রফিকুল ইসলাম সেলিম : চট্টগ্রামে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেই লড়েছে আওয়ামী লীগ। সরকারি দলের বেপরোয়া দাপটে দাঁড়াতেই পারেনি মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। গৃহপালিত বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার অযোগ্য ঘোষিত জামায়াতসহ অন্য দলগুলোর কোনো চোখে পড়ার মতো অংশগ্রহণ ছিল না। অনেকটা একতরফা নির্বাচনে প্রায় সবকয়টি ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থীরা বিজয়ী হয়। হাতেগোনা কয়েকটি ইউনিয়নে বিজয়ী হয়েছে ধানের শীষ, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী।
প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকারের সর্বশেষ স্তরের এই নির্বাচন ছিল ঘটনাবহুল। এই পর্যন্ত নির্বাচনী সহিংসতার বলি হয়েছে ৮ জন। যাদের প্রায় সবাই সরকারি দলের সমর্থক ও সাধারণ মানুষ। এদের মধ্যে আনোয়ারায় একজন, পটিয়ায় তিনজন, সন্দ্বীপে দুইজন, হাটহাজারী ও রাঙ্গুনিয়ায় একজন করে খুন হয়েছে। কর্ণফুলী থানার বড় উঠানে সরকারি দলের দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে আহত এক নারী তাৎক্ষণিক মৃত সন্তান জন্ম দেয়। সহিংসতায় আহত হয়েছে কয়েকশ মানুষ। গতকাল শেষ ধাপের নির্বাচনেও আনোয়ারা, সাতকানিয়ায় ভোটকেন্দ্র দখল, গোলাগুলি, বোমাবাজিসহ ব্যাপক সহিংস ঘটনা ঘটে।
ইউপি নির্বাচনের সহিংসতাকে সরকারি দলের মন্ত্রী-নেতারা সামাজিক ও গোষ্ঠীগত সংঘাত বলে উড়িয়ে দিলেও এখানে বাস্তবতা ভিন্ন। চট্টগ্রামের প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে সহিংসতা হয়েছে সরকারি দলের প্রার্থী ও তাদের বিদ্রোহীদের মধ্যে। প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী ছিল। কিছু এলাকায় বিএনপির সাথে আওয়ামী লীগের সংঘাত-সহিংসতা হয়েছে। তবে বেশিরভাগ ইউনিয়নে বিএনপির অবস্থান ছিল দুর্বল। আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও সমর্থকদের দাপটে টিকতে পারেনি বিএনপি। কোনো কোনো ইউনিয়নে ভোটের দিন পর্যন্ত মাঠে থাকলেও কেন্দ্র দখলের অভিযোগে অসহায় আত্মসমর্পণ করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে বিএনপির প্রার্থীরা।
শুরু থেকেই নির্বাচনে একচেটিয়া দাপট ছিল সরকারি দলের প্রার্থীদের। মামলা-হুলিয়া আর ধরপাকড়ে বিধ্বস্ত বিএনপি ভোটে সক্রিয় হতে চেয়েও পারেনি। কয়েকটি উপজেলায় নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালাতেই পারেনি বিএনপি। রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, সাতকানিয়াসহ কয়েকটি ইউনিয়নে বিএনপির প্রার্থীদের জোর করে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়। রাউজানের প্রায় সবকয়টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান প্রার্থী এমনকি সদস্যপদেও কোনো ভোট হয়নি। প্রায় ৭৬ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন তারা সবাই সরকারি দলের। ভোটে কেন্দ্র দখল করে নৌকায় সীল মারা, প্রতিপক্ষ প্রার্থীর এজেন্ট সমর্থকদের বের করে দেয়া, ভোটারদের চেয়ারম্যান প্রার্থীর ব্যালট না দেয়াসহ সব ধরনের অনিয়ম হয়েছে নির্বাচনে।
এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ছিল বিতর্কিত। প্রশাসনও সরকারি দলের প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করেছে বেশিরভাগ এলাকায়। কিছু কিছু এলাকায় নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে গিয়ে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের রোষানলে পড়েন পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তা। ফলে অনেক অনিয়ম মুখ বুজে সহ্য করেছেন সরকারি কর্মকর্তারা। জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় পুলিশ সুপার এ কে এক হাফিজ আক্তার স্বীকার করেছেন, ইউপি নির্বাচনে ব্যাপকহারে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার হয়েছে এবং একজন জনপ্রতিনিধি ও একজন সরকারি কর্মকর্তা বৈধ অস্ত্র ব্যবহার হওয়ার বিষয়ে তথ্য প্রমাণ পাওয়ার কথাও স্বীকার করেন তিনি।
হাটহাজারীতে ভোটকেন্দ্র দখল করতে গিয়ে অস্ত্র, গুলি, নগদ টাকাসহ বিজিবির হাতে ধরা পড়েন নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি। এ ঘটনায় তাকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে দুই বছরের সাজা দেয়া হয়। তাকে গ্রেফতার ও সাজা দেয়ার ঘটনার প্রতিবাদে মাঠে নামে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ। আদালত প্রাঙ্গণে মিছিল সমাবেশসহ সাজা দানকারী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিষোদগার করেন সরকারি দলের নেতারা। পরবর্তীতে বোয়ালখালীতে অস্ত্রসহ সরকারি দলের এক নেতা ধরা পড়লেও তাকে কোন সাজা দেয়া হয়নি। অর্থদ- দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে সংশ্লিষ্টরা।
নির্বাচনের শুরু থেকেই সরকারি দলের এমপি নেতারা নানাভবে প্রভাব বিস্তার করে। সর্বশেষ বাঁশখালীর সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান তার পছন্দের প্রার্থীদের জিতিয়ে আনতে সহযোগিতা না করায় নির্বাচন কর্মকর্তাকে ডেকে নিয়ে মারধর করে। এ ঘটনায় বাঁশখালীর সবকটি ইউনিয়নের নির্বাচন স্থগিত করা হয়। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে এমপির বিরুদ্ধে একটি মামলাও হয়েছে।
নির্বাচনে বিপুল বিজয়েও স্বস্তি নেই সরকারি শিবিরে। তৃণমূলের নেতারা বলছেন, দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন দলের তৃণমূলে বিভক্তিকে আরও প্রকট করে তুলেছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার পর থেকে মনোনয়ন বাণিজ্য শুরু করেন সরকারি দলের এমপি নেতারা। এ নিয়ে নেতায় নেতায় দ্বন্দ্ব এবং সংঘাত সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোছলেম উদ্দিনের বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ তোলের প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান জাবেদের অনুসারীরা। এর জের ধরে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। হাইকমান্ডের কড়া নির্দেশনার পরও বিদ্রোহীদের থামানো যায়নি। প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থীদের বিদ্রোহী মোকাবেলা করতে হয়েছে। ভোট শেষ হয়ে গেছে কিন্তু বিভক্তির জের রয়ে গেছে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, নির্বাচনের নামে এমন প্রহসন চট্টগ্রামবাসী আগে কখনও দেখেনি। চট্টগ্রাম বিভাগীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন বলেন, নির্বাচন কমিশন সরকারি দলের ক্যাডারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নির্লজ্জভাবে ভোটের নামে প্রহসনের মাধ্যমে নৌকার প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করেছে। যত রকমের অনিয়ম, দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা আর কারচুপি করা যায় তার কোনটাই বাদ যায়নি। নির্বাচন কমিশন আর সরকার মিলে ইউপি নির্বাচনের নামে মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। এমন হবে জেনেও বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর মাধ্যমে ভোটের অধিকার হরণকারী সরকারের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন