সায়ীদ আবদুল মালিক : বৃষ্টি মানেই ঢাকায় পানিবদ্ধতা-যানজট। স্যুয়ারেজ ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সামান্য বৃষ্টি হলেই রাজপথ-অলিগলি পানিতে থৈ থৈ। আর এ পানিতে ছড়িয়ে যায় রাজধানীজুড়ে ব্যবস্থাপনার বাইরে থাকা বিপুল পরিমাণ বর্জ্য। এতে নাগরিকদের চরম দুর্ভোগ-বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। ড্রেন উপচে রাজপথে পানি জমতে যে সময় লাগে, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগে পানি সরতে। ড্রেনেজ ও স্যুয়ারেজ ব্যবস্থার বেহাল দশাই এ দুর্ভোগের কারণ বলে নগরবাসী মনে করেন। তাদের অভিযোগ, বহু বছর ধরে এ সমস্যা চলতে থাকলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটি আমলে নিচ্ছে না। ড্রেনেজ ও স্যুয়ারেজ ব্যবস্থার এই বেহাল অবস্থার জন্য সিটি কর্পোরেশন এবং ওয়াসা পরস্পরকে দায়ী করে নিজেদের ব্যর্থতাকে বরাবরই আড়াল করার চেষ্টা করে।
ভুক্তভোগী এলাকাবাসীর অভিযোগ, বারবার জানানোর পরও ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এবং ঢাকা ওয়াসা আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই দিতে পারছে না। দুই সিটি কর্পোরেশন ও ওয়াসা অফিসে বহু অভিযোগপত্র জমা পড়লেও এর কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি রাজধানী ঢাকাকে শতভাগ পয়োনিষ্কাশনের আওতায় আনার জন্য ২০১২ সালে ওয়াসা যে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল, তাও মুখ থুবড়ে পড়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ঢাকা শহরের পয়োনিষ্কাশনের প্রধান দায়িত্ব ওয়াসার। কারণ ঢাকা শহর থেকে স্যুয়ারেজের মাধ্যমে বড় অঙ্কের পানি ও পয়োনিষ্কাশনের দায়িত্ব তাদের কাছে। আমাদের কাছে শুধু কিছু ছোটখাটো ড্রেনের দায়িত্ব। তিনি বলেন, আসন্ন বর্ষা মৌসুমকে সামনে রেখে আমরা ড্রেনগুলো পরিষ্কার করেছি। প্রতিটি এলাকাভিত্তিক লোকের ব্যবস্থা করে রেখেছি যেন প্রয়োজনমতো তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া যায়।
সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তার এমন বক্তব্যের সাথে বাস্তবে রাজধানীর রাজপথ বা অলিগলির কোনো মিল নেই। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রাস্তার পাশের ড্রেনগুলো ময়লা আর্বজনা জমে বন্ধ হয়ে আছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই পানি জমে ময়লা আবর্জনা একাকার হয়ে যাচ্ছে। ড্রেনগুলো নিয়মিত পরিস্কার তো দূরে থাক, মাঝেমধ্যে পরিষ্কারও করা হয় না। এখন বিভিন্ন এলাকায় ফুটপাত উন্নয়নের কাজ চলছে। এতে করে ড্রেনগুলো অনেক স্থানেই একেবারে বন্ধ হয়ে আছে।
অন্যদিকে, রাজধানীর মাত্র ৩০ শতাংশ এলাকায় ৫০ বছরেরও বেশি সময় আগে স্যুয়ারেজ লাইন স্থাপন করা হয়েছে। এসব লাইনের বেশিরভাগই এখন অকেজো। কর্তৃপক্ষ যেখানে লিকেজ পাচ্ছে, সেখানে সংস্কারের চেষ্টা করছে। স্যুয়ারেজ লাইন স্থাপনের একটি মহাপরিকল্পনা ২০১২ সালে ঢাকা ওয়াসা গ্রহণ করে। তবে অত্যন্ত ধীরগতি ও পরিকল্পনা মাফিক কাজ না হওয়ায় এ প্রকল্পও অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়েছে। তখন প্রায় ১৩ হাজার ১২০ কোটি টাকা (১৬০ কোটি ডলার) ব্যয়ে ডেনমার্কের গ্রন্টমিজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান ঢাকা ওয়াসার অধীনে প্রায় ৪০০ বর্গকিলোমিটার রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ও ঢাকা মহানগর উন্নয়ন পরিকল্পনা (ডিএমডিপি) অঞ্চলের মোট ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার আওতায় আনার এ মহাপরিকল্পনা তৈরি করে।
তবে ঢাকার অকেজো স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা ও ওয়াসার মহাপরিকল্পনা প্রসঙ্গে কোনো সন্তোষজনক তথ্য পাওয়া যায়নি ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ হোসেনের কাছ থেকে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন বিপন কুমার সাহা বলেন, আমরা তো বহুদিন ধরেই ড্রেনেজ লাইনগুলো পরিষ্কার রাখার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। আমাদের ড্রেনেজ লাইনে যতক্ষণ ময়লা থাকে ততক্ষণ আমরা লাইন পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু ময়লা যদি ওয়াসার লাইনে চলে যায় তখন এর দায়ভার আমাদের না। স্যুয়ারেজ থেকে মল-মূত্রসহ ময়লা পানি যদি উপচে পড়ে তবে তা ঠিক করার দায়িত্ব ওয়াসার।
তিনি আরও বলেন, এ বছর বর্ষা মৌসুমের আগেই ঘনঘন বৃষ্টি হচ্ছে। এ বৃষ্টির পানি যাওয়ার পথ হচ্ছে ড্রেনগুলো। কিন্তু সাধারণ মানুষ ড্রেনে বিভিন্ন ধরনের ময়লা ফেলার কারণে পানি ঠিকমতো যেতে পারে না। আবার পলিথিনসহ বেশকিছু অপচনশীল দ্রব্য ড্রেনে গিয়ে আটকে থাকে। এতে বৃষ্টিতে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্য আমরা একটি বিশেষ ধরনের মেশিন কিনছি, যা কিনা ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের মতো ড্রেন থেকে ময়লা টেনে আনবে অথবা ড্রেনে ময়লা আটকে থাকলে তা সরিয়ে লাইন পরিষ্কার করে দেবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমডোর বখতিয়ার ইনকিলাবকে বলেন, আসলে আমাদের হাতে সবকিছু নেই। জনসাধারণকে সচেতন হতে হবে। পলিথিন ও প্লাস্টিক জাতীয় সামগ্রীর জন্য রাজধানীর অধিকাংশ ড্রেন ও স্যুয়ারেজ লাইন অকেজো হয়ে পড়েছে। সঠিকভাবে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। তাই সামান্য বৃষ্টিতে সৃষ্টি হচ্ছে পানিবদ্ধতা। সাধারণ মানুষ পলিথিন ও প্লাস্টিক জাতীয় সামগ্রী যত্রতত্র ফেলানোর জন্য ড্রেনেজ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে প্রতিদিন সকালে সুইপার দিয়ে পরিষ্কার করেও লাভ হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, যত্রতত্র অপচনশীল দ্রব্য না ফেলার জন্য বহুবার রাজধানীবাসীকে বলা হয়েছে। কিন্তু কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। দেখা গেছে, শ্যাম্পু ব্যবহার করে তার প্যাকেট কমোডে ফেলে দেওয়া হচ্ছে অথবা কোনো কিছু খেয়ে তার প্যাকেট ড্রেনে বা ম্যানহোলে ফেলে দিচ্ছে রাজধানীবাসী। সকালে ড্রেন পরিষ্কারের আগে কোনো অপচনশীল দ্রব্য যদি আটকে যায় তাহলে তা সহজে সুইপাররা পরিষ্কার করতে পারে না।
রাজধানী পুরান ঢাকার ওয়ারি এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ রাজেস খান বলেন, এ এলাকার ড্রেনেজ ও সুয়্যারেজ লাইনের ত্রুটির জন্য প্রতিনিয়তই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে আমাদের। বেশি বৃষ্টি লাগে না, হালকা বৃষ্টিই যথেষ্ট হাঁটুপানি হওয়ার জন্য। ড্রেন দিয়ে তো পানি যায়-ই না, বরং ড্রেনের ময়লা ওই পানির সঙ্গে মিশে যায়। স্যুয়ারেজ লাইনের ঢাকনা খুলে রাখলেও পানি যায় না, বরং মলমূত্র ভেসে ওঠে।
তিনি আরও বলেন, একবার পানি জমলে পানি নামতে কয়েকদিন লেগে যায়। দুর্গন্ধে এলাকা দিয়ে চলাচল তো দূরের কথা, বাড়িতেও নাক চেপে থাকতে হয়। বিশেষ করে গলির ভেতরের বাসিন্দাদের খুবই সমস্যা হয়। রাস্তার চাপ কলের পানিতেও ড্রেন-স্যুয়ারেজের ময়লা চলে আসে। এ ব্যাপারটি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সমাধান চাইলেও এখন পর্যন্ত দুর্ভোগ কমেনি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনকে জানালেও তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
মৌচাক এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী মমিন মেহেদী বলেন, বৃষ্টিতে পানি জমলে হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট উঠিয়ে তারপর কর্মস্থলে যেতে হয়। পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকা, জরাজীর্ণ রাস্তা সংস্কার না হওয়া এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে সামান্য বৃষ্টিতেই আমাদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
কুড়িলের বাসিন্দা মোহাম্মদ আব্দুর রহিম বলেন, এই এলাকায় বৃষ্টি হলে বন্যার মতো আবস্থা হয়ে যাওয়া সাধারণ ঘটনায় দাঁড়িয়েছে। চল্লিশ বছরের ড্রেনেজ ও স্যুয়ারেজ লাইন পুরোপুরি অকেজো। একবার পানি উঠলে সপ্তাহখানেকের আগে নামে না। অপবিত্র পানির জন্য বাসা থেকে বের হতে পারি না। আজান দিলে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে পারি না। শুধু আমি কেন, এলাকার কেউই মসজিদে যেতে পারেন না। তার ওপর এ ময়লা পানি যদি মসজিদের সীমানা পর্যন্ত চলে যায় তাহলে পবিত্রতা কীভাবে রক্ষা হয়।
এ ছাড়াও ভারী বর্ষণের দিনগুলোতে দেখা যায়, বৃষ্টির ফলে রাস্তায় পানি উঠে যাওয়ায় যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া, রায়েরবাগ, জুরাইনসহ বেশকিছু এলাকার শিক্ষার্থীরা জুতা হাতে নিয়ে হাঁটু সমান পানি পার হয়ে বিদ্যালয়ে হয়। কুড়িলে তো ছোট ছোট পথশিশুরা এই ময়লা পানিতেই সাঁতার কাটে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ডা. মোহাম্মদ আব্দুল মতিন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর কোনো কার্যকর তৎপরতা ও মনিটরিং না থাকায় নিষিদ্ধ পলিথিনে আবার বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। একই সঙ্গে রয়েছে সঠিক পরিকল্পনার অভাব ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবহেলা। নিষিদ্ধ পলিথিন ফিরে আসায় পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও আর্থিক তিন দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ও নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহার বন্ধে আইন আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভয়াবহভাবে বেড়েছে এ সব পণ্যের ব্যবহার। পলিথিন ও প্লাস্টিক দ্রব্যের ব্যবহার বাড়ায় রাজধানীর ড্রেন ও স্যুয়ারেজগুলো থেকে পানি নামছে না। পানি নিষ্কাশনে বাধার সৃষ্টি করায় শহরজুড়ে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের পলিথিন ও প্লাস্টিক দ্রব্য প্রতিরোধ কর্মসূচির সদস্য সচিব আলমগীর কবির বলেন, ব্যবহারের পর পলিথিন ও প্লাস্টিক সামগ্রী যেখানে-সেখানে ফেলে দেওয়া হয়। আর প্রতিদিন পলিথিন ও প্লাস্টিক সামগ্রীর স্থান হয় রাজধানীর ড্রেন ও স্যুয়ারেজগুলোতে। এতে পানি নিষ্কাশনে বাধা সৃষ্টি করায় বৃষ্টিতেই শহরজুড়ে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। তাই পলিথিন ব্যাগের বিকল্প পাট, কাপড়, কাগজ ও চটের ব্যাগ উৎপাদন ও তা সারাদেশে সকল স্থানে সহজলভ্য করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন