আদালতপাড়ায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে জালিয়াতচক্র। সিন্ডিকেট তৈরি করে জামিন জালিয়াতি থেকে শুরু করে আদালত প্রাঙ্গণে নানা অবৈধ কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে তারা। বার কাউন্সিলের সনদ নেই, এমন ব্যক্তিরাও আইনজীবী সেজে মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে আদালতে আসা বিচারপ্রার্থীর সাথে প্রতারণা করছেন। ওইসব প্রতারকের সাথে আদালতের প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কেউ কেউ জড়িত রয়েছেন।
গত মাসে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে প্রশাসনিক কর্মচারীকে বরখাস্ত করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। এইসব চক্র মামলার প্রকৃত তথ্য গোপন রেখে, ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে জামিন নিয়ে আদালতকে বিভ্রান্ত করছে। ফলে খুন, ডাকাতি, মাদক কারবারির সঙ্গে জড়িত অনেক ভয়ঙ্কর আসামি ভুয়া জামিননামার মাধ্যমে জামিন নিয়ে চম্পট দিচ্ছে। উচ্চ আদালত থেকে শুরু করে সারা দেশে আদালতে বেশ কয়েকটি জালিয়াতি ও প্রতারণার ঘটনা ধরা পড়েছে।
স¤প্রতি ৭০ লাখ পিস ইয়াবা মামলার আসামি জামিন জালিয়াতির রায়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের নির্দেশ দেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। অপর একটি বেঞ্চ জালিয়াতির ঘটনায় আসামির জামিন বাতিল করেন। একই সঙ্গে ওই আসামিকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ইনকিলাবকে বলেন, আমরা দীর্ঘদিন খোঁজখবর নিয়ে এই টাউট-দালাল উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছি। এদের কারণে আদালতের প্রকৃত আইনজীবীদের প্রফেশনে সমস্যা হচ্ছে। জামিন জালিয়াতির ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয়। আদালত প্রাঙ্গণে এ ধরনের কর্মকান্ড কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কোনো আইনজীবী যদি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকেন, তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব। আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
আদালত সূত্রে জানা যায়, গত দুই মাসে উচ্চ-নিম্ন আদালতে ভুয়া নারী আইনজীবীসহ অন্তত ১২ জন টাউট-দালালকে শনাক্ত করেন আইনজীবীরা। ঢাকা জজকোর্ট থেকে শুরু করে এমনকি সর্বোচ্চ আদালতেও ভুয়া আইনজীবীসহ কয়েকজন দালালকে শনাক্ত করা হয়। এ নিয়ে সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণ থেকে টাউট-দালাল ও তাদের সহকর্মীদের নির্মূলের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন আইনজীবীরা। এ অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি।
হাইকোর্টের প্রশাসনিক ১ কর্মকর্তা বরখাস্ত : গত ৩০ মে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় দন্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. গোলাম ফারুককে বরখাস্ত করেছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। হাইকোর্ট বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. গোলাম ফারুককে দুদকের দায়ের করা বিশেষ মামলায় দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৬(২) ও ২৭ (১) ধারায় দন্ড প্রদান করা হয়।
গণকর্মচারী অধ্যাদেশ ১৯৮৫-এর ৩ (১) ধারার সাজা প্রাপ্তির কারণে বিদ্যমান অন্য যেকোনো আইনে অথবা বিধি, প্রবিধি, উপ-আইন, দলিলপত্র বা চুক্তি বা চাকরির শর্তাবলিতে যা কিছুই থাকুক না কেন, কোনো কর্মচারী তফসিলে বর্ণিত ফৌজদারি অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত হলে, রায় বা সাজার আদেশ ঘোষণার তারিখ হতে তাৎক্ষণিকভাবে চাকরি হতে বরখাস্ত হিসেবে গণ্য হবেন। প্রধান বিচারপতি এক আদেশে সাজার ৯ মে থেকে কোর্টের চাকরি থেকে তাকে বরখাস্ত করেন।
এর আগে মাসে জাল কাগজপত্র দিয়ে হাইকোর্ট থেকে জামিনের ঘটনায় যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত এক আসামির জামিন বাতিল করেছেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। একইসঙ্গে তাকে গ্রেফতার করার জন্য সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি নির্দেশ দেন। মাগুরায় ১৯৯৪ সালে আসাদুজ্জামান ও হান্নান হত্যার ঘটনায় আসামি মোয়াজ্জেম হোসেনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়। পরে পলাতক থাকা অবস্থায় আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলে তা নামঞ্জুর হয়। পরবর্তীতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ থেকে জাল কাগজপত্র দিয়ে গত ১৭ এপ্রিল জামিন নেন তিনি। বিষয়টি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ সরোয়ার কাজলের কাছে ধরা পড়লে তিনি আদালতের নজরে আনেন।
সুপ্রিম কোর্টে নারী টাউট আটক : গত মাসে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী পরিচয়ে প্রতারণাকারী এক নারী টাউট আটক করা হয়েছে। তানজিমা তাসকিন আদুরির বাড়ি রাজশাহী। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির মাধ্যমে তাকে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করা হয়। ওই নারী নিজেকে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করে আসছিলেন। জানা গেছে, বিভিন্ন নামে একাধিক ফেসবুক প্রোফাইল ব্যবহার করে সিনিয়র আইনজীবীদের সাথে ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করতেন।
ঢাকার আদালতপাড়ায় নারীসহ আটক ৪ : দীর্ঘদিন ধরে ওকালতনামা, বেলবন্ড, হাজিরা, কোর্ট ফি নকল ও জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত প্রতারকচক্রের এক নারীসহ তিন সদস্যকে গত ২৮ মে আটক করে ঢাকা আইনজীবী সমিতির টাউট উচ্ছেদ কমিটি। আটককৃতরা হলেন- হীরা ব্যাপারী, আবু ইউসুফ ওরফে সাইফুল, লাভলী আক্তার। এ ছাড়া এই চক্রের ওপর এক সদস্য জসিম পলাতক রয়েছেন। এ সময় তাদের কাছ থেকে নকল ওকালতনামা, হাজিরা, বেলবন্ড, ঢাকা বারের বর্তমান ও সাবেক সেক্রেটারির সিল, ঢাকা বারের লোগো, ওকালতনামায় ব্যবহৃত সিরিয়াল সিলসহ ৫ টাকা মূল্যর ৫৫০টি জাল কোর্ট ফি, ১০ টাকার জাল কোর্ট ফি ৩০টি, ২০ টাকা মূল্যের কোর্ট ফি ২৫০টি ও ২ হাজার জাল জামিননামা কাগজ এবং ৫০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।
এর আগে গত ১২ মে মোহাম্মদ ইউনুস নামে ঢাকা জজকোর্টের আইনজীবী পরিচয়ে প্রতারণাকারী এক টাউটকে আটক করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে আইনজীবী না হয়েও আইনজীবী সেজে চেম্বার নিয়ে গাউন পরে শুনানি করে আসছেন মোহাম্মদ ইউনুছ। আজ তাকে হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়েছে। জানা গেছে, ভিজিটিং কার্ডে নিজেকে জজকোর্ট ও হাইকোর্টের আইনজীবী দাবি করা এই টাউট রীতিমতো দু’টি চেম্বারের ঠিকানাও ব্যবহার করেছেন। যেখানে একটি জজকোর্টের এবং অপরটি হাইকোর্টের চেম্বার উল্লেখ করা হয়েছে।
গাজীপুর আদালতে ৪ টাউট আটক : গত ১৬ এপ্রিল গাজীপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালত প্রাঙ্গণ থেকে ৪ জন টাউটকে আটক করা হয়েছে। গাজীপুর আদালতে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এক বিচারপ্রার্থী জানান, এভাবে যদি প্রতিটি স্থানে শুদ্ধি অভিযান চালানো হয় তবে নিশ্চিত সম্মানহানির ভয়ে হলেও অনেকে সঠিক পথেই রাখত নিজেদের। সাধারণ বিচারপ্রার্থী হিসেবে আমরা চাই আইনজীবী সমিতি এসব টাউট নিধনে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করবে। এতে করে বিচারপ্রার্থীরা প্রতারণার হাত থেকে রেহাই পাবে।
সমিতির সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুর মোর্শেদ প্রিন্স আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, একটি এজাহার দায়ের করে আটক ৪ জনকে সদর থানা পুলিশের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। মঞ্জুর মোর্শেদ আরও জানান, এই ৪ টাউট কেউ আইনজীবী পরিচয় দিত আবার কেউ নিকাহ রেজিস্ট্রার পরিচয় দিয়ে আদালত প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়াত। বিচারপ্রার্থীদের বিভ্রান্ত করে অর্থ আত্মসাৎ করত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন