ফাঁসির মামলার জট বাড়ছে সুপ্রিম কোর্টের (মৃত্যু অনুমোদন সংক্রান্ত) ডেথ রেফারেন্স শাখায়। এতে করে মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে বছরের পর বছর কনডেম সেলে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন নিম্ন আদালতে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত ১ হাজার ৬০০ আসামি। মামলা সংখ্যা ৭৫২।
এদের মধ্যে অনেকেই ১১ থেকে ১৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে আটক রয়েছেন। কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক ফাঁসির মামলা উচ্চ আদালতে বিচারের জন্য অপেক্ষায়। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে ৭২১টি ও আপিল বিভাগে ৩১টি মামলা রয়েছে। দীর্ঘ সময় চূড়ান্ত বিচার না পেয়ে আসামিরাও যেমন নির্জন কারাগারের অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন তেমনিভাবে বিচারপ্রার্থীরাও দিনের পর দিন ঘুরছেন আদালতপাড়ায়।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৭ সালে ৬৪০টি, ২০১৬ সালে ৫৩৫টি, ২০১৫ সালে ৪১৯টি মামলা উচ্চ আদালতে বিচারের জন্য অপেক্ষায় ছিল। গত ১০ বছরে এসব মামলা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। বর্তমানে ২০১৪ সালের মামলার শুনানি চলছে।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা মনে করেন, প্রতি বছর মামলার নিষ্পত্তির হারের তুলনায় ডেথ রেফারেন্স আসছে বেশি। নি¤œ আদালতে স্পর্শকাতর মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হলেও হাইকোর্টে পেপার বুক তৈরিতে দীর্ঘসূত্রতা, পর্যাপ্ত সংখ্যক বেঞ্চের অভাব ও বিলম্বে শুনানি হওয়া এর প্রধান অন্তরায় বলে মনে করেছেন ফৌজদারি মামলার আইনজ্ঞরা। ফলে উচ্চ আদালতে ফাঁসির মামলা জট।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেযারম্যান ফৌজাদারি মামলার বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, ডেথ রেফারেন্স মামলার শুনানি বিলম্ব হওয়ার প্রধান কারণ সময়মতো পেপার বুক তৈরি না হওয়া। এসব মামলা নিষ্পত্তির জন্য অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়কেই উদ্যোগী হতে হবে।
একাধিক বেঞ্চের প্রয়োজন উল্লেখ করে এই আইনজীবী বলেন, বিলম্ব হওয়ার কারণে ফাঁসির আসামিকে দীর্ঘদিন কনডেম সেলে থাকতে হয়। আবার আপিল মঞ্জুর হলে আপিলের নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর সময় লাগে। এ ধরনের বিলম্বকে দুর্ভাগ্যজনক বলে দাবি করেন তিনি।
জাতীয় আইন সংস্থার প্যানেল আইনজীবী খবির উদ্দিন ভুঁইয়া ইনকিলাবকে বলেন, সাবেক প্রধান বিচাপতি এস কে সিনহার সময়ের এসব মামলা নিষ্পত্তিতে কিছুটা গতিশীল ছিল। এখন ফের ধীরগতি। মামলা অনুপাতে ডেথ রেফারেন্স বেঞ্চ আরো বাড়ানো উচিত। মৃত্যুদন্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিকে দীর্ঘদিন কনডেম সেলে রাখার ফলে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন, যা উচিত নয়। যত দ্রুত সম্ভব ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি হওয়া উচিত।
সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্ট বিভাগের ডেথ রেফারেন্স শাখার সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের ৭ এপ্রিল পর্যন্ত ৭২১টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এই সময়ে নিষ্পত্তি হয়েছে ৮৩টি মামলা। এ ছাড়া চলতি বছরের গত তিন মাসে আরো কিছু ডেথ রেফারেন্স মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। আরো ১৪০টি মামলা শুনানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে। ২০১৭ সালে ৬৪০টি, ২০১৬ সালে ৫৩৫টি, ২০১৫ সালে ৪১৯টি এবং ২০১৪ সালে ৩৬৩টি, ২০১৩ সালে ৪০৬টি, ২০১২ সালে ৪৫৬টি, ২০১১ সালে ৫৩৫টি, ২০১০ সালে ৫৪২টি ডেথ রেফারেন্স মামলা বিচারাধীন ছিল। গত ১০ বছরে এ ধরনের মামলা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। বর্তমানে ২০১৪ সালের ডেথ রেফারেন্স মামলার শুনানি চলছে।
এদিকে কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্রে জানা যায়, সুপ্রিম কোর্টে মৃত্যুদন্ড অনুমোদন-সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তিতে দেরি হওয়ায় কনডেম সেলে আসামির সংখ্যা বাড়ছে। দেশের বিভিন্ন কারাগারে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত মৃত্যুদÐাদেশপ্রাপ্ত প্রায় ১ হাজার ৬০০ আসামি ছিল। তাদের অনেকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়।
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির জন্য রয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তা হত্যায় মেয়ে ঐশীর (মৃত্যুদন্ড) আপিল মামলা, রাজন ও রাকিব হত্যার আপিল, জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম, হবিগঞ্জের সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার, পাবনার আবদুস সুবহানসহ ২৬ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির (মৃত্যুদন্ড অনুমোদন) আপিল, দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার আপিল, আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলা, রমনার বটমূলে হত্যা মামলার আপিলসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা উচ্চ আদালতে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। হাইকোর্টে ২১ আগস্ট ও ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা দু’টির আপিল শুনানি হবে।
নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার শুনানি হবে আপিল বিভাগে। এই মামলার পেপারবুক তৈরি শেষ হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার ব্যারিস্টার সাইফুর রহমান বলেন, বর্তমানে ডেথ রেফারেন্স মামলা শুনানির জন্য হাইকোর্টে তিনটি বেঞ্চ রয়েছে। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন দায়িত্ব নেয়ার পর এসব মামলা দ্রæত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে একটি বেঞ্চ বাড়িয়েছেন। স¤প্রতি প্রধান বিচারপতি নিজেও ডেথ রেফারেন্স শাখা পরিদর্শন করছেন।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতি বছর মামলা দায়ের সংখ্যা বাড়ছে, কমছে নিষ্পত্তির হার। এদের মধ্যে অনেকেই ১১ থেকে ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে কনডেম সেলে আটক রয়েছেন। বিগত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বিচারাধীন রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিচারিক আদালত থেকে ফাঁসির আদেশ হওয়ার পর শত শত আসামিকে বছরের পর বছর কারা প্রকোষ্ঠের কনডেম সেলে বন্দি থাকতে হচ্ছে। এতে করে অনেক আসামি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন বলেও জানা যায়। আইনজীবীরা বলছেন, হাইকোর্টে বিচারকের সঙ্কট রয়েছে।
এছাড়া অনেক বিচারক ডেথ রেফারেন্সের মামলা শুনতে চান না বলে জট সৃষ্টি হয়। তাদের মতে, মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার কারণে দোষী ব্যক্তির শাস্তি বিলম্বিত হচ্ছে; আবার অনেককে বিনা বিচারে কারাগারে থাকতে হচ্ছে দীর্ঘদিন। বিচারপ্রার্থীদের বাড়ছে ভোগান্তি।
ডেথ রেফারেন্স শাখায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত ১২ থেকে ১৫ বছর পুরনো অনেক মামলা রয়েছে। চলতি বছর মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের আপিলের মামলাগুলো অনেকাংশ কমছে। আশা করি আগামীতে আরো কমবে। আমরা মাত্র ফাইলগুলো সংরক্ষণ করি। নিয়ম অনুযারী নি¤œ আদালতের ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামির রায়ের যাবতীয় নথিপত্র আসে।
ফৌজদারি কার্যবিধির ৩১ ধারার (২) উপধারা অনুযায়ী জেলা ও দায়রা জজ এবং অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারকরা আইন অনুযায়ী মামলা নিষ্পত্তি করে যে কোনো ধরনের দন্ড দিতে পারেন। তবে শুধু ফাঁসির দন্ড দিলে তা হাইকোর্টের অনুমোদন সাপেক্ষে কার্যকর করতে হয় বিচারিক আদালতে রায় দেয়ার সাত দিনের মধ্যে হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখায় চলে আসে। এটিই মূলত ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে পরিচিত। পরবর্তীতে ডেথ রেফারেন্স শাখা থেকে শুনানির জন্য পাঠানো হয়। হাইকোর্টে শুনানির পর রায় হলে সংক্ষুব্ধরা আপিল বিভাগে আবেদন করতে পারেন। এর পর রিভিউ পর্যন্ত সুযোগ থাকে। আর রিভিউ খারিজ হলে এবং প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষা না চাইলে বা তিনি ক্ষমা না করলে কার্যকর করা হয় মৃত্যুদন্ড।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন