রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

ইসলামে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক

প্রকাশের সময় : ৩১ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মাহবুবুর রহমান নোমানি
সব যুগে এবং সব দেশে শ্রমিক তার সামাজিক মর্যাদা ও যথাযোগ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এমনকি আজকের শিক্ষিত সমাজ পর্যন্ত শ্রমকে অত্যন্ত হীন ও নীচকর্ম জ্ঞান করে থাকেন। পুঁজির মালিককে মনে করা হয় অভিজাত শ্রেণির লোক, আর শ্রমের মালিককে মনে করা হয় নি¤œ শ্রেণির। ইসলাম এই কৃত্রিম আভিজাত্যবোধ ও সামাজিক বৈষম্যের বেদীমূলে কুঠারাঘাত করেছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘মানুষের স্বহস্তে উপার্জিত খাবার সর্বোত্তম খাবার। আল্লাহর পয়গাম্বর হজরত দাউদ (আ.) স্বহস্তে উপার্জন করে আহার করতেন। (বোখারি শরিফ) পবিত্র ইসলাম যে কোনো শ্রমের উপার্জনকে সর্বোত্তম ঘোষণা করে শ্রমকে অতি উচ্চ মর্যাদায় মূল্যায়ন করেছে। তদুপরি আল্লাহতায়ালা তার পয়গাম্বরদেরকে শ্রমের কাজ করিয়ে এর মর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি করেছেন। বর্ণিত আছে, আদি মানব হজরত আদম (আ.) চাষাবাদ করেছেন। হজরত নূহ (আ.) ও যাকারিয়া (আ.) কাঠমিস্ত্রী ছিলেন। হজরত ইদ্রিস (আ.) দর্জি, দাউদ (আ.) কর্মকার আর মূসা (আ.) রাখাল ছিলেন। এমনকি বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিজেও রাখালী করে শ্রমিকের প্রতি সমাজের অহেতুক ঘৃণাবোধকে সমূলে উৎখাত করে দিয়েছেন। ইসলামই একমাত্র ধর্ম যা শ্রমিকের ব্যক্তিস্বাধীনতা, সামাজিক মর্যাদা এবং ন্যায়সঙ্গত অধিকার নিশ্চিত করেছে।
শ্রমিক নির্যাতন ও শোষণ, নিপীড়নের সকল পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে ইসলাম। এমনকি মালিক ও শ্রমিকের ভেদাভেদ দূর করে সকলকে এক কাতারে দাঁড় করিয়েছে। এ মর্মে প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। সুতরাং যার কোন ভাইকে তার অধীন করে দেয়া হলো, সে নিজে যা আহার করবে তাকেও তা আহার করতে দেবে এবং নিজে যা পরিধান করবে তাকেও তা পরিধান করতে দেবে। আর তাকে এমন কাজ করতে বাধ্য করবে না যা করলে সে পর্যুদস্তু হয়ে পড়বে। হ্যাঁ, কোনো কঠিন কাজে তাকে বাধ্য করা হলে তাকে সহযোগিতা করবে। (বোখারি) এ হাদিসে শ্রমিকের যথাযোগ্য মর্যাদা ও অধিকার চিত্রায়ণ করা হয়েছে। শ্রমিকের মর্যাদাকে মালিকের সমপর্যায়ভুক্ত করে দেয়া হয়েছে। শ্রমিক ও মালিকের মাঝে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কের কথা বলে আভিজাত্যের পর্দা উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। শ্রমিক ও মালিকের মাঝে বর্ণ বৈষম্য তিরোহিত করা হয়েছে। শ্রমিকের খাবার, বাসস্থান ও পোশাক-আশাক কিরূপ হবে এবং তার ওপর কি পরিমাণ কাজের ভার অর্পণ করা যাবে তাও ব্যক্ত করা হয়েছে।
মুজুরি ও পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রে ইসলাম কোনো অংক নির্ধারণ করে না দিলেও উক্ত হাদিসে এর ইঙ্গিত রয়েছে। অর্থাৎ পুঁজিদাতার সমমানের হওয়া বাঞ্ছনীয়। অন্তত মানুষ হিসেবে জীবন ধারনের জন্য যতটুকু প্রয়োজন সেই পরিমাণ মুজুরি অবশ্যই তাকে দেয়া কর্তব্য। রাসূল (সা.) বলেন, ‘শ্রমিক যখন তার কাজ সমাপ্ত করবে তখন তার পারিশ্রমিক পূর্ণমাত্রায় আদায় করবে। (মুসনাদে আহমদ) হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসূল (সা.) শ্রমিকের পারিশ্রমিকের ব্যাপারে কখনই জুলুম করতেন না।’ (বোখারি) তিনি স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন ‘শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই তার পারিশ্রমিক আদায় করে দাও’। (ইবনে মাজাহ) এ ক্ষেত্রে কোনো রকম টালবাহানা ইসলাম অনুমোদন করে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘বিত্তবানদের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও অন্যের পাওনা পরিশোধে টালবাহানা করা জুলুম বা অন্যায়’। (বোখারি ও মুসলিম) পারিশ্রমিক নির্ধারিত না করে শ্রমিক নিয়োগ দেয়া এবং পরে তাকে কম পারিশ্রমিক দেয়া ইসলাম সমর্থন করে না। কেননা এটা শ্রমিক শোষণের এক সূক্ষ্ম পদ্ধতি। রাসূলুল্লাহ (সা.) এভাবে শ্রমিক নিয়োগ করতে নিষেধ করেছেন। (বায়হাকি)
শ্রমিক যাতে সারাজনম শ্রমিকই না থাকে সেজন্য ইসলাম শ্রমিককে মালিকের সাথে যৌথ কারবারেও সুযোগ দিয়েছে। মুদারাবা জাতীয় পন্থায় শ্রমিক ও মালিকের চুক্তি হতে পারে। অর্থাৎ মালিক পক্ষ মূলধন নিয়োগ করবে আর শ্রমিক শ্রম দিয়ে যাবে। লভ্যাংশ দু’জনের মাঝে হারাহারিভাবে বণ্টিত হবে। মোটকথা ইসলাম শ্রমিক ও মালিকের মাঝে প্রভু ও দাসের সম্পর্কের পরিবর্তে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছে।                                                                                                                                          একজন উত্তম মালিক শ্রমিকের প্রতি কি ধরনের মনোভাব প্রদর্শন করবে তা আল্লাহপাক হজরত শুয়াইব (আ.) এবং মুসা (আ.)-এর ঘটনায় সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। মুসা (আ.) অনেক দিন পর্যন্ত শুয়াইব (আ.) এর নিকট গতর খেটে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। তাকে নিয়োগ করার সময়ে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, ‘আমি তোমার ওপর কষ্টের বোঝা চাপিয়ে দিতে চাই না। আল্লাহ চাহেতো, তুমি আমাকে সদাচারী হিসেবেই দেখতে পাবে।’ (সূরা কাসাস : ২৭) এ আয়াত থেকে স্পষ্ট হয়, মালিককে সজ্জন ও সহনশীল হতে হবে। শ্রমিকদের প্রতি ক্ষমা সুন্দর মনোভাব পোষণ করতে হবে। বর্ণিত আছে, ‘একদা জনৈক সাহাবি নবীজী (সা.) কে জিজ্ঞেস করেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! চাকর, খাদেমদের অপরাধ কতবার ক্ষমা করবো? নবীজী (সা.) শুনে চুপ রইলেন। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলে তিনি ব্যাকুল হয়ে বললেন, “প্রত্যেক দিন ৭০ বার হলেও তাকে ক্ষমা করে দিও”। আজকের পুঁজিপতিরা সামান্য ত্রুটির জন্য শ্রমিক চাটাই, চাকরি খেয়ে ফেলার হুমকি এমনকি জরিমানা হিসেবে বেতনের টাকা পর্যন্ত কর্তন করে রাখে। শ্রমিক শোষণের নানা পথ ও পন্থা উদ্ভাবন করে সেগুলোকে আইনের পোশাক পরিয়ে রেখেছে।
নবী করিম (সা.)-এর খাদেম আনাস (রা.) বলেন, “আমাকে একদিন রাসূল (সা.) কোন এক কাজে পাঠালেন। আমি ওই কাজে রওয়ানা হয়ে পথে ছেলেদের সাথে খেলায় লেগে গেলাম। সহসা নবী করিম (সা.) কোথা হতে এসে আমাকে ধরে ফেললেন। কিন্তু তিনি আমার প্রতি রুষ্ট হননি এবং আমাকে ভর্ৎসনাও করেননি। তিনি আরো বলেন, “আমি দশ বছর রাসূলুল্লাহর খেদমত করেছি। কিন্তু তিনি কোনো দিন আমাকে বলেননি, এটা এভাবে কেন করেছো, ওটা ঐভাবে কেন করোনি। (শামায়েলে তিরমিজি) নবীজী (সা.) খাদেমদের মানসিক অবস্থার প্রতি খেয়াল রাখতেন। তারা যেন বিমর্ষ না হয়ে পড়ে সেদিকে লক্ষ্য রাখতেন। তিনি তাদের মনোরঞ্জন করতেন, সুখ-দুঃখের কথা শোনতেন, সান্ত¡না দিতেন, আশ্বাসের বাণী শোনাতেন এবং অভিযোগের প্রতিকার করতেন। আজকের মালিকসমাজ যদি শ্রমিকদের খোঁজÑখবর নিজে থেকে নেয়, তাদের অভিযোগ-অনুযোগ শোনে, এবং আশ্বাসের বাণী শোনায় তাহলে মালিকদের সাথে তাদের সুমধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠবে। বন্ধ হবে শ্রমিক-মালিক সংঘর্ষ।
ইসলাম শুধু মালিককেই শ্রমিকের সাথে সদাচার, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার কথা বলেনি বরং শ্রমিককেও তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে দিয়েছে। মালিক তার পুঁজি ও মেধা ব্যয় করে, লাভ লোকসানের ঝুঁকি নিয়ে কর্মের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বলেই শ্রমিকের কর্মক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়েছে। অতএব, মালিকের এই অবদানের কথা স্মরণ রেখেই শ্রমিককে নিষ্ঠার সাথে কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে এবং মালিকের সম্পদ সংরক্ষণের ব্যাপারে তাকে যত্মবান হতে হবে। পবিত্র কোরআনে উত্তম শ্রমিকের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে এভাবেÑ ‘আপনার চাকর হিসেবে সেই উত্তম যে শক্তিশালী এবং বিশ্বস্ত। (সূরা কাসাস : ২৬) রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে শ্রমিক মালিকের কল্যাণকামী হয় তার উপার্জন উত্তম। (শরহে বোখারি) সুতরাং শ্রমিকের কর্তব্য হলোÑ মালিকের কল্যাণ কামনার মানসিকতা নিয়ে নিষ্ঠার সাথে কাজ করা। মালিকের সম্পদের হেফাজত করা। যদি তা না করা হয় তাহলে অকৃজ্ঞতা ও খেয়ানত হবে। মালিককে ধোঁকা দিলে বা  কাজে ফাঁকি দিলে কিংবা তার সম্পদ বিনষ্ট করলে কিয়ামত দিবসে আল্লাহর দরবারে জিজ্ঞাসিত হতে হবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘অবশ্যই তোমাদের কাজের ব্যাপারে তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে’। (সূরা নাহল : ৯৩)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন