নূরুল ইসলাম : নিষিদ্ধ পলিথিনে ভরে গেছে রাজধানীসহ সারাদেশের সব হাট-বাজার। পলিথিনের ব্যাগ বিক্রি-বিতরণ, ব্যবহার ও মজুদ নিষিদ্ধ হলেও এ আইন মানছে না কেউ। প্রশাসনিক ও আইনি দুর্বলতার সুযোগে পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম পলিথিন এখন সহজলভ্য। যত্রতত্র ব্যবহারের ফলে ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, উর্বরতা হারাচ্ছে মাটি, বাতাসে ছড়াচ্ছে বিষ, ভরাট হচ্ছে নদী-খাল-বিল, পরিচ্ছন্নতা হারাচ্ছে সড়ক-গলিপথ। সব মিলিয়ে সারাদেশে পলিথিন দূষণের যেনো মহোৎসব চলছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. এ এন এম ফখরুদ্দিন বলেন, পলিথিনকে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভবিষ্যতে সুয়ারেজ লাইন বন্ধ হযে যাবে, নদী মরে যাবে, প্রাণীজ সম্পদ ধ্বংস হওয়ার মাধ্যমে পরিবেশের মহাবিপর্যয় ঘটবে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য তিনি ব্যক্তি থেকে পরিবার, সমাজ হয়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সচেতনতা সৃষ্টির উপর গুরুত্বরোপ করেন। সাথে সময়োপযোগি আইন এবং তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
এক সমীক্ষায় জানা গেছে, ঢাকা শহরের একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে চারটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। ওই হিসাবে শুধু রাজধানীতেই প্রতিদিন ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যবহার হচ্ছে। এ হিসেবে প্রতিমাসে ব্যবহার হচ্ছে ৪১ কোটি পিস। প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ পিস পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার শেষে ফেলে দেয়া হয়। এতে ড্রেন-নালা, খাল-ডোবা ইত্যাদি ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পাড়া-মহল্লায় ড্রেনেজ ও সুয়ারেজ লাইন ভরাট হয়ে রাস্তা উপর দিয়ে ময়লা আবর্জনা প্রবাহিত হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে এটা মহামারি আকারে দেখা দিলে রাজধানীবাসীকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। পলিথিন থেকে সৃষ্ট ব্যাকটেরিয়া ত্বকের বিভিন্ন রোগের জন্ম দেয়। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, অতিসূক্ষ্ম ইথিনিল পলিমার পলিথিন তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়, যা অপচনশীল। এতে করে জমির উর্বর শক্তি নষ্ট হয়। এ ছাড়া পলিথিনে বহন করা যে কোনো ধরনের খাদ্যদ্রব্য দীর্ঘক্ষণ থাকলে বিষক্রিয়ায় তা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. এএনএম ফখরুদ্দিন বলেন, পলিথিনের বিরূপ প্রভাবে মানুষ থেকে শুরু করে উদ্ভিদ, প্রাণী, পরিবেশ সব কিছুই বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। এজন্য আইন তৈরী, প্রয়োগ, বিদ্যামান আইনের যথাযথ ব্যবহার এবং প্রয়োজনীয় মনিটরিং জরুরি।
রাজধানীসহ সারাদেশেই প্রকাশ্যে বিক্রি ও ব্যবহার হচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিন। বছর খানেক আগেও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাজারের বিক্রেতারা পলিথিন ব্যাগ লুকিয়ে রাখতেন। এখন সব লজ্জা ভুলে পলিথিন এসে গেছে প্রকাশ্যে। মাছ, গোশত থেকে শুরু করে চাল, ডাল তেল, লবণ, সাবান সবকিছু বহন করা হচ্ছে পলিথিনে। দেশের যে কোনো হাট-বাজারে পলিথিন এখন আর আইনগত নিষিদ্ধ বস্তু নয়।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে পলিথিনের বাজারজাত ও ব্যবহারে নেয়া হচ্ছে নানা কৌশলের আশ্রয়। এর একটি হলো টিস্যু ব্যাগ। সম্প্রতি বাজারে আসা এ ব্যাগটি কাগজের তৈরি বলে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু আসলে তা আসলে কাগজ নয়, পলিথিনের। দেখতে কাগজের মতো কিন্তু আগুনে দিলে গলে যায়। ব্যবসায়ীদের এমন কৌশলে বোকা হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। বড় বড় শপিংমল, মার্কেটগুলোতে টিস্যু ব্যাগের আড়ালে পলিথিন ব্যবহার করা হচ্ছে। কয়েকজন বিক্রেতার সাথে কথা বলে জানা গেছে, আগে পাইকারী কিনতে গেলেও তাদেরকে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হতো। এখন অঘোষিতভাবে সব ধরনের পলিথিনই ব্যবহার বা বেচাকেনা করা যায়। আগে পুলিশও পলিথিনের খোঁজ করতো। পলিথিনসহ হাতে-নাতে ধরতে পারলে ধরে নিয়ে যেতো। আটক করতো। এখন আর তা করে না। যাত্রাবাড়ী বাজারের বিক্রেতা লোকমান হোসেন বলেন, পলিথিন নিয়ে গোপনীয়তার কিছু নেই। সরকার এটা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে সব ওপেন করে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সরওয়ার ইমতিয়াজ হাশমি বলেন, পলিথিনবিরোধী অভিযান কমে যাওয়াতেই আসলে এর ব্যবহার বেড়ে গেছে। আমরা চেষ্টা করছি, কিন্তু জনবল সংকট ও সময়মতো পুলিশ পাওয়া যায় না বলে অভিযান পরিচালনা অব্যাহত রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, শুধুমাত্র আইন দিয়ে পলিথিনের ব্যবহার কমানো সম্ভব নয়। এর জন্য ইপিআর (এক্সটেনডেন্ট প্রডাকশন রেসপনসিবিলিটি) পদ্ধতি চালু করা দরকার। এই পদ্ধতিতে যে কোম্পানী পলিথিন উৎপাদন বা ব্যবহার করবে তারাই এটার ব্যবহার কমানোর ব্যবস্থা করবে। পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে এই পদ্ধতি চালু আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পলিথিনের মূল উপাদান ইথিলিন রেফ্রিজারেটরে রাখা মাছ-মাংস-ফল দূষিত করে। পলিথিন পোড়া গ্যাস ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। অথচ খোদ রাজধানীতে যত্রতত্র পলিথিন পোড়ানো হয়। মানুষ জেনে না জেনে রেফ্রিজারেটরে পলিথিনের মোড়কে খাদ্যবস্তু রাখে।
২০১০ সালে পলিথিনের পরিবর্তে পাটজাত ব্যাগ ব্যবহারের আইন পাস করে সরকার। প্রতিটি পণ্যের মোড়কে পাটজাত পণ্য ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। গত কয়েক মাস ধরে পাট প্রতিমন্ত্রী রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে ঘুরে পাটজাত ব্যাগ ব্যবহারের জন্য রীতিমতো ক্যাম্পইন করে চলেছেন। অথচ এর বিপরীতে পলিথিনের বিক্রি ও ব্যবহার চলছে প্রকাশ্যে। এ যেনো এক দেশে দুই আইন চালুর মতো অবস্থা। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) সভাপতি আবু নাসের খান বলেন, এক সময় পলিথিনের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে ব্যাপক প্রচারণা থাকলে এখন তা ঝিমিয়ে পড়েছে। তবে সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে। তারা যেন মানুষের জন্য ক্ষতিকর পলিথিন ব্যবহার না করে।
জানা গেছে, গার্মেন্ট, লবণ ও চিনিসহ ২৩ ধরনের প্যাকেজিং পলিথিন উৎপাদনের অনুমোদন নিয়ে গোপনে কারখানা মালিকরা অবৈধভাবে পলিথিন উৎপাদন করছেন। ঢাকার পলিথিন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে একাধিক প্রভাবশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। এ ছাড়া যাত্রাবাড়ী থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে শতাধিক কারখানা। অভিযোগ রয়েছে, পলিথিনের ব্যবহাররোধে সরকারের মনিটরিং ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এতে করে যত্রতত্র পরিথিনের কারখানা গড়ে উঠছে। আর এ সুযোগে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছে।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (সংশোধিত) ২০০২ অনুযায়ী, এই আইন অমান্য করলে ১০ বছরের সশ্রম কারাদ- এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে। আর বাজারজাত করলে ৬ মাসের জেল এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। পরিবেশবিদদের অভিযোগ, আইন থাকলেও এর প্রয়োগ নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন