শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

মার্বেল ব্যবসার মধ্য দিয়ে তালিবানকে অর্থ প্রদান করছে আফগান সরকার

প্রকাশের সময় : ৫ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : আফগান সরকার দেশের লোভনীয় মার্বেল ব্যবসার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে তালিবানদের অর্থ সরবরাহ করছে তা সবারই জানা। আফগানিস্তানের বিশাল খনিজ মজুদ যা ভিন্ন পরিস্থিতিতে দেশের উন্নয়নের তহবিল জোগাতে পারত, তার বদলে তা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে দুর্নীতি, চোরাচালান ও জঙ্গি তৎপরতার উপাদানে পরিণত হয়েছে।
হেলমন্দ প্রদেশে দীর্ঘদিন ধরে তালিবানের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলোতে মার্বেলের বিরাট মজুত রয়েছে। নিজ উদ্যোগে মার্বেল আহরণে ব্যাপকভাবে অক্ষম এবং মার্বেল শিল্পকে ক্ষুদ্র পর্যায়ে রাখতে ইচ্ছুক সরকার বেসরকারী কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে মার্বেল পাথর কেনে যারা তালিবানদের পাথর আহরণের জন্য পর্যাপ্ত কর দেয়।
এর ফল হচ্ছে এই যে সরকার প্রতি বছর জঙ্গি গ্রুপগুলোকে লাখ লাখ ডলার পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। ২০১৪ সালে জাতিসংঘের একটি মনিটরিং গ্রুপের হিসাব যে হেলমন্দের মার্বেল থেকে প্রতি বছর আহরিত দেড় কোটি ডলারের কমপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ তালিবানের কাছে যায়।
হেলমন্দে প্রেসিডেন্টের দূত আবদুল জব্বার কাহরামান এ অর্থের পরিমাণ আরো বেশি বলে জানিয়েছেন। তিনি গার্ডিয়ানকে বলেন, তালিবানরা এখন মার্বেল থেকে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ হাজার ডলার, বার্ষিক দেড় কোটি ডলারেরও বেশি আয় করছে।
খনিজ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট এক সরকারী কর্মকর্তা বলেন, হ্যাঁ, আমরা বিষয়টি জানি। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তিনি বলেন, আমাদের আর কোনো উপায় নেই।
হেলমন্দের রাজধানী লশকরগাহে ৫৫ বছরের পুরনো ইতালির নির্মিত একটি মার্বেল কারখানা রয়েছে যা গোটা প্রদেশেই একমাত্র কারখানা। সম্প্রতি এক সকালে সেখানে বয়স্ক লোকদের অ্যাশট্রে ও ফুলদানি তৈরি করতে দেখা যায়। এক তরুণ ভেজা মার্বেল পাথর প্রাচীন দর্শন একটি কাপ্পেলি আফ্রিকা পাথর কাটা মেশিনের করাত চালাচ্ছিল।
কারখানার ম্যানেজার মোহাম্মদ লাল কারগার বলেন, ব্যবসা কোনো সময়েই ভালো ছিল না। ১৯৭০-এর দশক থেকে তিনি এখানে কাজ করছেন। আফগানরা সম্প্রতি মার্বেলের ভক্ত হয়ে উঠেছে। যদিও চাহিদা বাড়ছে, কারখানার আয় মাসে মাত্র ৮ থেকে ৯ হাজার পাউন্ড।
এটা হচ্ছে তালিবানদের আয়ের অংশমাত্র। ইউএসএইড-এর হিসাবে আফগানিস্তানের মোট রফতানি পরিমাণ হচ্ছে ৫০ কোটি পাউন্ড। জাতিসংঘের মতে, আফগানিস্তানে ১০০ বিলিয়ন থেকে ১৪০ বিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের মার্বেল মজুদ রয়েেেছ।
লশকরগাহের মার্বেল কারখানাটির ৪৯ শতাংশ মালিকানা সরকারের, বাকি ৫১ শতাংশের মালিক এক মার্কিন ঠিকাদারের মালিকানাধীন একটি বেসরকারী কোম্পানি। কারগার বলেন, তালিবান সরকারের কাছে মার্বেল বিক্রিতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে তাদের কারখানা বেসরকারী ঠিকাদারদের কাছ থেকে মার্বেল কেনে যারা মার্বেল উত্তোলন করে ও লশকরগাহে নিয়ে আসে।
সরকার ও তালিবান উভয়েই ঠিকাদারদের কাছ থেকে মার্বেল সংগ্রহের জন্য কর আদায় করে। কারণ তারা উভয়েই খনি দক্ষিণাঞ্চলের মার্বেল খনি এলাকাগুলোকে নিজেদের এলাকা বলে দাবি করে। এক বিশিষ্ট শিল্প সূত্রমতে, তালিবান মান ভেদে ট্রাকগুলো থেকে টন প্রতি মার্বেলের জন্য ৩০০ থেকে ৫০০ ডলার নেয়।
লশকরগাহে সবচেয়ে দামি গোলাপি ওনিক্স মার্বেল প্রতি টনের মূল্য ৭০০ ডলার। আফগানিস্তান বিনিয়োগ সমর্থন সংস্থাা (এআইএসএ) মতে, আফগান ওনিক্স পাকিস্তানি মার্বেলের চেয়ে ৭ গুণ বেশি দামি যা রফতানি করা বেশি কঠিন।
আফগান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মুসাফর কুকানি হেলমন্দ মার্বেল কারখানার সরকারী অংশের দেখাশোনা করেন। তিনি তালিবানকে অর্থ প্রদানের কথা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, হেলমন্দের কেউ তালিবানদের আমরা ঘুষ দিয়েছি বলে এ পর্যন্ত অভিযোগ করেনি। তিনি আরো বলেন, পাকিস্তানে অবৈধ ভাবে কোনো মার্বেল যায় না।
তবে মন্ত্রণালয়ের একজন সাবেক মুখপাত্র ওয়াহিদুল্লাহ গাজিখিল স্বীকার করেন যে বেসরকারী কোম্পানিগুলোর সাথে কাজ করে যারা তালিবানকে ঘুষ দেয় ও পাকিস্তানে মার্বেল চোরাচালান করে। তিনি বলেন, বেসরকারী কোম্পানিগুলো নিজেদের লাভের জন্য তালিবানকে ঘুষ দিচ্ছে। সরকার কিছু করতে পারে না। তিনি বলেন, কেউ বলতে পারে না যে তালিবান এভাবে কত টাকা আয় করছে।
সরকার কি মার্বেল কেনা একেবারে বন্ধ করে দেবে কিনা জিজ্ঞেস করা হলে হেলমন্দের কর্মকর্তা বলেন, সরকার গুরুত্বের সাথে বিষয়টি বিবেচনা করছে। কিন্তু কেউ একজন তা কিনবে এবং তখন সব মার্বেল পাকিস্তানে চলে যাবে।
২০১৪ সালে আফগানিস্তান নতুন খনি আইন স্বাক্ষর করে। দুর্নীতি তদারকি সংস্থা গ্লোবাল উইটনেসের মতে, এটাকে অগ্রগতি মনে হলেও এ আইনে অবৈধ সশস্ত্র গ্রুপ, মিলিশিয়ারা বা জাতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের খনি থেকে লাভবান হওয়া বন্ধ করার কোনো বিধান রাখা হয়নি।
আফগানিস্তানে গ্রুপের প্রচারণা নেতা স্টিফেন কার্টার বলেন, মার্বেল পাথর হচ্ছে সংগ্রহকারী, দুর্নীতি ও সশস্ত্র গ্রুপগুলোর মধ্যকার বিস্তৃত সংযোগের অংশ। এ ধরনের সম্পদ উন্নয়নের অর্থ যোগাতে ও বিদেশী দাতাদের থেকে আফগানিস্তানের স্বাধীনতা লাভে সহায়ক হওয়া উচিত। তার বদলে তা আফগানিস্তানের জন্য দীর্ঘস্থায়ী, সম্পদ-চালিত যুদ্ধের প্রকৃত ঝুঁকির মধ্যে নিক্ষেপ করছে।
জাতিসংঘ হেলমন্দে ২৫ খেকে ৩০টি অবৈধ খনি কার্যক্রম পরিচালনাকে চিহ্নিত করেছে যা থেকে কয়েকটি সূত্রমতে ৮০ শতাংশ মার্বেলই পাকিস্তানে চলে যায়। কারগার বলেন, তারা সেগুলোর উপর তাদের ছাপ লাগায় এবং পাকিস্তানি মার্বেল বলে আখ্যায়িত করে।
এর মধ্যে কিছু অংশ আফগানিস্তানে থাকে। রাস্তায় নিরাপত্তাহীনতার কারণে প্রায়ই পাকিস্তান থেকে কাবুলে মার্বেল আমদানি করা হেলমন্দ বা বাদাখশান থেকে আনার চেয়ে সহজ। এআইএসএ-র মতে, আফগানিস্তানের মার্বেল বাজারের ৮০ শতাংশই আসে পাকিস্তান থেকে।
ভাল রাস্তা দিয়েই এ মার্বেল পাচার হয়। একই পথে পাচার হয় অস্ত্র ও মাদক। প্রত্যন্ত প্রদেশ খানাশিন ও দিশু থেকে বাদামচর দিয়ে তা পাচার হয় ন্যাটো যাকে চোরাচালানিদের স্বর্গ বলে আখ্যায়িত করে। এটা হলে তালিবানদের কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণ এলাকা যেখানে রয়েছে গোলাবারুদের গুদাম, বোম তৈরির কারখানা ও বিদেশী যোদ্ধাদের জন্য প্রশিক্ষণ শিবির। এ চোরাচালান রুট হচ্ছে বিদ্রোহীদের মেরুদ- যা সরকার ও তাদের আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকরা কখনোই ভাঙতে পারেনি।
১৪ বছর ধরে অন্য যে কোনো প্রদেশের চেয়ে হেলমন্দে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের অধিক লোকক্ষয় ও অধিক অর্থব্যয় ঘটেছে। তবে আফগানিস্তানে জোট বাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার বেন চার্লস ক্লিভল্যান্ড স্বীকার করেন যে দক্ষিণাঞ্চলের গ্রামগুলো পরিষ্কার করা প্রথম অগ্রাধিকার ছিল না। জনবহুল এলাকার উপর গুরুত্ব দেয়া হয় বেশি। তিনি বলেন, আমরা যা করছি, এখনো করতে চাই, যা করতে পারব তা হচ্ছে সীমান্ত নিরাপদ করা।
তিনি বলেন, তালিবানদের সরবরাহ পথ বন্ধ করতে আফগানিস্তানের প্রতিবেশিদের সহযোগিতা প্রয়োজন। সীমান্তের একদিক থেকে সীমান্তকে নিরাপদ করা যায় না। আফগান সরকারের নিজের পক্ষে এটা সম্ভব নয়। সূত্র দি গার্ডিয়ান।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন