রাজধানীসহ সারাদেশে ‘গলাকাটা’ বা ‘ছেলেধরা’ আতঙ্ক ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজে মানুষের (বিশেষ করে শিশুদের) রক্ত বা ‘কাটা মাথা’ লাগবে এমন তথ্যে এ গুজব ছড়ানো হচ্ছে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করে ছেলেধরা ইস্যুতে নানা বানোয়াট তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। এতে স্কুলগামী শিশু-কিশোরদের পাশাপাশি তাদের অভিভাবকদের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিভিন্ন এলাকায় গলাকাটা বাহিনীকে প্রতিরোধে স্থানীয়দের পক্ষে পাহারা বসানো হয়েছে।
গত কয়েকমাসে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছেলেধরা বা গলাকাটা সন্দেহে বেশ কয়েকজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া আরও অনেককে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে স্থানীয়রা। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে ‘ছেলে ধরা’ সন্দেহে দু’জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এদিকে, পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজে ‘কাটা গলা’ লাগার বিষয়ে প্রচারিত সব তথ্যকে গুজব, বানোয়াট ও অপপ্রচার বলেছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ বিষয়ে আতঙ্কিত না হতে বাহিনীগুলোর পক্ষ তরফ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে। গুজব ছড়ানো ব্যক্তিদের শনাক্ত ও গ্রেফতারে ইতোমধ্যে অভিযান শুরু করেছে বাহিনীগুলো। এছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পুলিশের পক্ষ থেকে গুজবে আতঙ্কিত ও বিভ্রান্ত না হতে অনুরোধ করা হয়েছে। খোদ তথ্য অধিদপ্তরও এক চিঠিতে এমন তথ্যকে অপপ্রচার বলে বিবৃতি দিয়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ছেলেধরা সন্দেহে মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের চাঁদগেটে অজ্ঞাত এক যুবককে (২৫) পিটিয়ে হত্যা করেছে স্থানীয়রা। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮ টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে।
স্থানীয়দের বরাত দিয়ে মোহাম্মদপুর থানার এসআই বুলবুল আহমেদ বলেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে নিহত যুবক সেখানে এক শিশুর সঙ্গে কথা বলায় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। পরে তারা ওই যুবককে আটক করে বেদম মারধর করে। খবর পেয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এসআই আরও জানান, ওই যুবকের শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তার মাথা, চোখের নিচে ও মাথার পেছনে গভীর আঘাতের জখম রয়েছে। গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত তার পরিচয় নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ।
এছাড়া গতকাল দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে অজ্ঞাত এক যুবককে (৩০) গণপিটুনি দিলে মারা যান তিনি। আশুগঞ্জ থানার ওসি মোহাম্মদ মাসুদ আলম বলেন, ছেলেটি ভবঘুরে ও মানুসিক ভারসাম্যহীন ছিল বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তার পরিচয় জানার চেষ্টাসহ প্রকৃত ঘটনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এছাড়া গত কয়েকমাসে বিভিন্ন জেলায় একই গুজবে অনেককে পিটিয়ে হত্যা ও গুরুতর আহত করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে। ৮ জুলাই বরিশালের বানারীপাড়ায় রিমা নামে মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারী আটক করে পুলিশে সোপর্দ, ২৫ জুন ঝালকাঠির কাঁঠালিয়ায় মিরাজ হোসেন (৩০) নামে এক যুবককে গণধোলাই, ১৮ জুন মেহেরপুর সদর উপজেলার রাধাকান্তপুর গ্রামে বিলকিস খাতুন, মর্জিনা খাতুন ও মালেকা খাতুন নামের তিন মহিলাকে পুলিশে হস্তান্তর, মে মাসে সাতক্ষীরার বিভিন্ন উপজেলায় নারীসহ ১০ জনের বেশি মানুষকে গণধোলাই, ১৫ মে নড়াইল সদরের মুলিয়া বাজারে জসিম নামে এক যুবককে গণধোলাই, ১৯ মে কালিয়া-নড়াইল সড়কে আখলিয়া বাজার থেকে ষাটোর্ধ এক মানসিক ভারসাম্যহীন বৃদ্ধকে মারধর করে একটি ক্লাবে আটকে রাখা, ১৭ মার্চ বান্দরবান সদরের সুয়ালক ইউনিয়নে এক ব্যক্তিকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে স্থানীয় বাসিন্দারা।
এছাড়া ১১ মে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার মাগুরঘোনা এলাকায় মানসিক ভারসাম্যহীন এক বৃদ্ধকে (৬০) পিটিয়ে হত্যা করেছে এলাকাবাসী। ওই সময় ডুমুরিয়া থানার ওসি আমিরুল ইসলাম বলেছিলেন, গুজব ছড়িয়ে মানসিক ভারসামহীন ওই যুবককে হত্যা করা হয়েছে। তাৎক্ষণিক দুই জনকে আটকসহ আড়াইশ’ জনের নামে মামলা করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি।
এদিকে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব প্রচারকারীদের ধরতে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের শনাক্ত ও গ্রেফতারে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), ডিএমপির সাইবার ইউনিট টিম ও র্যাব কাজ করছে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে একাধিক ব্যক্তি ও ফেসবুক গ্রুপ চিহ্নিত করে ছবি প্রকাশসহ অভিযান শুরু হয়েছে। একইভাবে ‘কাটা মাথার’ ছবিগুলোর উৎসও জানার চেষ্টা করছে পুলিশ। গত ৯ জুলাই চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির ভুজপুর থানার সুয়াবিল এলাকা থেকে ছেলেধরা গুজব ছড়ানোর দায়ে মাওলানা আবু তৈয়ব মুহাম্মদ মুজিবুল হক নামে এক মাদরাসা শিক্ষককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ওই শিক্ষক ফেসবুকের একটি গ্রুপে গুজব ছড়ান বলে পুলিশ জানায়।
গুজবে আতঙ্কিত না হতে বরিশাল ও লক্ষীপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মতবিনিময় সভায় পুলিশের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে। ৯ জুলাই লক্ষীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) আ স ম মাহাতাব উদ্দিন এক সভায় পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষকে বলি দেওয়ার জন্য ছেলে ধরা বা মানব পাচার করা সংক্রান্ত বিষয়টি একটি গুজব এবং কোনো ভিত্তি নেই বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব প্রচারকারীদের আইনের আওতায় আনার কথা জানান। অন্যান্য অনেক জেলায় এমন সভা করে আশ্বস্ত করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা বলেন, পদ্মা সেতু দেশের সর্ববৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প। এ প্রকল্পের সাথে বাংলাদেশের ইমেজ জড়িত। একটি মহল এই উন্নয়ন ব্যাহত করার জন্য এ ধরনের গুজব রটিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে, যা একটি গুরুতর অপরাধ। অনেকে না বুঝেই এটি শেয়ার করে অপরাধের অংশীদার হয়েছেন। তাদের শনাক্ত করার কাজ চলছে। গুজব ছড়ানোর প্রমান পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
র্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. এমরানুল হাসান বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে যেকোনো গুজব রটনাকারীদের শনাক্তে কাজ করে র্যাব। যারা এসব রটিয়েছেন তাদের পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
এদিকে গুজবের বিষয়ে মঙ্গলবার তথ্য অধিদপ্তরের দেয়া এক চিঠিতে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজে‘ মানুষের মাথা লাগার’ তথ্যকে অপপ্রচার ও গুজব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একইভাবে এমন অপপ্রচার আইনত দন্ডনীয় অপরাধ ও এ ধরনের গুজবে বিভ্রান্ত না হতে দেশবাসীকে অনুরোধ জানানো হয়।
##
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন