সাইদুর রহমান মাগুরা থেকে : মাগুরাসহ দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২৫টি নদী আজ মৃত। ফলে পরিবেশগতসহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়ে পড়েছে এ অঞ্চলের সাড়ে ৪ কোটি মানুষ। এ অঞ্চলের নদ-নদীগুলোর নাব্যতা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার না করায় মাগুরাসহ খুলনা বিভাগের ১০ জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীগুলোর প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার তলদেশ ইতিমধ্যে ভরাট হয়ে ২৫টি ছোট বড় নদ-নদী মানচিত্র থেকে মুছে যেতে বসেছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ, ভূগর্ভস্থ পানির স্থরের নিম্নমুখিতা রোধ, মৎস্য, কৃষি, পশু সম্পদ উন্নয়ন, নৌ যোগাযোগ রক্ষা ও অকাল বন্যা রোধে দেশের এ জেলাগুলোতে সরকারের সমন্বিত পানি সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ অপরিহার্য হলেও তা গ্রহণ না করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ২৫টি ছোট বড় নদী আজ মৃত কোন কোনটির অস্তিত্ব মানচিত্রে আছে বাস্তবে নেই। বর্তমানে এ অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত একমাত্র জীবিত নদী হচ্ছে গড়াইও মধুমতি। এ নদীটি দুটি শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে যাচ্ছে। মধুমতি ও গড়াইয়ের বুকজুড়ে এখন ধূধূ বালুচর। শুস্ক মৌসুমে মধুমতি ও গড়াইয়ের বুকে চলে চাষাবাদ। পদ্মার অন্যতম এ শাখা নদী দুটিই এ অঞ্চলের মিঠাপানির একমাত্র উৎস। পদ্মার প্রধান শাখা নদী মাথাভাঙ্গা। বাংলাদেশের ঠোটারপাড়া ও ওপারে ভারতের নদীয়ার জলঙ্গীর মধ্যবর্তী স্থানে এর উৎপত্তিস্থল। বহু বছর পূর্বে পলি জমে মাথাভাঙ্গার উৎসমুখ ভরাট হয়ে গেছে। এটি একটি সীমান্ত নদী। মাখাভাঙ্গা থেকেই বের হয়েছে ভৈরব নদ। সীমান্ত শহর দর্শনা থেকে যশোরের নওয়াপাড়া পর্যন্ত প্রায় দু’শো কিলোমিটার ভৈরবের নদীবক্ষ ভরাট হয়ে মরে গেছে। আশির দশকে ভারতের নদীয়া জেলার গঙ্গারাজপুরে জলঙ্গী নদীর ওপর একটি রেগুলেটর ও এর ৫ মাইল ভাটিতে ভৈরবের উৎসস্থলে ক্রসবাধ নির্মাণের ফলে নদীটির পানি প্রবাহের শেষ উৎসটুকুও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন ভৈরবের বক্ষজুড়ে কচুরিপানায় পরিপূর্ণ। কপোতাক্ষ নদীর উৎপত্তিস্থল ভৈরব থেকে। নদীটি ঝিকড়গাছাও সাগরদাড়ি হয়ে সাগরে মিশেছে। নদীটির উজানে ভরাট হয়ে গেছে। পানি ধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় ভাটি এলাকায় বর্ষা মৌসুমে পানি উপছে প্লাবন ঘটায়। এককালে এ অঞ্চলের অন্যতম খরস্রোতা নদী ছিল চিত্রা। মাথাভাঙ্গা ছিল চিত্রার উৎস। বেশ কয়েক বছর পূর্বে চুয়াডাঙ্গা এলাকায় চিত্রার দেড়শ’ কিলোমিটার বক্ষদেশ ভরাট হয়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে চিত্রার বক্ষজুড়ে চাষাবাদ হচ্ছে। মধুমতি, কুমার, নবগঙ্গা গড়াই থেকে কালীগঙ্গা ও ডাকুয়ার মাধ্যমে পানিপ্রবাহ পেত। গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্প বাস্তবায়নকালে কালীগঙ্গা ও ডাকুয়ার উৎস মুখে ক্রসবাধ দিয়ে পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। কুমারের অপর পানির উৎস ছিল মাথাভাঙ্গা ও সাগরখালী। এ দুটি উৎসও ভরাট হয়ে গেছে। আর কুমারের প্রায় দেড়শ’ কিলোমিটার বক্ষদেশ এখন ভরাট হয়ে বদ্ধজলাশয়ে পরিণত হয়ে জিকে প্রকল্পের নিষ্কাশন খালে পরিণত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে কোথাও হাঁটু পানি আবার কোথাও মাজা পানি থাকে। এক কালের দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম প্রধান খরস্রোতা নদী ছিল বেগবতি ও বেতনা। এ নদী দুটি আজ মৃত। নদী দুটির প্রায় ৯০ কিলোমিটার এলাকা ভরাট হয়ে গেছে। মেহেরপুরের কাজলা, কুষ্টিয়ার হিস্যা নদী দুটিও মরে গেছে। যমুনা, শ্রী, টেকা, হানু প্রভৃতি নদীর অস্তিত্ব হারিয়ে গেছে। কোনটি মানচিত্রে আছে বাস্তবে নেই। মাগুরাও ঝিনেইদহর ওপর দিয়ে প্রবাহিত ফটকি নদীর অবস্থাও করুণ। একই অবস্থা যশোরের হরিহর ও মুক্তাশ্বরী নদীগুলো মরে যাওয়ায় পানির স্থর নিচে নেমে যাওয়ায় পরিবেশ হয়ে উঠছে রুক্ষ। তেমনি এলাকার অর্থনীতি, ব্যবসায়-বাণিজ্যে পড়ছে বিরূপ প্রভাব। এতে পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। তেমনি মিঠা পানির মাছ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় জেলেরা পেশা ছেড়ে হয়েছে বেকার। নৌপথ নাব্যতা হারিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণস্থল পরিবহনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ফলে যানজট, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ। সড়ক সংস্কারে ব্যয় হচ্ছে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা। অন্য দিকে নৌ যোগাযোগের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা প্রাচীন নগর বন্দর আজ নিস্প্রাণ হয়ে পড়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন