পবিত্র কোরআনের সুরা কাদর ১-৫ আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- ১। আমি ইহা অবতীর্ণ করেছি মহিমান্বিত রজনীতে; ২। আর মহিমান্বিত রজনী সম্বন্ধে তুমি কি জান? ৩। মহিমান্বিত রজনী সহ¯্র মাস (অর্থাৎ ৮৩ বৎসর ৪ মাস) অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। ৪। সে রাতে ফিরিশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাহাদিগকে প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। ৫। শান্তিই শান্তি, সেই রজনী উষার আবির্ভাব পর্যন্ত।
রমজানুল মোবারকের রাত্রি সমূহের মধ্যে একটি রাত্রিকে ‘‘শবে কদর’’ বলা হয়। উহা বড়ই খাইর ও বরকতের কল্যাণময় রাত। কালামে পাকে উক্ত রাতকে এক হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম বলা হয়েছে। এক হাজার মাসে ৮৩ বছর ৪ মাস হয়। ভাগ্যবান ঐসব লোক যাদের উক্ত রাত্রির ইবাদত বন্দেগী নসীব হয়। কেননা এই একটি মাত্র রাত যে ইবাদতে কাটালো সে যেন ৮৩ বছর ৪ মাসের চেয়ে বেশি সময় ইবাদতে কাটালো। আর এই বেশির অবস্থাও জানা নাই যে উহা হাজার মাস অপেক্ষা কত মাস অধিক উত্তম। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বনিয়ন্তা আল্লাহ পাকের সেরা অবদান শবে-কদর। আল্লাহ পাক সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াতে নিজেই বলেছেন যে, পবিত্র রমযান মাসে কুরআন মজীদকে অবতীর্ণ করা হয়েছে যে তিনি কদরের রাত্রিতে কুরআন পাক নাযিল করেছেন। ‘‘দূররাতুন নাসেহিন’’ কিতাবে উল্লেখ আছে যে, নবী করিম (সাঃ) বনী ইসরাইলের সামউন গাজীর (রঃ) কথা উল্লেখ করে বলেন যে, তিনি এক হাজার মাস পর্যন্ত আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতেন এবং কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদের জন্য এক উটের বাহন অস্ত্র সঙ্গে রাখতেন, দিনের বেলা রোজা রাখতেন এবং সারারাত ইবাদতে কাটাতেন। এর প্রতি সাহাবাগণের মনে ঈর্ষা ও হতাশার ভাব দেখা দিলে আল্লাহতায়ালা উহার ক্ষতিপূরণস্বরূপ কেবলমাত্র উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য সেরা অবদান শবে কদর দান করে সুরা কদর নাযিল করেন। হযরত আইয়ুব (আঃ), হযরত যাকারিয়া (আঃ) প্রত্যেকেই ৮০ বছর পর্যন্ত আল্লাহপাকের ইবাদতে অতিবাহিত করেন, মুহূর্তের জন্যও আল্লাহর নাফরমানী করেননি। কাজেই শবে কদরের একটি বিশেষ রাতে যে ইবাদত বন্দেগীতে কাটালো সে যেন মহা সৌভাগ্যবান এবং উক্ত রাতে যে ব্যক্তি আল্লাহর করুনা ও কল্যাণ হতে বঞ্চিত থাকে সে সর্বহারা ও চিরবঞ্চিত। উক্ত রাতে ফেরেস্তা এবং রূহ আল্লাহর রহমত ও করুণা নিয়ে জমিনে অবতরণ করেন। উক্ত রাতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কেবল শান্তি আর শান্তি এবং উক্ত রাতে বরকত ও কল্যাণ ভোর পর্যন্ত থাকে। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে বলা হয় যে ব্যক্তি মহিমান্বিত শবে কদরে ঈমান সহকারে ও সওয়াবের নিয়্যতে ইবাদত করার জন্য দন্ডায়মান হয় তার বিগত জীবনের গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) হতে বর্ণিত হাদীসে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন যে, রমযানের শেষ দশ দিনের যে কোন বিজোড় রাত্রিতে শবে কদর তালাশ কর। বোখারী শরিফের অপর হাদীসে পাওয়া যায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবীগণকে শবে কদরের সুনির্দিষ্ট সংবাদ দেয়ার জন্য বাইরে আসেন। কিন্তু সেই সময় দু›জন মুসলমানের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছিল বলে উহার নির্দিষ্টতা আল্লাহর তরফ থেকে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে, অর্থাৎ ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। হাদীসের বিশেষ শিক্ষণীয় এই যে দু›জন মুসলমানের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ কঠিন অপরাধ। উহার জন্য কল্যাণ ও বরকত উঠিয়ে নেয়া হয়, পারস্পরিক সুসম্পর্ক সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, আর পরস্পর কলহ বিবাদ দ্বীনকে ধ্বংস করে যেমন ক্ষুর মাথার চুলকে বিনাশ করে। হযরত কাব (রাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি এই আল্লাহর একত্ববাদে অটলভাবে বিশ্বাস স্থাপন করে ঐ রাতে তিনবার ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’’ পড়বে, প্রথম বার পাঠ করার বদৌলতে তাকে ক্ষমা করা হবে, দ্বিতীয়বার পড়ার কারণে সে নরক থেকে পরিত্রাণ লাভ করবে এবং তৃতীয়বার বলার কারণে সে বেহেস্তে প্রবেশ করবে। অপরদিকে পিঠে পাহাড় তুলে দিলে যেরূপ ভারী মনে হবে মোনাফেক, মুশরেক ও কাফেরের জন্য লাইলাতুল কদর সেরূপ ভারী মনে হবে।
শবে কদরের শিক্ষা ও মহিমা অপার। এই রাতেই লাওহে মাহফুজ হতে প্রথম আকাশে কোরআন মজীদ নাযিল করা হয়। ধরাবাসীর কল্যাণ পরিবেশনের উদ্দেশ্যে রুহুল কুদ্দুস তথা হযরত জীবরাঈল (আঃ) অসংখ্য ফেরেস্তাসহ আল্লাহর নির্দেশে ধরায় অবতরণ করেন, উক্ত রজনীতে আধ্যাত্মিক ও জৈবিক উন্নতি ও কল্যাণ বৃদ্ধির এক বর্ষা মুখর রাতে বৃষ্টির ধারার মত বর্ষণ হতে থাকে। ঐ রাতে সংশ্লিষ্ট বছরে সম্পাদনীয় বিশ্ব ব্যবস্থায় যাবতীয় উল্লেখযোগ্য বিধি ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়ে থাকে। ঐ রাত শান্তি ও সান্তনার রাত, নিরাপত্তার রাত, আল্লাহর বিশিষ্ট বান্দাগণ উক্ত রাতে এক অনির্বচনীয় শান্তি ও মাধুর্য উপভোগ করে থাকেন। বিখ্যাত তফসীরে কাদেরীতে উল্লেখ আছে যে ইমাম শাফী (রাঃ) রমযানের ২১ ও ২৩ রাত্রিতে শবে কদর উদযাপনে বেশি গুরুত্ব প্রদান করেন,অধিকাংশ আলেমগণ এবং হানাফী মাযহাবে ২৭শে রাত্রিতে শবে কদর উদযাপনের উপর বেশি গুরুত্ব দেন। কারণ স্বরূপ ব্যাখ্যা করা হয় যে, আরবী লাইলাতুল কদরে নয়টি অক্ষর রয়েছে এবং সুরা কদরে লাইলাতুল কদর কথাটি তিনবার নির্ধারিত হয়েছে। কাজেই (৯*৩)=২৭ অক্ষর ইশারা করা হয়েছে যে, রমজান মাসের ২৭শে রাত্রিতেই শবে কদর পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি এবং মুসলিম বিশ্বে রমযান মাসের ২৭শে রাত্রিতে শবে কদর রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপন করা হয়ে থাকে। রমযান মাসে যারা জামাতের সাথে নিয়মিত তারাবীর নামাজ, এশার নামাজ ও ফজরের নামাজ আদায় করেন তারা শবে কদরের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হন না।
রমযান মাসের শেষ দশকে যারা সুন্নতে মোয়াক্কাদা কেফায়া হিসাবে মসজিদে এতেকাফ পালন করেন তারা অবশ্যই শবে কদরের রাত পেয়ে থাকেন। সব রকম পাপাচার ত্যাগ করে মানব মনের পশু প্রবৃত্তিকে ও ষড় রিপুকে দমন করে পূর্বের পাপরাশির স্মরণে অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়ে এই মহান রজনীতে একাগ্রচিত্তে আল্লাহর নিকট পাপের মার্জনা ভিক্ষা করতঃ আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীতে উক্ত রাত অতিবাহিত করা ঈমানদার বান্দাগণের মহান কর্তব্য। সর্ব প্রকার পাপকর্ম, পাপ প্রেরণা ও সামাজিক বিশৃক্মখলা বিসর্জন দিয়ে দৈহিক ও মানসিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য শবে কদরের মহান রাতের সদ্ব্যবহার করা প্রত্যেক ঈমানদার মানুষের একান্ত কর্তব্য এবং এতেই বিশ্বশান্তি ও মানব কল্যাণ নিহিত। আল্লাহ আমাদিগকে শবে কদর রাতের সদ্ব্যবহার করার তৌফিক দিন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন