সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ি শিল্প। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ২০ মে থেকে দুই মাস সাগরে মাদার (মা বাগদা) মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ায় এই সঙ্কটের সৃষ্টি। ভীষনভাবে উদ্বিগ্ন সাতক্ষীরার চিংড়ি চাষিরা।
এদিকে, সরকারের এই নিষেধাজ্ঞার সুযোগ নিয়ে একটি স্বার্থন্বেষী মহল ভারত থেকে অবৈধ পথে ভাইরাস যুক্ত নিম্নমানের ছোট রেনু পোনা বা নপ্লি সাতক্ষীরার বিভিন্ন সীমান্ত পথে দেশে এনে নার্সিং করে বাজারে বিক্রির পায়তারা শুরু করেছে। ভারতীয় নার্সিং করা ভাইরাস যুক্ত এসব চিংড়ি পোনা মাছের ঘেরে ছাড়লে ক্ষতিগ্রস্থ হবে চাষিরা। ফলে হুমকির মুখে পড়বে দেশের চিংড়ি শিল্প।
ভাইরাস যুক্ত এই ভারতীয় পোনা বাজার থেকে কিনে প্রতারিত হবেন চিংড়ি চাষিরা। এই পোনা ঘেরে ছাড়ার কিছুদিন পর মাছে মড়ক দেখা দেয়। ফলে এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে ঘেরের সমস্ত চিংড়ি মরে সাবাড় হয়ে যায়। এতে সর্বশান্ত হতে পারে সাতক্ষীরা ও খুলনা অঞ্চলের অনেক মাছ চাষি।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য দপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলার সাতটি উপজেলায় ৬৬ হাজার ৯১০ হেক্টর জমিতে ৫৫ হাজার ১২২টি ছোট বড় চিংড়ি ঘের রয়েছে। চলতি ২০১৯ মৌসুমে চিংড়ি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৭ হাজার ৫শ’ মেট্রিক টন। এসব ঘেরে চিংড়ি পোনার চাহিদা রয়েছে ৩৩৪ কোটি। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ৫৬টি এবং খুলনা অঞ্চলে ২৭টি মিলে দেশে মোট চিংড়ি পোনা উৎপাদনকারি হ্যাচারি রয়েছে ৮৩ টি। এছাড়া নার্সারি রয়েছে ১৮২টি।
চিংড়ি উৎপাদন কোম্পানির এক ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানিয়েছেন, সাগরে এমনিতেই মাদার সঙ্কট চলছে। টাকা দিলেও মাদার মিলছে না। মাদার সঙ্কটের কারণে কক্সবাজার ভিত্তিক চিংড়ি পোনা উৎপাদনকারি অধিকাংশ হ্যাচারি ভরা মৌসুমে উৎপাদনে যেতে পারছে না। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার ভিত্তিক ৫৬টি হ্যাচারির মধ্যে বর্তমানে ২১/২২ টি হ্যাচারি চালু আছে। এসব হ্যাচারিতে যে পরিমান পোনা উৎপাদন হচ্ছে তা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। ফলে বাজারে এখন চিংড়ি পোনার সঙ্কট রয়েছে।
এরই মধ্যে সরকার চলতি মে মাসের ২০ তারিখ থেকে আগামী দুই মাসের জন্য সাগরে মাদার (মা বাগদা) ধারার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। এই দীর্ঘ সময়ে মাদার ধারা বন্ধ থাকলে বাজারে পোনার সঙ্কট আরো বৃদ্ধি পাবে। ফলে চিংড়ি চাষের ভরা মৌসুমে ঘেরে পোনা ছাড়তে না পেরে ক্ষতিগ্রস্থ হবে চাষিরা। একই সাথে ক্ষতিগ্রস্থ হবে দেশের চিংড়ি শিল্প। যার প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতির উপর। তিনি দেশের চিংড়ি চাষি ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থে সাগরে মাদার ধরা বন্ধ রাখার সরকারি সিদ্ধান্ত পুনঃবিবেচনার দাবি জানান।
বাংলাদেশ মৎস্যচাষি সমিতির সভাপতি সাবেক মৎস্য প্রতিমন্ত্রী ডা. আফতাবুজ্জামান জানান, চিংড়ি চাষের এই ভরা মৌসুমে মাদার ধরা বন্ধ থাকলে বাজারে পোনার সঙ্কট দেখা দিবে। এই সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ভারত থেকে নপ্লি (ছোট পোনা) এনে তা বড় করে বাজারে বিক্রি করবে। এতে করে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তাছাড়া ভারতীয় ব্যবসায়ীরা অবৈধ পথে সব চেয়ে নিম্নমানের নপ্লিটা বাংলাদেশে পাঠায়। যে কারণে এই পোনা ঘেরে ছাড়ার কিছুদিন পর ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয় চাষিরা।
চাষি ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থে সাগরে মাদার ধরা বন্ধের সময়টা আরো পিছিয়ে দিতে হবে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, এই ক্ষেত্রে চিংড়ি চাষি, ব্যবসায়ী ও হ্যাচারি মালিকদের সাথে আলাপ আলোচনা করার দরকার ছিল।
সাতক্ষীরার আকরাম হোসেন, আব্দুর রউফ, ফজলুর রহমানসহ একাধিক ঘের ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, ঘেরে চিংড়ি ছাড়ার এই সময়টাই উপযুক্ত। তিন/চার মাস আগে যে মাছ ঘেরে ছাড়া হয়েছিলো সে মাছ এখন বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। এরপরে যে মাছ ঘেরে উৎপাদন করা হবে সেই মাছের রেনু এখন ছাড়তে হবে। এখনকার এই ভরা মৌসুমে যদি বাজারে চিংড়ি রেনুর সঙ্কট দেখা দেয় তাহলে আমরা ঘের ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে দারুন ক্ষতিগ্রস্থ হবো।
তারা বলেন, সাতক্ষীরা জেলায় হাজার হাজার বিঘা জমিতে চিংড়ি চাষ করা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানসহ বিদেশে এই জেলার মাছ রপ্তানি করা হয়ে থাকে। যা থেকে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব পেয়ে থাকে। তারা বলেন, আমরা ভীষনভাবে উদ্বিগ্ন।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম সরদার জানান, সাগরে দুই মাস মাদার ধরা বন্ধ থাকলে প্রথম একমাস বর্তমান পোনা দিয়ে চলবে। তবে পরের এক মাস একটু অসুবিধা হবে। এসময়ে পাশবর্তী দেশ ভারত থেকে নিম্নমানের চিংড়ি রেনু, নপ্লি, পিএল ও চিংড়ি বিভিন্ন পন্থায় দেশের অভ্যন্তরে ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষে ব্যাপক মড়ক এবং রপ্তানী বন্ধের জন্য এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারে বা যাচ্ছে।
বিষয়টি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করবে এবং চিংড়ি উৎপাদন ও রপ্তানিতে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, বিদেশী চিংড়ি রেনু, নপ্লি, পিএল ও চিংড়ি সীমান্ত দিয়ে আমাদের দেশে অনুপ্রবেশ বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সাতক্ষীরাস্থ বিজিবি ৩৩ ও ১৭ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক বরাবর চিঠি দেয়া হয়েছে। এই চিঠির অনুলিপি মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দপ্তরে দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন