দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার উপক‚লীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বেশিরভাগই ঝুঁকিপূর্ণ। সাগরের লবণাক্ততা থেকে ফসলি জমি রক্ষাসহ উপক‚লীয় জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়ন এবং জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় মার্কিন সাহায্য সংস্থা ইউএসএইডের সহায়তায় ১৯৬০ সাল থেকে ’৮০ সালের মধ্যে মাত্র ৩৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে দক্ষিণের বিশাল উপক‚লীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ বিভিন্ন ধরনের পানি অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। এর ফলে বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর ও বরগুনা জেলার প্রায় ৬ লাখ একর জমি লবণাক্ততা থেকে রক্ষার পাশাপাশি ফসল উৎপাদন আশাব্যাঞ্জকভাবে বৃদ্ধি পায়।
প্রকল্পটি শুরু থেকে শেষ করতে সময় লেগেছে প্রায় ২০ বছর। ফলে এ সময়কালের মধ্যে ’৭০ এর হ্যারিকেনসহ একাধিক ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছাস উপক‚লে আছড়ে পরায় অনেক বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ পানি অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পাশাপাশি ক্রমাগত সাগরের ঢেউ লাগাতর এসব বাঁধে আছড়ে পরায় তা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কিন্তু মেরামতে তহবিল সঙ্কট ছিল সব সময়ই। এমনকি স্বাভাবিক অবস্থাতেই বছরে যেখানে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ২৫-৫০ কোটি টাকা, সেখানে এর এক তৃতীয়াংশ অর্থও কখনো পাওয়া যায়নি।
ইতঃপূর্বে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমেই কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আওতায় উপক‚লীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ বিভিন্ন অবকাঠামো মেরামত ও পুনর্বাসন হলেও গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তা বন্ধ। এক হিসেবে দেখা গেছে ১৯৮১-৮২ সালে উপক‚লীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ অবকাঠামোসমূহ রক্ষণাবেক্ষণে বরাদ্দ ছিল মাত্র ৮০ লাখ টাকা। এর পরের বছর ওই বরাদ্দ ৬২ লাখ টাকায় হ্রাস করা হয়। সে সময়ই বছরে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ চাহিদা ছিল প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা।
১৯৮০ সালে ইউএসএইডভুক্ত প্রকল্পটির কাজ শেষ হবার পরে আরো বিভিন্ন দাতা সংস্থার অর্থায়নে উপক‚লীয় এলাকায় বেশ কিছু বাঁধ ও পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে। বর্তমানে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাসমূহে ৮৭টি পোল্ডারে ৩ হাজার ৭৪৩ কিলোমিটার উপক‚লীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ছাড়াও ১ হাজার ৯৯টি রিভার ক্লোজার, প্রায় ১ হাজারটি ইনলেট স্ট্রাকচার, সোয়া ২শ’ ব্রীজ ও কালভার্ট ছাড়াও পৌনে ৩শ’ ক্রসড্যাম রয়েছে।
কিন্তু লাগাতার দুর্যোগ মোকাবেলা করতে গিয়ে এসব উপক‚লীয় বাঁধসহ পানি অবকাঠামোর একটি বড় অংশই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী ও কলাপাড়া, পিরোজপুরের ইন্দুরকানী ও ভোলার কয়েকটি এলাকার প্রায় ২৫ কিলোমিটার উপক‚লীয় বাঁধ বিলীন হয়ে বর্তমানে উন্মুক্ত অবস্থায় রয়েছে।
গত ৩ মে ঘূর্ণিঝড় ফণির বয়ে আনা জলোচ্ছাসে এসব ভাঙা বাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত করেছে। সিডর, আইলা ও মহাসেনের একের পর এক তাণ্ডবে বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর, বরগুনা, ঝালকাঠী, বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলাসমূহে প্রায় ৩শ’ কিলোমিটার উপক‚লীয় বাঁধ সম্পূর্ণ ও দেড় হাজার কিলোমিটার আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এছাড়াও এসব উপক‚লীয় জেলাসমূহের বাঁধের পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতিও ছিল ব্যাপক।
উল্লেখিত জেলাসমূহে প্রায় ৩শ’টি পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো সম্পূর্ণ ও আরো ৫ শতাধিক আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। উপক‚লীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, নদী তীর সংরক্ষণ বাঁধ, রেগুলেটর, ফ্লাশিং ¯øুইস গেটসহ বিভিন্ন পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি মেরামত ও পূণর্বাসনে কয়েক হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হলেও সময়মত তহবিলের সংস্থান না হওয়ায় সিডরের প্রায় এক যুগ পরেও এখনো ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন চলছে।
পানি বিশেষজ্ঞদের মতে, ঝড় জলোচ্ছাসে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ছাড়াও গোটা উপক‚লীয় এলাকার বাঁধসমূহের উচ্চতা ও প্রশস্ততা বৃদ্ধিসহ নতুন নকশায় ঢাল তৈরী করে সাগরের জলোচ্ছাসকে প্রতিহত করার উদ্যোগ জরুরি। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের ইসিআরপি প্রকল্প, ডাচ সরকারের ব্লু-গোল্ড প্রগ্রাম ও সিআইপি-১ এর আওতায় প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সিডর, আইলা ও মহাসেনের ক্ষতি পুনর্বাসনসহ ক্ষতিগ্রস্থ উপকূলীয় বাঁধসহ পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো সমূহের মেরামত শুরু হয়েছে। তবে তা দক্ষিণাঞ্চলের উপক‚লের ৮৭টি পোল্ডারের মধ্যে মাত্র ২৭টিতে সীমাবদ্ধ। এসব প্রকল্পের মধ্যে বিশ্ব ব্যাংকের সাহায্যপুষ্ট প্রায় সাড়ে ৭শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে পটুয়াখালী, বরগুনা ও পিরোজপুরের ১২টি পোল্ডারে ইসিআরপি প্রকল্পের আওতায় ১৯.৭৬ কিলোমিটার স্থায়ী নদী তীর সংরক্ষণ, ৩৫.৪৩ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ, ৪৮০ কিলোমিটার বাঁধ মেরামত, ১৭৪টি পানি অবকাঠামো নির্মাণ ছাড়াও ১৯১টির মেরামত প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
এছাড়া ডাচ সরকারের ব্লু-গোল্ড প্রোগ্রামের আওতায় প্রায় ৫৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার ৯টি পোল্ডারে ৫৮৯ কিলোমিটার উপক‚লীয় বাঁধ মেরামত, ৮৫৪ কিলোমিটার খাল খনন ও ৯০টি পানি অবকাঠামোর মেরামত চলছে।
পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্ণেল (অবঃ) জাহিদ ফারুক শামিম জানান, এ বিষয়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পূর্ণ সচেতন রয়েছে। কীভাবে এসব বাঁধ মেরামত ও পুনর্বাসন করা যায়, সে লক্ষ্যে ইতোমধ্যে আমরা বরিশাল ও ঢাকায় একাধিক সেমিনারসহ মতবিনিময় সভা করেছি। সেখান থেকে অনেক তথ্য-উপাত্তসহ বাস্তব কিছু মতামত পাওয়া গেছে। পুরো বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে বলেও জানান পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন