আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পিপলস লিজিং কোম্পানি লিমিটেডকে বন্ধের (অবসায়ন) সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে আমানতকারীদের আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বুধবার (১০ জুলাই) বাংলাদেশ ব্যাংকে এক আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম। আরও উপস্থিত ছিলেন নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ শাহ আলম।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, পিপলস লিজিংয়ের আমানতকারীদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এখন পর্যন্ত ব্যাংকের আমানত ২০৬ কোটি টাকা। এই আমানতের বিপরীতে কোম্পানিটির সম্পদের পরিমাণ তিন হাজার ২শ’ ৩৯ কোটি টাকা। দ্রæত কোম্পানিটি অবসায়নের ব্যবস্থা করে হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী আমানতকারীদের পাওনা পরিশোধের ব্যবস্থা করা হবে।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, ২০১৫ সাল থেকে কোম্পানিটি দুর্বল হতে শুরু করে। সেখানে পর্যবেক্ষকও নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। গ্রাহক স্বার্থ রক্ষা করেই কোম্পানি বন্ধ করে গ্রাহকদের সব পাওনা বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
গত ২১ মে অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক বিভাগে পিপলস লিজিং কোম্পানি বন্ধের অনুমোদন চেয়ে চিঠি পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে ২৬ মে অবসায়নের অনুমতি দেয় অর্থমন্ত্রণালয়।
যে কারণে পিপলস লিজিং বন্ধ : অনিয়ম দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় চরম সংকটে থাকা পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের (পিএলএফএসএল) কার্যক্রম বন্ধের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে অনুমোদন দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানায়, পিপলস লিজিংয়ে ঋণ বিতরণে অব্যবস্থাপনা, সম্পত্তির ঝুঁকি ও তারল্য সংকটে দূরাবস্থায় রয়েছে। তারা আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে পরছে না। সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে স¤প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে চিঠি দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। চিঠিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনের ২২ (৩) এবং ২৯ ধারায় প্রতিষ্ঠানটি অবসায়নের উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়। সম্মতি দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় গত ২৬ জুন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি দেয়। চিঠি পাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ অবসায়ন প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এজন্য প্রতিষ্ঠানটিতে আটকে থাকা আমানতের পরিমাণ, অনিয়মের ধরন, প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ও মাসিক বেতন-ভাতার পরিমাণ উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলছে।
পিপলস লিজিংয়ের আর্থিক অবস্থা : ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক তথ্য অনুযায়ী, পিপলস লিজিংয়ে আমানত রয়েছে দুই হাজার ৮৬ কোটি টাকা। তবে দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার মতো নগদ অর্থ সংকটে রয়েছে। ফলে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। ১৯৯৭ সালে কার্যক্রম শুরু করা এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় মতিঝিলে। এছাড়া গুলশান ও চট্টগ্রামে দুটি শাখা রয়েছে। পিপলস লিজিংয়ে এক হাজার ১৩১ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ৭৪৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। ধারাবাহিক লোকসানের কারণে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এ প্রতিষ্ঠানটি ২০১৪ সালের পর থেকে কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি।
তাদের মোট শেয়ারের ৬৭ দশমিক ৮৪ শতাংশই রয়েছে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের হাতে। বাকি শেয়ারের মধ্যে স্পন্সর ও পরিচালকদের হাতে রয়েছে ২৩ দশমিক ২১ শতাংশ। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে আট দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং শূন্য দশমিক ১৯ শতাংশ শেয়ার রয়েছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে।
আইনে যা বলা আছে : আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনের ২২ (৩) ধারা অনুযায়ী, আমানতকারীর স্বার্থ রক্ষায় যেকোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবসায়নের জন্য উচ্চ আদালতে আবেদন করতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই আইনের ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, কোম্পানি আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, হাইকোর্ট বিভাগ বাংলাদেশ ব্যাংকের আবেদনের ভিত্তিতে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান অবসায়নের জন্য আদেশ দিতে পারবে।
একই আইনের ৮ ধারায় যেকোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধের ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংককে দেয়া হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন কারণে যে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করতে পারবে। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে আমাতকারীদের স্বার্থহানি হয় এমনভাবে ব্যবসা করা, দায় পরিশোধে অপর্যাপ্ত সম্পদ, অবসায়ন বা কার্যক্রম বন্ধ, লাইসেন্স পাওয়ার জন্য মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য সরবরাহ ইত্যাদি।
অর্থ ফেরতের বিষয়ে আইনে যা আছে : সংশ্লিষ্টরা জানান, অবসায়ন হওয়া প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীর অর্থ কোন উপায়ে ফেরত দেয়া হবে, সে বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনে কিছু বলা নেই। এক্ষেত্রে আদালত যে উপায়ে অর্থ পরিশোধ করতে বলবেন, তা কার্যকর হবে। তবে সাধারণভাবে সম্পদ বিক্রি এবং সরকারের সহায়তার আলোকে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়া হয়।
এজন্য প্রথমে প্রতিষ্ঠানের দায় ও সম্পদ নিরূপণ করা হয়। এরপর একটি স্কিম ঘোষণা করা হয়। যেখানে নির্দিষ্ট মেয়াদ উল্লেখ করে কোন পরিমাণ আমানত কবে নাগাদ পরিশোধ করা হবে তার উল্লেখ থাকে।
কষ্টের টাকা ফেরত না পেলে মাঠে মারা যাব : কষ্টের টাকা জমিয়ে ডিপোজিট রেখেছি, এখন যদি ফেরত না পাই তাহলে মাঠে মারা যাব। এভাবে নিজের কথাগুলো বলছিলেন পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (পিএলএফএসএল) আমানতকারী বাবলা। বুধবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বন্ধের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই অনেক আমানতকারী পিপলস লিজিংয়ের অফিসে আসছেন। কিন্ত তথ্য জনানোর মত কোনো কর্মকর্তা অফিসে নেই। এমনকি একাধিক কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠান থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে আসলেও পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার মত লোক নেই প্রতিষ্ঠানে।
পিপলস লিজিংয়ের আমানতকারী বাবলা বলেন, আমি ১৪ লাখ টাকা আমানত রেখেছি। পিপলস লিজিং বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এমন খবর শোনার পর প্রথমে গুলশান ব্রাঞ্চে যায়। কারণ আমার ওই ব্রাঞ্চে করা। কিন্ত গত দুদিন ধরে তাদের অফিসে কোনো কর্মকর্তা নেই আজকে (বুধবার) মতিঝিল ব্রাঞ্চে এসে দেখি একই অবস্থা। সকালে অফিসে এসেছি কথা বলার মত কেউ পায়নি। দু’দিন আগে একজন অপারেশন ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা হয় উনি বললেন, ধৈর্য ধরেন অবশ্যই টাকা পাবেন। বাবলা বলেন, আমার অনেক কষ্টের টাকা জমিয়ে ডিপোজিট রেখেছি, এখন যদি ফেরত না পাই তাহলে মাঠে মারা যাব।
এদিকে আশিক নামের পিপলস লিজিংয়ের এক কর্মকর্তা জানান, কথা বলার মত কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। তবে বড় আতঙ্কে আছি আমরাও। কারণ আমাদেরই এখন চাকরি থাকবে না। কোম্পানির অবসায়নের বিষয়টা পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কেউ অফিসে আসছে না। কী বলব বলেন- যোগ করেন তিনি। এদিকে আরেক আমানতকারী মো. হানিফ জানান, বেশি সুদ দেয়ায় ২০১৭ সালে ৮৪ লাখ টাকা আমানত ছিল। অনেক দিন টাকা তোলা যাচ্ছে না। সবশেষ ঈদের আগে ১০ লাখ টাকা উঠিয়েছিলাম। কিন্ত তারপর থেকে অনেকবার চেষ্টা করেও বাকি টাকা আর ফিরে পাইনি। এখন বন্ধ হয়ে গেলে টাকা ফেরত পাব কি-না, আতঙ্কে আছি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন