মাওলানা মুফতী মোহাম্মদ আবদুচ ছমদ
॥ শেষ কিস্তি ॥
ইমাম তারাবীহর নামাযে এতটুকু পরিমাণ কেরাত পড়বেন, যতটুকু পরিমাণ পড়লে তার পেছনে একতেদা করা মুসল্লীগণ বিরক্তবোধ করবে না। এজন্য ইমামকে তার পেছনে একতেদা করা মুসল্লীগণের অবস্থা সর্ম্পকে অবগত হওয়া উচিৎ। আর উত্তম হলো যদি মুসল্লীগণ বিরক্ত বোধ না করে তাহলে প্রত্যেক রাকাতে দশ আয়াত পাঠ করা। কেন না, এর দ্বারা সুন্নাতও আদায় হয়। এবং তারাবীহর নামাযে পরিপূর্ণ এক খতম কোরআন ও সম্পন্ন হয়ে যায়। (আল-ফিক্হুল হানাফী)
তারাবীহর নামাযে সমপূর্ণ এক খতম কোরআন পড়া সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। আর ইমাম আবু হানিফা (রহ.) থেকে বর্ণিত আছে, প্রত্যেক রাকাতে দশ আয়াত করে পড়বে, যেন (তারাবীহর নামাযান্তে) সম্পূূর্ণ এক খতম কোরআন সম্পন্ন হয়ে যায়। আর বর্তমান সময়ে উত্তম হলো এতুটুকু পরিমাণ পড়া, যতটুকু পরিমাণ পড়লে মুসল্লীগণ জামায়াত থেকে বিমুখ হয়ে না পড়েন। আর উত্তম হলো দুই সালামের মাঝে কেরাতকে স্থিরতার সাথে আদায় করা। তেমনিভাবে এক সালামে ও দুই রাকাতের মাঝে স্থিরতার সাথে কেরাত পড়া উত্তম। (আল-ইখতিয়ার লি-ত’দীলিল মোখতার) “হিন্দিয়াহ”নামক কিতাবে আছে যে, কোন একজন ইমাম দুই মসজিদে তারাবীহর নামায পড়ল এবং প্রত্যেক মসজিদে তারাবীহর নামায সম্পূূর্ণ আদায় করল, এটা জায়েজ নেই। (আল-মুহীত, কৃত-ইমাম সরখসী রহ.) আর “আল-মুজমিরাত” নামক কিতাবে আছে, এটার উপরই ফতোয়া। (ফতোয়ায়ে আলমগীরি, ১ম খ-, পৃষ্ঠা-১১৬)
মাসআলা :- ২৭ শে রমজান রাত্রে খতমে কুরআন অর্থাৎ তারাবীহের খতম ২৭ শে রমজান করা উত্তম। যদি এ রাতে বা এর পূর্বে কুরআন খতম করে তারাবীহ শেষ রমজান পর্যন্ত সমানভাবে আদায় করবে। যেহেতু তারাবীহ হচ্ছে সুন্নাতে মোয়াক্কাদাহ। (আলমগীরি ইত্যাদি)
মাসআলা:- চার রাকাত পড়তে যতক্ষণ সময় লাগে, প্রতি চার রাকাত পর ততক্ষণ বসা মুস্তাহাব। পাঁচ তারবীহা এবং বিতিরের মাঝখানে বসাটা যদি মানুষের পক্ষে কষ্টকর হয়, বসবে না। (আলমগীরি )
মাসআলা:- তারাবীহর বৈঠকে এখতিয়ার রয়েছে। চাই চুপ করে থাকুক বা দুআ কালেমা পড়–ক বা তেলাওয়াত করুক বা দরূদ শরীফ পড়ুক অথবা একা চার রাকাত নফল পড়–ক। জামাত সহকারে পড়া মাকরূহ। অথবা এ তাসবীহ পাঠ করবে- ছোবহানা ঝিল মুলকি ...... ওয়া নাওজুবিকা মিনার নার (গুণীয়া, রদ্দুল মোখতার ইত্যাদি)
মাসআলা:- তারাবীহর জামাত হচ্ছে সুন্নাতে কেফায়া। মসজিদের এলাকার সকল লোক ছেড়ে দিলে সকলে গুনাহগার হবে। যদি কোন একজন ঘরে একা পড়ে গুনাহগার হবে না। কিন্তু যে ব্যক্তি নেতৃত্বস্থানীয়। সে থাকলে জামাত বড় হবে, অন্যথায় লোক কম হবে, তার জন্য বিনা ওজরে জামাত ছেড়ে দেয়ার অনুমতি নেই। (আলমগীরি)
মাসআলা:- তারাবীহ মসজিদে জামাত সহকারে পড়া উত্তম। যদি ঘরে জামাত সহকারে পড়ে, তাহলে মসজিদের জামাত পরিত্যাগে গুনাহ হবে না। কিন্তু মসজিদে পড়লে যে ছওয়াব পেত, তা পাওয়া যাবে না।(আলমগীরি)
মাসআলা:- আলেম যদি হাফেজও হয় উত্তম হলো নিজে পড়। অন্যের একতেদা করবে না। ইমাম সাহেব ভুল পড়লে মহল্লার মসজিদ ছেড়ে অন্য মসজিদে গমন করাতে কোন ক্ষতি নেই। এভাবে অন্যস্থানের ইমামের কণ্ঠ যদি সুন্দর হয় অথবা ছোট কেরাত পাঠ করে, বা মহল্লার মসজিদে খতম না হয়ে থাকে, তখন অন্য মসজিদে গমন করা জায়েয। (আলমগীরি)
মাসআলা:- সুমধুর কণ্ঠধারীকে ইমাম বানানো উচিৎ নয় বরং বিশুদ্ধ পাঠকারীকে ইমাম বানাবে। (আলমগীরি) কিন্তু অতীব আফসোসের বিষয় হচ্ছে বর্তমান যুগের হাফেজদের অবস্থা খুবই নাজুক। অনেকেই তো এমনভাবে পড়েন ‘ইয়ালামুন’ ও ‘তা’ লামুন ’ব্যতীত কোন কিছু বুঝা যায় না। শব্দ এবং অক্ষরসমূহ কোথায় যাচ্ছে কোন হদিস নেই, যাদেরকে ভাল পাঠকারী বলা হয়, তাদেরকে দেখা যায় হরফ বিশুদ্ধভাবে আদায় হচ্ছে না।
মাসআলা:- এক ইমাম যদি দুই মসজিদে তারাবীহ পড়ায় এবং উভয় মসজিদে যদি সম্পূর্ণরূপে পড়ায়, তখন নাজায়েয। মুক্তাদি যদি দুই মসজিদে পূর্ণরূপে তারাবীহ পড়ে, কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু দ্বিতীয়টিতে বিতির পড়া জায়েয নেই যদি প্রথমটিতে এশা পড়ে থাকে। আর যদি ঘরে তারাবীহ পড়ার পর মসজিদে আসে এবং ইমামতি করে তখন মাকরূহ হবে। (আলমগীরি)
মাসআলা:- রমজান শরীফে বিতির জামাত সহকারে পড়া উত্তম। যে ইমামের পেছনে এশা ও তারাবীহ পড়েছে তার পেছনে হোক অথবা অন্য জনের পেছনে হোক। (আলমগীরি, দুররুলমোখতার)
মাসআলা:- এশা যদি জামাতে পড়ে এবং তারাবীহ একা পড়ে, তখন বিতিরের জামাতে শামিল হতে পারবে। আর যদি এশা একা পড়ে, যদিও তারাবীহ জামাতে পড়ে তখন বিতির একা পড়বে। (দুররুল মোখতার, রদ্দুল মোখতার)
মাসআলা:- এশার সুন্নাতের সালাম না ফিরায়ে তার সাথে তারাবীহ মিলায়ে শুরু করলে তারাবীহ হবে না। (আলমগীরি )
মাসআলা:- বিনা ওজরে তারাবীহ বসে পড়া মাকরুহ। বরং অনেকের মতে মোটেও হবে না। (দুররুল মোখতার)
মাসআলা:- অনেকে বসে থাকেন, ইমামের রুকুর সময় হলে দাঁড়িয়ে যান, মুক্তাদির জন্য এটা জায়েয নেই। এটা মুনাফিকদের স্বাদৃশ্যতা বহন করে। আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেন: “শেষ রাকাতে আলিফ লাম্ মিম থেকে ইম্মুল মোফলিহুন।”
অর্থ: মুনাফিক যখন নামাযে দাঁড়ায়, তখন অলসভাবে দাঁড়ায়। (গুণীয়া ইত্যাদি)
মাসআলা:- কোন কারণে যদি তারাবীহ নামায ফাসেদ হয়ে যায়, তখন যতটুকু পরিমাণ কুরআন মজীদ উক্ত রাকাতসমূহে পড়া হয়েছে, তা পুনরায় পড়বে যেন খতমে কুরআনে ত্রুটি না হয়। (আলমগীরি)
মাসআলা:- কোন কারণে খতম না হলে তখন সূরা তারাবীহ পড়বে। এর জন্য কেউ কেউ নিম্নে বর্ণিত পদ্ধতি উল্লেখ করেছেন, আলাম তারা থেকে শেষ পর্যন্ত দু’বার পড়লে বিশ রাকাত হয়ে যাবে। (আলমগীরি)
মাসআলা:- বিসমিল্লাহ শরীফ একবার প্রকাশ্যে পড়া সুন্নাত এবং প্রত্যেক সুরার শুরুতে চুপে চুপে পড়া মুস্তাহাব। বর্তমান কালে কিছু মুর্খরা এ পদ্ধতি বের করেছে যে, একশত চৌদ্দটি সুরাতে স্পষ্টভাবে “বিসমিল্লাহ” পড়তে হবে। অন্যথায় খতম হবে না। হানাফী মাজহাব মতে এসবগুলো ভিত্তিহীন কথা।
পরবর্তী যুগে ইমামগণ খতমে তারাবীহতে তিনবার “কূলহু আল্লাহ” পড়া মুস্তাহাব বলেছেন। উত্তম হলো শেষের দিন শেষ রাকাতে আলিফ-লাম-মিম থেকে মুফলিহুন পর্যন্ত পড়া। (বাহারে শরীয়ত ৪র্থ খ-)
লেখক : অধ্যাপক, ছিপাতলী জেজিএম (অনার্স) কামিল মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন