১৮৫৮ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে ইংরেজদের পক্ষে গাদ্দার মির্জা এলাহী বখশ সেই ভ‚মিকাই পালন করে যা ১৭৫৭ সালে মির্জাফর (মির জাফর) করেছিল নবাব আলীবর্দি খানের নাতি নবাব সিরাজদ্দোলাকে পলাশী প্রান্তরে শহীদ করার মাধ্যমে। তারই প্রধান সেনাপতি মির্জাফরের ষড়যন্ত্রে পূর্বাঞ্চলকে তুলে দেওয়া হয় বৃটিশদের হাতে। একশ বছর পর ১৮৫৭ সালের মে মাসে খলনায়ক মির্জা এলাহী বখশ ইংরেজদের যোগসাজশে মোগল সা¤্রাজ্যের সর্বশেষ স¤্রাট আবু জাফর সিরাজুদ্দীন মোহাম্মদ বাহাদুর শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে গ্রেফতার করানো, পরে রেঙ্গুনে নির্বাসিত করা হয় এবং তিনি অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থায় ১৮৬৪ সালের ৭ নভেম্বর রেঙ্গুনে ইন্তেকাল করেন। তিনি ৬৪ বছর বয়সে ১৮৩৭ সালে সিংহাসন লাভ করেন এবং ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত ২০ বছর ক্ষমতাসীন ছিলেন। ১৮৫৭ সালের এ স্বাধীনতা যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১০ মে (মতান্তর ১২ মে)। ১৮৫৭ সালে তাকে রেঙ্গুনে নির্বাসনের সময় তার সঙ্গে ছিলেন নারী-পুরুষ ১৬ জন। এ স্বাধীনতা যুদ্ধের কাহিনী সংক্ষেপে এই; কালের পাতার অনেক লেখাই মুছে যায়। আর এমন বহু বহু লেখা আছে যা মুছে না। কাহিনীর পর কাহিনী লেখা হয়, জমা হয় এবং ইতিহাস গড়ে ওঠে।
সে সব ইতিহাসের সমস্তই সুকীর্তির কাহিনী নয়। সুকীর্তির কাহিনীও ইতিহাসে আছে, কিন্তু দুস্কৃতির যেসব কাহিনী জমা হয়ে আছে, তার তুলনায় সুকীর্তির কাহিনী অনেক কম। ইতিহাসের পাতায় মানুষের শঠতা ও স্বার্থপরতা যে সব কাহিনী জমে উঠেছে, তার সংখ্যা অনেক বেশি। এমনই শঠতার কাহিনীর কোন কোনটি মানুষের নিকট খুবই সুপরিচিত হয়ে আছে। শঠ ও ষড়যন্ত্র পরায়ণ কোন কোন ঐতিহাসিক চরিত্র প্রবাদ বাক্যের মত হয়ে রয়েছে। অপরের নিন্দা করার প্রয়োজন হলে লোকে তাদের নাম ধরে তুলনা দিয়ে থাকে।
মূলত: ইতিহাসের পতনের যুগেই এ সকল শঠ ও ষড়যন্ত্র পরায়ণ লোকেদের স্বাভাবিক বিচরণ ক্ষেত্র। মোগল সাম্রাজ্যের পতনের যুগে এমনই বহু ব্যক্তির অভ্যত্থান ঘটেছে এবং মোগল সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরান্বিত করেছে। পরিণামে সেই সা¤্রাজ্যকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে। ১৮৫৭ সালে যখন বিধ্বস্ত মুসলিম শক্তির মধ্যে নব জাগরণের চেতনা সঞ্চারিত হয়, সে সময় কিছু সংখ্যক ষড়যন্ত্রকারী, মোনাফেক অতিমাত্রায় তৎপর হয়ে উঠে ও তাদের চক্রান্ত নবজাগ্রত মুসলিম শক্তিকে দুর্বল হতে দুর্বলতর করার কাজে সহায়তা করে।
মিরাটে সেপাহীদের সাফল্যজনক অভ্যুত্থানের পর তারা দিল্লী গমন করে এবং স¤্রাট বাহাদুর শাহের আনুগত্যও স্বীকার করে। বখত খাঁ বিদ্রোহী সেপাহীদিগকে সুসংগঠিত করেন এবং তাদের সেনাপতির পদে বরিত হন। বখত খাঁর নেতৃত্বে বিদ্রোহী সেপাহীদের সংগ্রাম যখন জোরদার হয়ে উঠতে থাকে তখন চক্রান্তকারীরা সম্রাট বাহাদুর শাহ ও বখত খাঁর মধ্যে ভাঙ্গন ধরানোর জন্য তৎপর হয়ে উঠে। তাদের এই চক্রান্ত সফল হয় এবং বখত খাঁ সেনাপতির পদ হতে অপসারিত হন।
স্বাধীনতা সংগ্রামে যে সাফল্যের সূচনা হয়েছিল, তারপর হতে তার গতি পরিবর্তিত হয়ে যায়। যুদ্ধরত সেপাহীরা দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে এবং দিল্লীর উপর ইংরেজ সৈন্যদের আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। এ সময় যে বিশ্বাসঘাতক সর্বাধিক পরিমাণে তৎপর হয়ে উঠে তার নাম মির্জা এলাহী বখশ। মির্জা এলাহী বখশ অত্যন্ত ধুরন্ধর ও খল প্রকৃতির লোক ছিল। ঐতিহাসিকেরা মনে করেন যে, বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাসে মির্জা এলাহী বখশের স্থান অদ্বিতীয়। সে অতি কৌশলে সম্রাট বাহদুর শাহকে সেপাহীদের আশ্রয় হতে সরিয়ে দিয়ে ইংরেজদের হাতে ধরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে।
কথিত আছে, মোজাহেদ বাহিনী যখন ইংরেজ সৈন্যদের সাথে মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত, সে সময় মির্জা এলাহী বখশ বাহাদুর শাহকে পরামর্শ দেয় যে, হুমায়ুনের কবরস্থান দিল্লীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। তিনি যদি সেখানে আশ্রয় গ্রহণ করেন তা হলে কেউ তার কেশ স্পর্শ করতে পারবে না।
বাদশাহ এসব লোকের পরামর্শ গ্রহণ করেন। মোজাহেদ বাহিনীর নেতৃবৃন্দ বারবার তাকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন যে, তিনি যেন তাদের সঙ্গ ত্যাগ না করেন। কিন্তু বাদশাহ শেষ পর্যন্ত তাদের কথা রাখেননি। মির্জা এলাহী বখশের ন্যায় লোকের কথায় তিনি ভুলে যান এবং নিরাপদ মনে করে হুমায়ুনের সমাধিস্থানে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
মির্জা এলাহী বখশ যথাসময়ে এই সংবাদ ইংরেজ শিবিরে পৌঁছে দেয়। ইংরেজরা তাকে এই উদ্দেশ্যেই নিয়োগ করেছিল। সংবাদ শুনে তারা নিশ্চিত হল যে, তাদের উদ্দেশ্য হাসেল হয়েছে। বাদশাহ মোজাহেদ বাহিনী হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন এবং হুমায়ুনের কবর স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন এই সংবাদ শুনে ইংরেজরা হুমায়ুনের কবরস্থান ঘেরাও করে ফেলে। সেখানে তারা মোগল সা¤্রাজ্যের শেষ বাদশাহ বাহাদুর শাহকে গ্রেফতার করে। সেখান হতে তারা তাকে ‘জিনত’ মহলে নিয়ে যায় এবং সেখানে তাকে বন্দী রাখা হয়। বাদশাহ গ্রেফতার হওয়ার পর মির্জা এলাহী বখশ দেখল যে, তার কাজ অনেকখানি হয়ে গিয়েছে। তবে আরও এনাম পেতে হলে তাকে আরও কিছু কাজ করতে হবে। শাহজাদারা তখনও হুমায়ুনের কবরস্থানে। তাদেরকেও ধরিয়ে দেওয়া দরকার।
মির্জা খিজির, সুলতান মির্জা, আবু বকর এবং মির্জা মোগলও হুমায়ুনের কবরস্থানে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। বাহাদুর শাহ গ্রেফতার হওয়ার পরও তারা সেখানে থেকে যান। তাদেরকে গ্রেফতার করার জন্য মির্জা এলাহী বখশ ইংরেজদেরকে উস্কে দিতে থাকে। এতে উৎসাহিত হয়ে মেজর হার্ডসন পুনরায় হুমায়ুনের কবরস্থান অবরোধ করে। সেই সময় মির্জা এলাহী বখশ শাহজাদাদেরকে বের হয়ে এসে আত্মসমার্পণ করার জন্য প্ররোচিত করে। সে তাদেরকে বলে যে, তারা বের হয়ে আসলে ইংরেজরা তাদেরকে গ্রেফতার করবে না এবং তাদের কোন ক্ষতিও করবে না। সে ইংরেজদের সাথে এই ব্যবস্থা করে নিয়েছে।
মির্জা এলাহী বখশ এর ধাপ্পাবাজিতে শাহজাদারা কবরস্থানের বাইরে চলে আসেন। তারা আত্মসমার্পণ করলে ইংরেজ মেজর তাদেরকে একটি সোয়ারীতে আরোহণ করতে বলে। সোয়ারী ফিরুজ কুটলার নিকট আসে। মেজর হার্ডসন শাহজাদাদেরকে শরীর হতে রাজকীয় পোশাক খুলে ফেলার নির্দেশ দেয়। তারা ইতস্তত: করলে মেজর হার্ডসন জানায় যে, তাদের কোন ক্ষতি করা হবে না। কিন্তু তারা পোশাক খুলে ফেলা মাত্রই বন্দুকের গুড়–ম গুড়–ম শব্দ হয়। হতভম্ভ শাহজাদারা এই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিবাদ করারও সুযোগ পায়নি। নিমেষে তাদের প্রাণহীন দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
মির্জা এলাহী বখশ এর বিশ্বাসঘাতকতার এই পরিণতি তার পৈশাচিক হৃদয়কে বিচলিত করতে পারেনি। মির্জা এলাহী বখশ এর বিশ্বাসঘাতকতা ও মেজর হার্ডসনের নৃশংস নিদর্শন হিসাবে দিল্লীর কোতওয়ালীর চবুতরায় মির্জা খিজি, সুলতান মির্জা, আবু বকর ও মির্জা মোগলের লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়। মে মাসের আগমন ঘটলে মোগল সাম্রাজ্যের পতনের সেই নির্মম কাহিনীর কথা স্মরণ না করে পারা যায় না। ১০ মে মতান্তরে ১২ মে ছিল সর্বশেষ মোগল সম্রাট বাহারদুর শাহ এর পতনের ঘটনা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন