মাদক বিক্রি হচ্ছে ৫১২ পয়েন্টে, ভারত থেকে প্রতিদিন আসে ১০ লাখ বোতল ফেনসিডিল, ৮০ ভাগ খুনে জড়িত মাদকাসক্তরা
স্টাফ রিপোর্টার : দেশের প্রায় ৫১২ পয়েন্টে প্রতিদিন হেরোইন, আফিম, প্যাথেডিন, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক বিক্রি হয়। এ ছাড়া ভারত থেকে প্রতিদিন বাংলাদেশে আসছে ১০ লাখ বোতল ফেনসিডিলসহ অন্য মাদকদ্রব্য। আর দেশে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ নিয়মিত ইয়াবা সেবন করছে। গতকাল (বৃহস্পতিবার) ঢাকা ক্লাবের স্যামসন এইচ চৌধুরী সেন্টারে অনুষ্ঠিত ‘মাদকের অপব্যবহার রোধে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা থেকে এ চিত্র উঠে আসে।
অনুষ্ঠানে ফ্যামিলি হেলথ ইন্টারন্যাশনালের পরিসংখ্যান তুলে ধরে জানানো হয়, শুধুমাত্র ভারত থেকেই দেশে আসে তিন কোটি টাকার মাদকদ্রব্য। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসে ফেনসিডিল। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেকটা খোলামেলা ভাবেই মাদকদ্রব্য বিক্রি হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে মাদকের অপব্যবহার রোধে করণীয় সর্ম্পকে নীতি-নির্ধারনী পর্যায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের বক্তারা বলেন, এসব বন্ধ করতে হলে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়ে উদ্যোগী হয়েও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে সবচেয়ে আগে পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিতে হবে প্রতিটি ঘর, অভিভাবক এবং শুভাকাক্সক্ষীদের পক্ষ থেকে।
বক্তারা বলেন, মাদকাসক্তি প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে মাদকদ্রব্য ও মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলা। অনুষ্ঠানে মানস-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ডা. অরূপ রতন চৌধুরী বলেন, আমাদের এই মুহূর্তে উচিত মাদকদ্রব্যের অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধ করা, মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা, বেকারদের কর্মসংস্থান ও স্কুল-কলেজে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি মাদকাসক্তির কুফল সর্ম্পকে শিক্ষা প্রদান এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
এর পরিপ্রেক্ষিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলক তার বক্তব্যে বলেন, বর্তমানে দেশে তথ্য-প্রযুক্তি খাতে শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের অফুরন্ত সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে আউটসোর্সিংয়ে আমাদের রয়েছে অফার সম্ভাবনা। কোটি কোটি টাকার বাজার আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এ জন্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিভিন্ন রকম সচেতনতামূলক কার্যক্রম চলমান এবং কিছু প্রকল্প ও কর্মসূচী প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রী আহম মুস্তাফা কামাল বলেন, সরকার সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এর মূল উদ্দেশ্য উন্নয়ন জোয়ারে আরো বেশি জনগণকে সম্পৃক্ত করা। এ জন্য মাদকমুক্ত জাতির বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্তি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, বর্তমানে এই প্রভাব অতটা বোঝা না গেলেও সুদূরপ্রসারী অনেক প্রভাব রয়েছে। প্রাথমিক স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। একটি সময় ছিল যখন সমাজের বিত্তশালী পরিবারের ছেলেমেয়েদের মধ্যে এর আসক্তি ছিল কিন্তু বর্তমানে তা ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র। এর কবল থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, একশ্রেণীর চোরা কারবারি একটি বড় সিন্ডিকেট তৈরি করে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অমান্যের মাধ্যমে তাদের ব্যবসাকে কৌশলে সম্প্রসারিত করছে। এতে একদিকে সরকার প্রচুর রাজস্ব হারাচ্ছে অপরদিকে তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের যে উদ্দেশ্য তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যার ফলে পরোক্ষভাবে জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে পতিত হচ্ছে। তাই জনস্বাস্থ্য রক্ষায় অবিলম্বে দেশে চোরাচালানকৃত সিগারেট বন্ধ ও বাজেয়াপ্ত করে তা ধ্বংস করা উচিত।
তিনি বলেন, একইসঙ্গে এই অবৈধ ব্যবসার ফলে সরকার প্রতিবছর পাঁচ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। বৈঠকে জানানো হয়, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে বর্তমানে মাদকসেবীর সংখ্যা অন্তত দেড় কোটি। মাদকসেবীরা গড়ে প্রতিদিন অন্তত ২০ কোটি টাকার মাদক সেবন করে থাকে। হিসাব অনুযায়ী মাসে ৬০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে সারা দেশে প্রায় ৩০ লাখ মাদক ব্যবসায়ী প্রতিদিন কমপক্ষে প্রায় ২০০ কোটি টাকার মাদক কেনাবেচা করে।
আরো একটি ভয়ঙ্কর চিত্র হচ্ছে, সারা দেশের ছড়িয়ে পড়া ইয়াবার শতকরা ৮৫ ভাগই ভেজাল। যার ফলে এসব ইয়াবা গ্রহণকারী মাদকাসক্তরা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তার মধ্যে কিডনি, লিভার ছাড়াও মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজকর্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, শতকরা ৮০ ভাগ খুনের সঙ্গে মাদকাসক্তরাও কোনো না কোনোভাবে জড়িত।
মাদকাসক্তদের পুনর্বাসনের বিষয়ে বক্তারা বলেন, মাদক নির্ভরশীল ব্যক্তির চিকিৎসার সব পর্যায়ে পরিবারের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা প্রয়োজন। মাদক নির্ভরশীল ব্যক্তি স্বভাবতই চিকিৎসা নিতে চায় না। কারণ সে বুঝাতেই পারে না, তার চিকিৎসার প্রয়োজন।
আবার অনেকেই শারীরিক যন্ত্রণার ভয়ে মাদক চিকিৎসায় অনীহা পোষণ করে। এ ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত সহমর্মিতামূলক আচরণের মাধ্যমে তাকে চিকিৎসা নিতে আগ্রহী করে তুলতে হবে।
মাদক নির্ভরশীল ব্যক্তিকে সঠিকভাবে পরিচর্যা করতে না পারলে যে কোনো সময় তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। মাদকাসক্তি চিকিৎসায় ব্যক্তির নিজ ও তার পরিবারের সার্বিক সহযোগিতাসহ সেবা প্রদানকারী সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ভালো করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি তবে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই, আমাদের এই সচেতনতা এবং সহযোগিতা যুবসমাজকে যুবশক্তিতে পরিণত করবে।
যৌথভাবে এ আলোচনার আয়োজন করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং প্রমিসেস মেডিকেল লিমিটেড।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খন্দকার রাকিবুর রহমান। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন চ্যানেল আই টিভিতে তৃতীয় মাত্রা’র উপস্থাপক জিল্লুর রহমান।
গোলটেবিল আলোচনায় আরো অংশ নেন আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হক, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক শামীম মোহাম্মদ, এফবিসিসিআই সভাপতি মাতলুব আহমাদ, ড. সাদেকা হালিম, বিভিন্ন দৈনিকের সম্পাদক, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ, মেহতাব খানম, শামা ওবায়েদ, সঙ্গীতশিল্পী ফকির আলমগীর প্রমুখ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন