আল্লাহ পাক মানুষ সৃষ্টি করার পূর্বেই মানুষের বসবাসের জায়গা, এই পৃথিবীকে সাজিয়েছেন, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, সাগর, মাহসাগর, গাছপালা, জীবজন্তু, কীটপঙ্গ ও তৃণলতা দিয়ে। এর প্রতিটিরই একটির সাথে অন্যটির সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। এই যে রকমারী বস্তু দিয়ে পৃথিবীর সৌন্দর্য বর্ধন করেছেন, এর মধ্যে অন্য উদ্দেশ্যও আল্লাহ পাকের আছে। আজ সে দিকে না গিয়ে বিশেষ একটি দিক নিয়ে আলোচনা করব। আর সেটি হল গাছ।
প্রাগৈতিহাসিক যুগে অথবা আদীম যুগে, যখন মানুষ সভ্যতার আলো-বাতাস থেকে বঞ্চিত ছিল, তখন মানুষ গাছের ছাল বা পাতা দিয়ে লজ্জা নিবারণ করত। গাছের ফল খেয়ে জীবন ধারণ করত। গাছের উপর মাচা তৈরি করে বসবাস করত। গাছই তাদের নিকট সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বস্তু ছিল। হিং¯্র জীবজন্তু থেকে আত্মরক্ষার জন্যও গাছই ছিল তাদের বন্ধু। তখনও মানুষ জানত না গাছ মানুষের আরও কি উপকার সাধন করে। যতই দিন যেতে লাগল, মানুষ গাছের উপকারিতা বুঝতে আরম্ভ করল। বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে গাছের প্রয়োজনীয়তা মানুষের কাছে স্পষ্ট হতে লাগল। আল্লাহ পাক মানুষ ও জীবজন্তুকে বেঁচে থাকার জন্য সৃষ্টি করলেন একটি সুষ্ঠু পরিবেশ। কারণ সুস্থ জীবজন্তুর জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ অত্যন্ত প্রয়োজন। পরিবেশ দূষিত হলে কোন প্রাণীই বেঁচে থাকতে পারে না। কিন্তু আদি কাল থেকে মানুষ পরিবেশকে দূষিত করে আসছে। বর্তমানে বিজ্ঞানের যুগে আরও বেশী করে পরিবেশ দূষণ হতে চলেছে। আজ দেরিতে হলেও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা সচেতন হয়ে পৃথিবীবাসীকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, এভাবে যদি পরিবেশ দূষিত হতে থাকে তাহলে অচিরেই পৃথিবী নামক এই গ্রহটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তাদের সতর্কবাণী পেয়ে আজ বিশ^বাসী চমকে উঠেছে। গড়ে তুলেছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পরিবেশ সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান। আবিষ্কার করে চলেছে পরিবেশ দূষণ থেকে মুক্তির উপায়।
পরিবেশ কি?
পরিবেশ হল আল্লাহ পাকের প্রদানকৃত নেয়ামত সমূহের একটি অন্যতম নেয়ামত। জীব ও জড় উপাদান সমূহের পারস্পারিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফলই হল পরিবেশ। এই উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম হল প্রাণী, উদ্ভিদ, আলো, বাতাস, মাটি ও উত্তাপ। পরিবেশ হল পৃথিবীর ভ‚পৃষ্ঠ হতে ওজোন স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত পরিমÐলে বিদ্যমান আলো, বাতাস, পানি, মাটি, বন, জঙ্গল, পাহাড়, নদ-নদী, সাগর, মহাসাগরসহ গোটা উদ্ভিদ ও জীব জগৎ সমন্বয়ে যা সৃষ্টি তাই। পরিবেশ দুই প্রকার- প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সামাজিক পরিবেশ। পরিবেশ কোন মানুষের অনুগ্রহ নয় বরং এটি আল্লাহ পাকের মহান দান।
পরিবেশ আল্লাহ পাকের অস্তিত্বের সাক্ষ্য বহন করে। আল্লাহ পাকের কুদরতের উপর গবেষণাকারীদের জ্ঞানচক্ষু খুলে দেয়।
যেমন আল্লাহ পাক বলেছেন, “নিশ্চয়ই আসমান ও জমিন সৃষ্টিতে এবং রাত্রি ও দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বোধসম্পন্ন লোকদের জন্য। (সূরা আলে ইমরান; আ: ১৯০)
পরিবেশের উপাদানগুলোর মধ্যে আল্লাহ পাক অত্যন্ত সুন্দরভাবে ভারসাম্য সৃষ্টি করে দিয়েছেন। যেমন ধরুন, সূর্যের আলো, যদি আল্লাহ পাক আরও প্রখর করে দিতেন তাহলে পৃথিবী হয়ে উঠত আরও উত্তপ্ত। বরফ গলে গিয়ে সাগরের পানির উচ্চতা বেড়ে যেত। আর এদিকে প্রাণি কুলের অস্তিত্ব হয়ে যেত বিপন্ন। আবার আলোর প্রবণতা কমিয়ে দিলেও সমস্ত পানি বরফ হয়ে যেত। প্রাণি কুলও ঠাÐায় জমে যেত। ভারসাম্য সৃষ্টি করাও আল্লাহ পাকের একটি মহান দান।
আল্লাহ পাক নিজেই বলে দিয়েছেন যে, “আমি প্রত্যেক বস্তুকে সুষমভাবে বা পরিমিতরূপে সৃষ্টি করেছি।” (সূরা কাসাস; আ: ৪৯)
অর্থাৎ আল্লাহ পাক সকল জীবের উপযোগী করে পরিবেশকে সুষম ভারসাম্যে সৃষ্টি করেছেন। বর্তমানে মানুষের অবিবেচনা এবং অজ্ঞানতার কারণে পরিবেশ দূষিত হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। এই পরিবেশ দূষিত হওয়ার জন্য দু’টি প্রক্রিয়া বিশেষভাবে দায়ী। এই দু’টি হল, প্রাকৃতিক দূষণ ও মানব সৃষ্টি জনিত দূষণ। প্রথমটি যেমন মানুষ নি:শ^াসের সাথে প্রচুর পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে পরিবেশ দূষণ করছে। তবে এটি আবার প্রাকৃতিকভাবেই বৃক্ষরাজির মাধ্যমে এই কার্বনকে গ্রহণ করে মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ত্যাগ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। দ্বিতীয়টি হল মানবসৃষ্ট দূষণ। এই দূষণটি বহুবিধ কারণে হতে পারে। আজকাল বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে এটি আরও ব্যাপকভাবে দূষণক্রিয়া পরিব্যপ্ত হচ্ছে। যেমন- ১. পারমাণবিক ও রাসায়নিক বর্জ্য, ২. কলকারখানা ও ট্যানারির বর্জ্য, ৩. গাড়ীর কালো ধোঁয়া, ৪. গাছ ও বন ধ্বংস করা, ৫. ময়লা আবর্জনা ও মলমূত্র যেখানে সেখানে ফেলা, ৬. নদী-নালা ভরাট করার ফলে পানি ¯্রােত বন্ধ করে দেয়া, ৭. পলিথিন ব্যবহার, ৮. নির্বিচারে পশু-পাখী নিধন।
উপরোক্ত কারণগুলোর জন্যই আজ পৃথিবীর ভারসাম্য ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। যার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে। বরফ গলতে শুরু করেছে। সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে পৃথিবীর ভ‚ভাগ অনেকখানি সাগরবক্ষে বিলীন হয়ে যাবে অচিরেই। এর জন্য সম্পূর্ণ দায়ী মানুষ- বিশেষ করে উন্নত দেশগুলো। তারা রাসায়নিক ও পারমাণবিক বর্জ্য, কলকারখানা এবং গাড়ীর ধোঁয়া ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিনিয়ত পৃথিবীর পরিবেশকে দূষিত করছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা যতই সতর্ক করছেন, মানুষ ততই আরও অধিক হারে পরিবেশ দূষিত করছে। গাছ কেটে বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে দিচ্ছে। গাছ আমাদেরকে ফল দিচ্ছে, ছায়া দিচ্ছে, সর্বোপরি আমাদের বেঁচে থাকার জন্য যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশী প্রায়োজন অর্থাৎ অক্সিজেন তাও দিচ্ছে। অক্সিজেনের সামান্য অভাব হলে কি পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, এটি যারা ভুক্তভোগী তারা অবশ্যই জানেন।
গাছের প্রয়োজনীয়তা এবং পরিবেশ সুস্থ রাখার জন্য এর অবদান কতটুকু তা উপলব্ধি করেছিলেন রাসূলে পাক (সা:) তখন, যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই অভাবনীয় উন্নতি ছিল না। বিশ^ পরিবেশকে দূষণ মুক্ত রাখার জন্য তিনিই সর্ব প্রথম এক যুগান্তকারী ঘোষণা প্রদান করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “কোন মুসলমান যদি বৃক্ষ রোপণ করে অথবা কোন ফসল আবাদ করে এবং তা থেকে কোন মানুষ, পাখী বা কোন চতুষ্পদ জন্তু ভক্ষণ করে তবে তা তার জন্য সাদকা দানরূপে পরিগণিত হবে (বোখারী- মুসলিম)।” অন্য একটি হাদীসে রাসূলে পাক (সা:) বলেছেন, যা হযরত মা আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেছেন, “তুমি যদি নিশ্চিতভাবে অবগত হও যে কিয়ামত এসে গেছে, তথাপি তুমি বুঝ যে তোমার হাতে এতটুকু সময় আছে, তুমি একটি গাছের চারা রোপণ করতে পারবে, আর তখন যদি তোমার হাতে একটি চারা থাকে তাহলে তুমি চারাটি রোপণ করে দেবে।”
চিন্তা করুন, রাসূলে পাক (সা:) পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখার ব্যাপারে কত বেশী সচেতন ছিলেন।
আর একটি হাদীসে তিনি বলেছেন, “পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ।” আজ আমরা পবিত্রতা অর্থাৎ পাক-নাপাক, সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। মলমূত্র, পচাগান্ধা, আবর্জনা ইত্যাদি যত্রতত্র ফেলে দেই। রাসূলে পাক (সা:) আমাদের এভাবে অপবিত্র জিনিস যত্রতত্র ফেলতে নিষেধ করেছেন। তিনি ময়লা আবর্জনা, মলমূত্র এমন স্থানে ফেলতে বলেছেন, যেখানে মানুষ চলাচল করে না এবং বসত বাড়ির এমন স্থানে ফেলতে বলেছেন যেখান থেকে দুর্গন্ধ বাড়ীতে না আসে। অর্থাৎ ময়লা-আবর্জনা গর্ত করে তার মধ্যে ফেলে দিতে হবে অথবা পুঁতে ফেলতে হবে।
আল্লাহ পাকও এই পবিত্রতার উপর জোর দিয়েছেন। আল্লাহ পাক সূরা আ’লা’র ১৪ নং আয়াতে বলেছেন, “নিশ্চয়ই সে সাফল্য লাভ করল, যে পবিত্রতা অর্জন করল।”
বর্তমানে আমরা ময়লা-আবর্জনা যত্রতত্র ফেলে পরিবেশকে দূষিত করছি। নদীর পানি দূষিত হওয়ার কারণে মাছ বংশ বৃদ্ধি করতে পারছে না। এরই মধ্যে বহু প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে বন-জঙ্গল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে আমরা নানা ধরণের ফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। যে ফল খেয়ে এখনও পৃথিবীর বহু দেশের মানুষ বেঁচে আছে।
কোন কোন ফলের মধ্যে এমন খাদ্যপ্রাণ আছে, যা খেয়ে মানুষ অনায়াসে বেঁচে থাকতে পারে।
হযরত ইব্রাহীম (আ:) তো এজন্যই আল্লাহ পাকের শাহী দরবারে এই বলে মোনাজাত করেছিলেন যে, “হে আমার পালনকর্তা! এই শহরকে শান্তিময় ও নিরাপদ করে দিন এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লহ ও কিয়ামতে বিশ^াস করে, তাদেরকে ফলের দ্বারা রিজিক প্রদান করুন।” (সূরা বাকারা; আ: ১২৬)
যে গাছ আমাদের এত উপকার করে, আমাদের বেঁচে থাকতে সাহায্য করে, সেই গাছকে আমরা নির্বিচারে নিধন করে চলেছি। সাথে সাথে সদকায়ে জারিয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। তাই আসুন, নিজেদের বেঁচে থাকার স্বার্থে গাছ নিধন বন্ধ করি। আর প্রয়োজনে যদি গাছ কর্তন করতেই হয় তাহলে যেন এর পরিবর্তে অন্তত দু’টি গাছের চারা রোপণ করি এবং রাসূলে পাক (সা:) এর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাদীসের উপর আমল করি। মনে রাখবেন, এই হাদীসটির ওপর আমলও নাজাতের উছিলা হয়ে যেতে পারে। অমাআলাইনা ইল্লাল বালাগ।
(আলহাজ¦ মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ:)- এর রচনাবলী হতে সংগৃহীত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন