১৯৮৫ সালে আবিষ্কৃত হয়। এখানে সম্ভাব্য মজুদের পরিমাণ ৩০ কোটি ৩০ লাখ টন। বর্তমানে এই খনি থেকে কয়লা তোলা হচ্ছে। ফুলবাড়ীয়া কয়লা খনিটি ১৯৯৭ সালে আবিষ্কৃত হয়। এখানে ১৫০ থেকে ২৪০ মিটার গভীরে ৫৭ কোটি ২০ লাখ টন কয়লা মজুদ আছে। খালিসাপাড়া কয়লা খনিটি ১৯৮৯ সালে আবিষ্কৃত হয়। এখানে ৬৮ কোটি ৫০ লাখ টন কয়লার মজুদ নিশ্চিত হওয়া গেছে। দীঘিপাড়া কয়লা খনিটি ১৯৯৪ সালে আবিষ্কৃত হয়। মজুদের পরিমাণ ৬০ কোটি টন। আর জামালগঞ্জ কয়লা খনিটি ১৯৬২ সালে আবিষ্কৃত হয়। এই খনিতে কয়লা মজুদের পরিমাণ ১০৫ কোটি ৩০ লাখ টন।
জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ভূ-গর্ভস্থ (আন্ডারগ্রাউন্ড) পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হলে খনির পুরো কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব হয় না। তবে দীঘিপাড়া কয়লা খনিতে যে পরিমাণ কয়লা মজুত রয়েছে তার অর্ধেক পরিমাণ কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব হলেও দেশের জ্বালানি চাহিদা পূরণে বিরাট ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদ দায়িতপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের। কর্তৃপক্ষের অনুমান এই খনি থেকে বাৎসরিক ৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব যা দিয়ে ১৫০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু রাখা যাবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এই কর্মকর্তা মতে, আমদানি নির্ভর কয়লায় ইউনিট প্রতি আনুমানিক উৎপাদন ব্যয় পড়বে যেখানে গড়ে ৭ টাকা, সেখানে দেশীয় কয়লা উত্তোলন করে খনির পাশে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে উৎপাদন ব্যয় ৩ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৪ টাকার বেশি হবে না।
বর্তমানে আমদানিনির্ভর কয়লাকে কেন্দ্র করে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়ে সরকার চুক্তিবদ্ধ হলেও এক সময় এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রকে দেশীয় কয়লার ওপরই নির্ভর করতে হবে। তখন সমুদ্র তীরবর্তী বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে দেশীয় কয়লা সরবরাহ করে উৎপাদনে যাওয়াটা অনেক ব্যয়বহুল হবে। বর্তমানে আবিষ্কৃত সব কয়লা খনির অবস্থানই দেশের উত্তরাঞ্চলে। অথচ বড় ধরনের যে তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে তার দু’টি সুন্দরবনের কাছাকাছি এবং একটি চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে।
চট্টগ্রামের বাঁশখালী এবং সুন্দরবনের রামপালে সরকার পৃথক দু’টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। এর মধ্যে রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি হবে ভারতের সাথে যৌথ উদ্যোগে এবং বাঁশিখালীতে ১৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রতিবাদে সম্প্রতি সেখানে ত্রিমুখী সংঘর্ষে কমপক্ষে চারজন গ্রামবাসী প্রাণ হারান।
আনু মুহাম্মদ বলেন, কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় দেশী-বিদেশী গোষ্ঠী মরিয়া। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র একসময় শুধু পুরো বাংলাদেশকেই অরক্ষিত করে ফেলবে না, এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র সরকারের জন্য গলার ফাঁসে পরিণত হবে। এসব কেন্দ্র চালাতে তখন বিদেশ থেকে আমদানি করা কয়লার পরিবর্তে দেশীয় কয়লাই মুখ্য হয়ে উঠবে।
এ ব্যাপারে এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার ম্যাগাজিন সম্পাদক মোল্লাহ আমজাদ হোসেন বলেন, শতভাগ আমদানিনির্ভর হয়ে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে ভবিষ্যতে এসব প্রকল্প সরকারের জন্য বুমেরাং হয়ে দেখা দেবে। তার মতে, কয়লা আমদানিতে যেকোনো সময় সমস্যা ও সঙ্কট দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে দেশীয় কয়লাকেও বিকল্প হিসেবে রাখতে হবে। এ জন্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে ৫০ ভাগ দেশীয় এবং ৫০ ভাগ আমদানিনির্ভর কয়লায়। আর তা করতে হলে দেশীয় কয়লা উত্তোলনের উদ্যোগ নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন