উপমহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে সৌহাদ্য ও সম্প্রীতির দেশ হলো বাংলাদেশ। ৯২ ভাগ মুসলমানদের এই দেশে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ সব ধর্মাবলম্বী প্রীতির সঙ্গে বসবাস করেন। সম্প্রীতির বিশ্ব মডেল এই বাংলাদেশে হঠাৎ বজ্রপাত! কালো মেঘে ঢেকে দেয়া হলো বাংলাদেশের সৌহাদ্যে। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, ঐক্য পরিষদের নেত্রী প্রিয়া সাহা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে নালিশ করেন বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ৩৭ মিলিয়ন (৩ কোটি ৭০ লক্ষ) ব্যক্তি ‘নাই’ হয়ে গেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে অত্যন্ত ‘গুরুত্বর’ এবং বাংলাদেশের মানুষের কাছে ‘আজগুবি’ এই তথ্য প্রকাশে শুরু হয়েছে তোলপাড়। বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে চলছে বিতর্ক আর প্রতিবাদের ঝড়। প্রতিবাদে হয়েছে মানববন্ধন। সরকারি চাকুরে মলয় সাহার (বর্তমানে দুদকে কর্মরত) স্ত্রী এই প্রিয়া সাহার সাম্প্রদায়িক উসকানি, হটকারি মন্তব্যের প্রতিবাদ করেছে সরকার। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ তার বিচারেরও দাবি উঠেছে। তবে প্রিয় সাহাদের ঔদ্ধত্যের জন্য ক্ষমতাসীনদের দায়ী করছেন কেউ কেউ। তাদের বক্তব্য ইসলামবিদ্বেষী মানসিকতা থেকে প্রিয় সাহাদের পৃষ্ঠপোষকতা করায় তারা এখন ফ্যাংকেন্টাইন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে ১৮ জুলাই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য জানিয়ে প্রিয়া সাহা যে অভিযোগ করেছেন তার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। গতকাল শনিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ প্রতিবাদ করে বলা হয় ১৮ জুলাই বাংলাদেশি নাগরিক প্রিয়া সাহা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বলেছেন, ‘আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি এবং সেখানে ৩৭ মিলিয়ন (৩ কোটি ৭০ লাখ) হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এরই মধ্যে গায়েব হয়ে গেছে। এখনও এক কোটি ৮০ লাখ আছে। যার মধ্যে ১৭ লাখ শিশু এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষ বসবাস করে। আমাদেরকে সাহায্য করুন। আমি আমার ঘর হারিয়েছি, জমি হারিয়েছি। ইতোমধ্যেই আমার বাড়ি-ঘর দখল করেছে। জ্বালিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমরা সরকার থেকে এর কোনো বিচার পাই নাই। আমরা বাংলাদেশেই থাকতে চাই। আমরা বাংলাদেশ ছাড়তে চাই না। দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন।’
উল্লেখ্য, প্রিয়া সাহা ওয়াাশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রেও স্টেট ডিপার্টমেন্টে অনুষ্ঠিত ধর্মীয় স্বাধীনতা অগ্রগতির সেকেন্ড মিনিসটেরিয়াল সভায় ১৬-১৮ জুলাই অংশগ্রহণ করেন। ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নেয়া বিভিন্ন দেশের ২৭ জন প্রতিনিধিকে গত ট্রাম্প তাঁর ওভাল অফিসে ডেকে পাঠান। তখনই প্রিয়া সাহা এই ভয়ঙ্কর অভিযোগ করেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার আশা করে এ ধরনের বড় আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানের আয়োজকরা দায়বদ্ধ ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানাবেন যারা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করবেন এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার মূল্য রাখতে অবদান রাখবেন।
ট্রাম্পের কাছে দেয়া প্রিয়া সাহার বক্তব্যকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, বাংলাদেশে অভিযোগ প্রমাণ করলেই ব্যবস্থা নেয়া হতো। আর প্রিয়ার বক্তব্য বিষয়েও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দেশের নাগরিক হয়ে দেশের বাইরে এরকম অসত্য উদ্দেশ্যমূলক এবং দেশদ্রোহী বক্তব্য দেয়ায় প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই হবে এবং সেই প্রক্রিয়া চলছে। প্রিয়া সাহা ট্রাম্পের কাছে যে বক্তব্য দিয়েছেন সম্পূর্ণ অসত্য এবং অগ্রহণযোগ্য। এটি উস্কানিমূলক বক্তব্য। যা দেশের অভ্যন্তরে লুকায়িত মতলববাজ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকেই আরও শক্তিশালী করতে সহায়তা করবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ নেত্রী প্রিয়া সাহার কাল্পনিক অভিযোগে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ব্লগ, টুইটার, হোয়াটআপে নানান মন্তব্য করেন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। তারা মন্তব্যের লাইক দিয়েছেন। কেউ বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ তথাকথিত প্রগতিশীলতার নামে এই প্রিয়া সাহাদের সৃষ্টি লালন-পালন করেছেন। তারাই এখন বিষধর সর্প হয়ে ছোবল মারছে’। কেউ লিখেছেন ‘দেশে সংখ্যালঘু হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা যাই হোক; প্রশাসনে তারাই ছড়ি ঘোড়াচ্ছেন। তাদের সুযোগ-সুবিধা ও প্রমোশন ইত্যাদি দেয়া হচ্ছে- দৃষ্টিকটূ ভাবে। তারই খেসারত আওয়ামী লীগকে দিতে হচ্ছে।’ কেউ লিখেছেন, ‘প্রিয়া সাহারা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেই জাতির ঘাড়ে লাথি মারছে’। কেউ তার বিরুদ্ধে তদন্ত ও রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা করে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি তুলেছেন। কেউ বলছেন, ‘এ ধরণের ঘটনা কোনো মুসলিম ঘটালে এতোক্ষণে তার বাড়িঘরে আগুন জ্বলতো এবং চৌদ্দগোষ্ঠিকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হতে হতো’।
মিতালী হোসেন নামের একজন লিখেছেন ‘প্রিয়া সাহা সামান্য ব্যক্তি স্বার্থের জন্য মাতৃভূমির সম্মানকে লুণ্ঠিত করার যে অনন্য নজির আপনি সৃষ্টি করলেন সেটা ইতিহাস হয়ে থাকবে। মীরজাফর, ঘসেটি বেগম, জগৎ শেঠরা যুগে যুগে জন্মায়’। সিনিয়র সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমান লিখেছেন ‘প্রিয়া সাহার কলঙ্কিত রাষ্ট্রদ্রোহী মিথ্যা অভিযোগের জবাব অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্তের সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দিতে হবে! সরকারকে তদন্তের মাধ্যমে বের করতে হবে এই রাষ্ট্রবিরোধী গভীর ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে কারা জড়িত, কি তাদের উদ্দেশ্য? আশিক হাসান নামের একজন লিখেছেন ‘একজন সংখ্যালঘু মহিলা নিজেকে বাংলাদেশী পরিচয় দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে জানায় বাংলাদেশে হিন্দু-বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান স¤প্রদায়ের সর্বমোট ৩৭ মিলিয়ন বা ৩ কোটি ৭০ লাখ ব্যক্তি মহিলার ভাষায় ‘নাই’ হয়ে গেছে। হতে পারে এই মহিলাটি কোন কারণে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এবং কোন কারণে সে বিচার পায়নি। কিন্তু সে কিভাবে এই মনগড়া মিথ্যা তথ্য দেয়? এধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে এধরনের তথ্য শুধুমাত্র কি তার নিজস্ব গ্রীনকার্ডের সুরক্ষা পাওয়ার জন্যই কি না? অথবা এর পেছনে আর কোনো আন্তর্জাতিক লবি কাজ করছে তা অতিসত্ত¡র বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং দেশের সকল গোয়েন্দা সংস্থাসমূহকে একযোগে খুঁজে বের করার জন্য একযোগে কাজ করা উচিত’। মাকসুদুল হাসান রনি লিখেছেন ‘প্রিয়া সাহার ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কোনো উপকারে তো আসবেই না, বরং দেশে অস্থিরতা তৈরি করবে মনে হয়। সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে যার এতো ঘনিষ্টতা সে কেন এটা করতে গেল?’ অনিকেত রাজেশ লিখেছেন ‘বাংলাদেশের সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের যেকোনো নেতা চাইলেই ট্রাম্পের সাথে দেখা করতে পারেন না। প্রিয়া সাহা কোন লবি ব্যবহার করে এই সাক্ষাতের সুযোগ পেলেন খতিয়ে দেখা জরুরি। অথবা বিশেষ কারো প্রতিনিধি হিসেবে তাকে আমেরিকায় পাঠানো হয়েছে কিনা সেই প্রশ্নটিও গুরুত্বপূর্ণ। এর পেছনে গভীর কোনো মতলব আছে বলেই ধরে নেয়া যায়। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে এই মহিলার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাই। একই সাথে তার পেছনের শক্তি চিহ্নিত হওয়া জরুরি’। ফেসবুকে প্রিয়া সাহার ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য নিয়ে হাজার হাজার মন্তব্য, প্রতিবাদ, ধিক্কার পোস্ট, শেয়ার করা হয়েছে, দেয়া হয়েছে স্ট্র্যাটাস।
প্রিয়া সাহা কান্ডে গোটা দেশ যখন তোলপাড় তখন ১৯ জুলাই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি রানা দাশগুপ্ত বলেন, গত সপ্তাহে আমেরিকায় ‘ফ্রিডম অব রিলিজিয়ন’ শীর্ষক এক সম্মেলনে আমাদের সংগঠন থেকে ৩ জন প্রতিনিধিকে পাঠানো হয়। তারা হলেন সংগঠনের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য অশোক বড়ুয়া, নির্মল রোজারিও এবং জয়েন্ট সেক্রেটারি নির্মল চ্যাটার্জী। প্রিয়া সাহা সংগঠনের ৮ জন সাংগঠনটির সম্পাদকের একজন। তিনি ওই প্রতিনিধি দলে ছিলেন না। তিনি কোন মাধ্যমে ট্রাম্পের সাথে দেখা করেছেন তা আমরা জানি না। তবে প্রিয়ার করা অভিযোগের সাথে সহমত পোষণ করে রানা দাশগুপ্ত বলেন, প্রিয়া সাহার বাড়ি বরিশাল অঞ্চলে। ওখানে তাদের অনেক বড় বাড়ি রয়েছে। যা কিছুদিন আগে অজ্ঞাত কেউ জ্বালিয়ে দিয়েছে। পরে আবার একই জায়গায় নির্মাণাধীন নতুন বাড়িটিও জ্বালিয়ে দেয়া হয়। সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে আমরা আগে যেমন প্রতিবাদ করেছি এরও প্রতিবাদ করেছি জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে। এর খবর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে হয়তো তিনি ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ করেছেন। ট্রাম্পের কাছে নিজের দেশ সম্পর্কে এরকম গুরুত্বর একটি অভিযোগ করা ঠিক হয়েছে কি না জানতে চাইলে রানা দাশগুপ্ত সরাসরি কোনো মন্তব্য না করে বলেন, প্রিয়া সাহা যা বলেছেন সেগুলো নতুন কোনো বক্তব্য নয়। ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশে হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের সংখ্যা ছিলো ২৯.০৭ শতাংশ। যা ১৯৭০ সালে কমে হয় ১৯.২০ শতাংশ। এই পরিমাণটিও কমে ২০১১ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যার অধিদপ্তরের আরেক জরিপে জানা যায় ০৯.০৭ শতাংশ হয়েছে। তবে স¤প্রতি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নাকি ২ শতাংশ বেড়েছে দাঁড়িয়েছে ১১.০৭ শতাংশ। তা হলেও স্বাধীনতার পর থেকে দেশে সংখ্যালঘু স¤প্রদায় নিম্নাঙ্কেরও নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। যা খুবই আশঙ্কার বিষয়। বিভিন্ন সময় হিন্দুদের ঘরবাড়ি জ্বালানো থেকে শুরু মন্দিরগুলোতে হামলা হচ্ছেই। এতে করে অনেক হিন্দু পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ অন্যান্য দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। যা একটি অসা¤প্রদায়িক দেশের জন্য কোনোভাবেই কাম্য নয়। তবে আশার কথা বর্তমান সরকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এবার ডিসি সম্মেলনের ২১ দফা নির্দেশনায়ও সা¤প্রদায়িক স¤প্রতি নিশ্চিতে কড়া নির্দেশনা রয়েছে। যা আমাদের জন্য খুবই আনন্দদায়ক। গতকালও রানা দাশগুপ্ত ও গণফোরাম নেতা অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী প্রায় অভিন্ন বক্তব্য দেন।
কে এই প্রিয়া সাহা
নারী নেত্রী প্রিয়া সাহা বাংলাদেশ মহিলা ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০১৮ সালে তাকে মহিলা ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে অব্যহতি দেয়া হয়। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক। এই ঐক্য পরিষদের সভাপতি হিউবার্ট গোমেজ এবং সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাস গুপ্ত। এছাড়া বাংলাদেশের দলিত স¤প্রদায় নিয়ে ‘শারি’ নামে একটি এনজিও›র পরিচালনা করেন। তিনি ‘দলিত কণ্ঠ’ নামের একটি পত্রিকার সম্পাদক। ওই পত্রিকায় প্রিয়া সাহার পুরো নাম দেয়া হয়েছে ‘প্রিয় বালা বিশ্বাস’। বয়স দেখানো হয়েছে ৫৪ বছর। পিতার নাম-মৃত নগেন্দ্র নাথ বিশ্বাস।
‘দলিত কণ্ঠ’ পত্রিকার ঘোষণাপত্রে দেখা যায়, চলতি বছরের ১২ জুন ঢাকা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কাজী নাহিদ রসুল পত্রিকাটি প্রকাশের ঘোষণাপত্র প্রদান করেন। ঘোষণাপত্রে শনাক্তকারী হিসেবে স্বাক্ষর করেন অ্যাডভোকেট আল আমিন রিজভী। প্রিয়া সাহা ওরফে প্রিয় বালা বিশ্বাসের পৈত্রিক নিবাস পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার চরবানিয়ারী গ্রামে এবং শ্বশুরবাড়ি যশোরে। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেন রোকেয়া হলে। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সিপিবির সহযোগী সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
প্রিয়া সাহার স্বামী মলয় সাহা দুর্নীতি দমন কমিশনের উপ-পরিচালক হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত রয়েছেন। থাকেন ঢাকার ধানমন্ডিতে। তাদের দুই মেয়ে প্রজ্ঞা পারমিতা সাহা ও ঐশ্বর্য লক্ষèী সাহা যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করছেন। বড় মেয়ে প্রজ্ঞা পারমিতা সাহা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিনকার্ডের লাভের চেষ্টা করছেন কিছুদিন থেকে। মলয় সাহা এবং প্রিয়া দু’জনই যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। মলয় সাহা দুদকের সুবিধাভোগী এবং ভাগ্যবান কর্মকর্তাদের একজন। তাকে নিয়ে বিতর্কও রয়েছে। তিনি দীর্ঘ দিন চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের ডেস্ক অফিসার ছিলেন। এ সময় অর্থের বিনিময়ে বেশ কয়েকজন দুর্নীতিবাজকে দায়মুক্তি দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
মলয় সাহা সরকারি চাকরি করলেও চাকরির শৃঙ্খল অমান্য করে তিনি গোপনে ‘শারী’ নামে একটি এনজিও পরিচালনা করেন। সংস্থাটি কাগজ-কলমে প্রিয়া সাহার নাম থাকলেও নেপথ্যে মলয় সাহা এটির থিংক ট্যাংক। সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত মলয় সাহা। তিনি কয়েক মাস আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের সাবেক ছাত্রদের নিয়ে গড়ে তোলা একটি সংগঠনের মহাসচিব নির্বাচিত হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি সাংগঠনিক প্রচার কার্য চালালেও গতকাল শনিবার থেকে মলয় সাহা তার টাইমলাইন থেকে সকল তথ্য মুছে ফেলেন। তার ফেসবুক আইডিও বøক করে রাখা হয়েছে। মোবাইল ফোন কলও রিসিভ করছেন না।
প্রতিনিধি দলে ছিল না প্রিয়া
মার্কিন য্ক্তুরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত ওই ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নেয়ার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রতিনিধি চূড়ান্ত করেছে। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে বাংলাদেশের সরকারি প্রতিনিধি দলে প্রিয়া সাহার নাম ছিল না। তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে বা বেসরকারী প্রতিনিধি (এনজিও) হিসেবে ওয়াশিংটন সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক মার্কিন সম্মেলনে মূলত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের নেতৃত্বে দেশের প্রধান ৪ ধর্মের প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশের সরকারি প্রতিনিধি দল অংশ নেয়। ওই দলে হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধি হিসাবে ছিলেন অ্যাডভোকেট নির্মল চ্যাটার্জি। তিনি হিন্দু-বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের উপদেষ্টা। খ্রিস্টান স¤প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসাবে খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব নির্মল রোজারিও। বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিনিধি হিসাবে যান হিন্দু বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা অশোক বড়ুয়া এবং মুসলিম স¤প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করছেন শোলাকিয়ার খতিব মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ পুত্র মাওলানা জুনুদ উদ্দিন মাকতুম। তিনি জমিয়তুল উলামা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। বাংলাদেশ সরকারের ওই প্রতিনিধি দলে তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারির পুত্র তৈয়বুল বশর মাইজভান্ডারিও অন্তর্ভূক্ত ছিলেন।
প্রিয়ার হাতে হিন্দুরাও নির্যাতিত
স্বামী দুদক কর্মকর্তা মলয় সাহার প্রভাব খাটিয়ে এনজিও নেত্রী প্রিয়া সাহা মুসলমানদের পাশাপাশি হিন্দুদের ওপর জুলুম নির্যাতন করতেন বলে অভিযোগ করেছেন পিরোজপুর জেলার নাজিরপুরের মাটিভাঙ্গা ইউনিয়নের চরবানিয়ারী গ্রামের স্থানীয় হিন্দু স¤প্রদায়ের নেতারা। তাদের অভিযোগ এলাকার মুসলমান-হিন্দুদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে নষ্ট করার জন্যই প্রিয়া ট্রাম্পের কাছে এ অভিযোগ করেছেন। স্থানীয় হিন্দু স¤প্রদায়ের নেতারা জানান, দুদক কর্মকর্তার স্ত্রী প্রিয়া তার ভাইয়ের জমি নিয়ে বিরোধের জেরে স্থানীয় কয়েকজন হিন্দু ও মুসলমানকে হয়রানি করেন। জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে নিজের ভাইয়ের পরিত্যক্ত একটি বাড়িতে রহস্যজনভাবে যে আগুন দেয়। অতপর স্থানীয় কয়েকজন নিরীহ হিন্দুকে আসামি করে মামলা করেন। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে পরিকল্পিতভাবে রাতের বেলায় পরিত্যক্ত ঘরটিতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়।
ওই এলাকা তথা পিরোজপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম বলেন, প্রিয়া সাহা আমার নির্বাচনী এলাকার মেয়ে। নাজিরপুর বা পিরোজপুর জেলার কোনো হিন্দু বা অন্য কোনো স¤প্রদায়ের লোক গুম বা নিখোঁজ হয়নি। প্রিয়া সাহার বক্তব্য অসৎ উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত এবং সা¤প্রদায়িক সম্পর্ক নষ্টের উসকানিমূলক অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। পিরোজপুর জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বিমল মন্ডল বলেন, প্রিয়া সাহা ট্রাম্পের কাছে এ ধরণের একটি উদ্ভট মিথ্যাচার করবেন ভাবতেও পারিনি। পিরোজপুরে হিন্দু-মুসলমানসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বাস। এখানে কোনো সংখ্যালঘু গুমের ঘটনাও নেই।
প্রতিবাদী জনতার মানববন্ধন
স্বামীর সরকারি চাকরি ও তথাকথিত প্রগতিশীল নারী নেত্রী এনজিও কর্মী প্রিয়া সাহা রাষ্ট্রের সর্বচ্চ সুবিধা ভোগী। তারপরও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নালিশ করায় তার ঢাকার বাড়ির সামনে শনিবার বিক্ষোভ করেছে বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতা। ধানমন্ডিতে প্রিয়া সাহার বাড়ির সামনে ‘সচেতন ছাত্র সমাজ’ ব্যানারে মানববন্ধন করা হয়। মানববন্ধনে অংশ নেয়া আব্দুল কাইয়ুম বলেন, প্রিয়া সাহা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুন্ন করেছেন। তিনি সংখ্যালঘুদের কথা চিন্তা করে নয়, বরং তার যে দুই মেয়ে আমেরিকা প্রবাসী তাদের নাগরিকত্ব পেতে ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ করেছেন। ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি অনেক কঠিন। তিনি মিথ্যাচার করে তার দুই মেয়ের নাগরিকত্ব নেয়ার পথ পরিষ্কার করছেন। মানববন্ধনে অংশ নেয়া শুভ অধিকার বলেন, বাংলাদেশ সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির দেশ। আমরা সব ধর্মের লোক মিলেমিশে বসবাস করছি। তাই আমাদের অবস্থান জানাতে তার বাসার সামনে দাঁড়িয়েছি।
রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিবাদ
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেছেন, প্রিয়া সাহা তিনি ক্ষমার অযোগ্য কাজ করেছেন। তিনি হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য জোটের জয়েন্ট সেক্রেটারি। আমরা তাদের কাছ থেকে একটা স্টেটমেন্ট প্রত্যাশা করেছিলাম, কিন্তু তারা তা দেননি। বক্তব্যের প্রতিবাদে অসুবিধা কোথায়?
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান কাদের এমপি বলেছেন, ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহা সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে অভিযোগ করেছেন তার সাথে আমরা একমত নই। এমন মিথ্যা অভিযোগে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে। এদেশে সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির গৌরবোজ্জল ঐতিহ্য রয়েছে। পৃথিবীর অনেকে দেশেই বাংলাদেশের মত স¤প্রীতির এমন দৃষ্টান্ত নেই।
প্রিয়া সাহার মন্তব্য উদ্দেশ্যপ্রেেণাদিত ও ষড়যন্ত্রমূলক অবিহিত করে হেফাজতের আমির আল্লামা আহমদ শফী বলেছেন, এই বক্তব্যে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে। অনতিবিলম্বে প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, অন্যথায় হেফাজতে ইসলাম বৃহত্তর কর্মসূচী ঘোষণা করতে বাধ্য হবে।
ট্রাম্পের কাছে জঘন্য মিথ্যাচারের জন্য প্রিয়া সাহাকে দ্রæত আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে ১৪ দল। জোটের নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে বলেন, প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করার পাশাপাশি কার প্ররোচনায়, কোন মহলের মদতে ওই নারী এ ধরনের মিথ্যাচার করেছেন তা বের করা করা উচিত। এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র’র মধ্যে বিদ্যমান সুসম্পর্ক বিনষ্ট করতে অশুভ চেনা মহল তাকে দিয়ে কাজটি করিয়েছেন। ##
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন