ক্লাব রেস্তোরাঁ গেস্ট ও রেস্ট হাউসের আড়ালে
নূরুল ইসলাম : রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানে ক্লাব, রেস্তোরাঁ, রেস্ট ও গেস্ট হাউসের আড়ালে চলছে মদ ও জুয়ার রমরমা বাণিজ্য। অভিজাত এলাকা হিসেবে বাড়তি সুবিধায় যুক্ত হয়েছে অসামাজিক কার্যকলাপ। নিরাপদ ভেবে গুলশান এলাকায় শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষের আনাগোনা। বিদেশি মদের আড়ালে দেশি মদ বিক্রি, প্রলোভনে ফেলে ব্ল্যাকমেইলিং, নারীদের দিয়ে অসামাজিক কার্যকলাপসহ আরও কত অপকর্ম চলে অভিজাত এই এলাকায়। সবকিছু মিলে অন্যরকম এক ‘নেশার রাজ্য’। প্রকাশ্যে এসব চললেও প্রশাসন যেন একপ্রকার নির্বিকার। লোকদেখানো দু-একটি অভিযান চললেও পরে প্রভাবশালীদের সাথে যোগসাজশে সবকিছু ম্যানেজ হয়ে যায়। এসব কারণে কূটনৈতিক জোন হিসেবে পরিচিত গুরুত্বপূর্ণ এ এলাকায় প্রায়ই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। গত বছর ইতালির নাগরিক তাবেলা হত্যাকা-ের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নড়েচড়ে বসে। কিছুদিন কড়াকড়ি আরোপের পর এখন সেই আগের অবস্থাই বিরাজ করছে।
সরেজমিনে গুলশান এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রাত নামলেই গুলশানের পরিবেশ অন্যরকম হয়ে যায়। রাত বাড়ার সাথে সাথে সাধারণ মানুষের আনাগোনা কমলেও বেড়ে যায় বিশেষ কিছু মানুষের দৌড়ঝাঁপ। গাড়িগুলো ছুটতে থাকে দ্রুতবেগে। দেখে মনে হতে পারে কোনো জরুরি কাজের জন্য এই ব্যস্ততা, কিন্তু আসলে তা নয়। বেশিরভাগ গাড়ির গন্তব্য কোনো ক্লাব, রেস্তোরাঁ অথবা কোনো গেস্ট হাউস। সেখানেই চলে যত অপকর্ম। গুলশান এলাকার সাধারণ মানুষের ভাষায় এগুলো হলো ভদ্রতার মুখোশের আড়ালে কুরুচির বহিঃপ্রকাশ। বিদেশি মদ ও জুয়ার জমজমাট আড্ডার সাথে উর্বশী নারীদের সঙ্গে বেহায়াপনা সবই চলে। সূত্র জানায়, ক্লাব, রেস্তোরাঁ ও গেস্ট হাউসগুলোতে সম্পূর্ণ বে-আইনিভাবে প্রকাশ্যে বিদেশি মদ বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে সব যে আসল তাও নয়। কোনো কোনো স্থানে চকচকে বিদেশি বোতলে ভেজাল মদও বিক্রি হয়। গত ১ জুন বুধবার র্যাব রাজধানীর কাপ্তানবাজারের বিসিসি রোডে এমনি একটি ভেজাল মদের কারখানা আবিষ্কার করে। সেখান থেকে উদ্ধার করে বিপুল পরিমাণ ভেজাল মদ ও বিদেশি মদের পাঁচ হাজার বোতল।
র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম সাংবাদিকদের জানান, বিসিসি রোডের একটি চারতলা ভবনের তৃতীয় তলায় মদের কারখানাটি ছিল। এখানে হোমিওপ্যাথির তরল অ্যালকোহল দিয়ে ভেজাল মদ তৈরি করা হতো। মদ তৈরির বোতলগুলো বিদেশি। এগুলো বিভিন্ন বার থেকে একটি সংঘবদ্ধ চক্র সংগ্রহ করত। বিভিন্ন বিদেশি ব্র্যান্ডের ভদকা, স্কচ, হুইস্কির মোড়ক ঢাকার ছাপাখানায় তৈরি করে মদের বোতলে যুক্ত করা হতো। পরে এসব ভেজাল মদ পাইকারি মূল্যে ৩৫০ টাকা থেকে ৪৫০ টাকায় বিক্রি করা হতো। অভিজাত এলাকায় এসব মদ আবার চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। হোটেল ও বারগুলো থেকে আবার খালি বোতল সংগ্রহ করে ভেজাল মদ ভরা হতো। র্যাব জানায়, গত তিন বছর ধরে রাজধানীর কাপ্তান বাজারের ওই কারখানায় এভাবে বোতলজাত করে এসব মদ বিক্রি করা হচ্ছে গুলশান, বনানীসহ অভিজাত এলাকায় অবস্থিত হোটেল, গেস্ট হাউস ও বারগুলোতে। এর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে কারখানার মালিক রাসেল গাজীকে তিন বছরের কারাদ- এবং ভবনটির মালিক শাহ আলমকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
গুলশানের আলোচিত ক্লাবগুলো
গুলশান-২-এ অবস্থিত ক্যাপিটাল ক্লাব। অনুমোদনহীনভাবে মদ বিক্রির অভিযোগ অনেক পুরনো। এর আগে র্যাব এই ক্লাবে অভিযান চালিয়ে কোটি টাকার মদ-বিয়ার উদ্ধার করে। গুলশান থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে পুলিশ বাদী হয়ে মামলাও (যার নম্বার ২২) করে। ওই মামলার প্রধান আসামী ক্যাপিটাল রিক্রিয়েশন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট কে এম আর মঞ্জুর। গুলশান এলাকার ব্যবসায়ি হারুন অর রশিদ বলেন, মানুষের রিক্রিয়েশনের জন্য ক্লাবগুলো গড়ে তোলা হলেও এখানে কী রিক্রেশন হয় তা সবারই জানা। সন্ধ্যার পরেই বসে জমজমাট মদের আসর। একপর্যায়ে আসর জমে উঠলে বিক্রির গ-ি ভিতরের কোলাহলকে ছাপিয়ে বাইরে চলে আসে। এছাড়াও আছে কোর্নিয়া ক্লাব, লেক ভিউ, লেক ডিপ্লোমা, ফু-ওয়াং, কোরিয়ান ক্লাব এবং কেএনবি ক্লাব। এসব ক্লাবে রিক্রিয়েশনের আড়ালে সবকিছুই মেলে। ক্লাবগুলোতে সদস্য ছাড়াও শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সববয়সী মানুষের আনাগোনা দেখা যায়।
অপকর্মের আখড়া রেস্ট-গেস্ট হাউস
একাধিক সূত্র জানায়, গুলশানের অন্তত অর্ধশতাধিক রেস্ট হাউস-গেস্ট হাউস রয়েছে। এসব হাউসের আড়ালে চলছে নানা ধরনের অপকর্ম। হলিডে ইন, লিভার ডোর, কোয়ালিটি ইন, গার্ডেন ইন, বোনভিটা ইন, ইস্টার্ন রেসিডেন্স, ডি ক্যাসল, স্কাই পার্ক, ম্যারিনো, লোরেল, ফুজি ইন, পিনাকলÑএরকম আরও কত অত্যাধুনিক নামের অসংখ্য গেস্ট হাউস। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই ভেতরে কী হচ্ছে। নিছক রেস্ট হাউস ভেবে কেউ যদি সেখানে যান তবে তাকে পড়তে হবে চরম বিড়ম্বনায়। টিনএজ তরুণী দিয়ে গেস্ট নামের খদ্দেরদের মনোরঞ্জনের নানা ব্যবস্থা সেখানে। যারা নিয়মিত এসব গেস্ট হাউসে যাতায়াত করেন তাদের একজন বলেন, রেস্ট হাউস বা গেস্ট হাউস বিশ্রামের জন্য নয়। বরং যারা টাকার বিনিময়ে কিছু সময়ের জন্য ফুর্তি করতে চান তাদের জন্য। সোজা কথায় ‘মিনি পতিতালয়’। অনুসন্ধানে জানা গেছে, একেকটি গেস্ট হাউসে নানা পদে নানা কাজের অজুহাতে ২০/৩০ জন করে তরুণী রাখা হয়। খদ্দেররা এখানে আসেন স্বল্প সময়ের জন্য। মনোরঞ্জন শেষে তারা চলে যান। শুধু কি তাই, গেস্ট হাউসগুলোতে রাতে মদ ও জুয়ার জমজমাট আসর জমে।
অনুমোদনহীন বারের ছড়াছড়ি : বিক্রি হচ্ছে মদ
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্র জানায়, গুলশানে বেশ কয়েকটি রোস্তোরাঁ, হোটেল ও বারে অনুমোদনহীনভাবে মদ বিক্রি হয়। তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট জোনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ওই বারগুলোর তালিকা তৈরী করে মালিকদেরকে সতর্কতার নোটিশ দিয়ে তাদের দায়িত্ব শেষ করেছেন। বারগুলোতে এখনও মদ বিক্রি চলছে। অনুসন্ধানে এরকম বেশ কয়েকটি ক্লাব, হোটেল ও বারের নাম পাওয়া গেছে। এগুলো হলো, গুলশান-২-এর ক্যাপিটাল ক্লাব, ২ নম্বর সার্কেল তিন নম্বর প্লটের স্প্যাঘেটি জাজ, ৫৩ নম্বর রোডের ৮ নম্বর বাড়ির স্টিক হাউস, ৫৫ নম্বর রোডের ৯ নম্বর বাড়ির খাজানা, ৩৭ নম্বর রোডের অলিভ গার্ডেন, ১০৯ নম্বর রোডের ১০ নম্বর বাড়ির হেরিটেজ রেস্টুরেন্ট, ১১৮ নম্বর রোডের ১৫/বি নম্বর বাড়ির সাকুরা গোল্ডেন রাইস রেস্টুরেন্ট, ৭১ নম্বর রোডের কফি ম্যাঙ্গো, এক্সিট লাউঞ্জ, ৩৫ নম্বর রোডের ২৭ নম্বর বাড়ির সামদাদ লি, ৭১ নম্বর রোডের ক্যাফে অ্যারাবিয়ান, ৫০ নম্বর রোডের ৬ নম্বর বাড়ির ফ্লেমবি, ৫০ নম্বর রোডের ডি জ্যাং জিম রেস্টুরেন্ট, দি ক্যাসেল রেস্টুরেন্ট, অফ ট্র্যাক, গুলশান নর্থ এভিনিউর ৮ নম্বর বাড়ির স্প্রিট ফায়ার, ৭১ নম্বর রোডের থাই রেস্তোরাঁ সই-৭১, ৬৮ নম্বর রোডের কফি ওয়েগা, ৭১ নম্বর রোডের ১২ নম্বর বাড়ির ক্যাপিটাল ক্লাব, ৮৩ নম্বর রোডের ইন্টারন্যাশনাল ক্লাব, গুলশানের হোটেল ওয়াশিংটন, ডু মি ওকে রেস্টুরেন্ট, পেং ইয়াং রেস্টুরেন্ট, গুলশান-২ এর ৪৩ নম্বর রোডের সুরা রেস্টুরেন্ট, ৭১ নম্বর রোডের সুরা অন, নিউ কিংস কিচেন, জাকারিয়া, ডিম্পল, পিম্পল, ও কোরিয়ানা রেস্টুরেন্ট। জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া কোনো ক্লাব, বার, হোটেল বা গেস্ট হাউসে মদ বিক্রি করা যাবে না। এর ব্যতিক্রম হলে পুলিশ অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন