রোববার, ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

প্রস্তাবিত বাজেটে আস্থার অভাব

প্রকাশের সময় : ৬ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হাসান সোহেল : প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয়ে না থাকার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু মানুষের সংশয় কাটছে না। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের মতে, প্রস্তাবিত বাজেট তাদের মেরুদ- ভেঙে দেয়ার নামান্তর। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া সংখ্যাধিক্যের বাজেট বাস্তবতা বিবর্জিত। এটা বাস্তবায়নের প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি নেই। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকায় কালো টাকার মালিকরা খুশি হলেও সাধারণ মানুষ হতাশ। তারা মনে করেন, পণ্যমূল্য বাড়বে এবং জনগণ ট্যাক্স দিলেও মেগা প্রকল্পের নামে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট হবে।
মানবসম্পদ উন্নয়নে কোনো দিক-নির্দেশনা না থাকায় এটা কার্যত জনচিন্তাহীন বাজেটের নামান্তর। বাজেট ঘোষণার পর অর্থমন্ত্রী রাজস্ব আয় লক্ষ্য অর্জন নিয়ে সমালোচকদের শঙ্কাও উড়িয়ে দিয়েছেন। এছাড়া দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাজেটে এমন কোন পদক্ষেপ থাকলে তা সংশোধন করার কথা জানিয়েছেন। তারপরও অধিক রাজস্ব আয়ের বোঝা, স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা না করা, রফতানি খাতের উৎস করসহ বিভিন্ন কারণে শিল্প বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে বলে ধারণা করছে দেশের ব্যবসায়ী ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।
আর তাই বাজেট নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সংশয়ে না থাকার পরামর্শকে সু-নজরে দেখেননি ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের অন্যতম প্রধান ট্রেড বডি এফবিসিসিআই ইতোমধ্যে প্রস্তাবিত বাজেটকে শিল্প বান্ধব নয় বলে উল্লেখ করেছেন। এ বাজেট পাস হলে ব্যবসায়ীরা বাঁচবে না উল্লেখ করে অস্বাভাবিক কর আরোপের প্রস্তাবেও তারা হতাশা ব্যক্ত করেছেন। দেশের গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজিএমইএও একই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। ব্যবসায়ীদের আরেক প্রধান ট্রেড বডি মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অব ইন্ডাস্ট্রিও (এমসিসিআই) রাজস্ব আদায়ের আকাশচুম্বী লক্ষ্যমাত্রা অর্জন দুরূহ হবে বলে জানিয়েছে। তবে এক্ষেত্রে তারা বড় করদাতার উপর চাপ না বাড়িয়ে নতুন কর বাড়ানোর আওতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন।
এদিকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বাজেট পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় নতুন অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনও কঠিন হবে বলে মনে করছে সংস্থাটি। তাদের মতে, এবারের বাজেটে জনগণকে স্বস্তি দেয়ার তেমন রূপরেখা নেই। করদাতাদের টাকায় রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা অনৈতিক বলে মনে করে সিপিডি। বিশ্লেষকদের মতে, প্রস্তাবিত বাজেটে নতুন করদাতা খোঁজারও দিক-নির্দেশনা নেই, অথচ অর্থমন্ত্রী সমস্যার সমাধান খুঁজেছেন করারোপ করে। সেই করের বোঝায় পিষ্ট হয়ে শান্তি খুঁজতে দু’দ- ধ্যানে বসবেন সেই উপায়ও রাখেন নি। সেখানেও বসিয়েছেন ভ্যাট। খাবার রুটি থেকে শুরু করে নিম্নবিত্তের প্লাস্টিকের স্যান্ডেল। করের আওতা থেকে কিছুই বাদ যায়নি অর্থমন্ত্রীর কড়া নজরদারি থেকে। তাদের মতে, এত কিছু করেও কি হবে শেষ রক্ষা হবে।
দেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগের উপার্জন কোনো না কোনোভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। অথচ প্রস্তাবিত বাজেটে সেই কৃষি ও কৃষককে গুরুত্ব দেয়া হয় নি উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কৃষিতে সহায়তা দিন দিন বাড়ালেও, ঘোষিত বাজেটে দেশের প্রান্তিক কৃষক লাভবান হন সামান্যই। অধিকাংশ কৃষকই জানেন না, কী থাকছে তাদের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে। বিশ্লেষকদের দাবি, উপযুক্ত নীতিমালা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রণোদনাসহ কৃষককে দিতে হবে বাজেটের সুফল।
বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলেছে, বাজেটে আয়-ব্যয়ের হিসাব গরমিল। বাস্তবায়ন তাই প্রশ্নবিদ্ধ। বরাবরের মতই ঘাটতি অর্থায়নে অর্থমন্ত্রী হেঁটেছেন বিলাসী পথে। স্বল্প সুদের বিদেশী ঋণ বাদ দিয়ে তার ভরসা বেশী সুদের দেশী উৎস। দেশের বাইরে থেকেও যেটুকু টাকা আনতে চান ইতিহাস বলে সেটুকুও কোনদিনই আসেনি বাংলাদেশে। তাই বাজেটে জনগণকে স্বস্তি দয়ার তেমন রূপরেখা নেই। তবে আছে সৎ করদাতার টাকায় ডুবতে থাকা রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো বাঁচানোর চেষ্টা। ভালোর মধ্যে এই যে এ খাতে গেল বারের ৫ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ এবার নামিয়ে এনেছেন ২ হাজার কোটিতে। সিপিডি বলছে, সংস্কার ছাড়া ব্যাংক কিংবা পুঁজিবাজার বাঁচাতে যত টাকাই বরাদ্দ থাকুক লাভ হবেনা কোন।
সিপিডি’র পর্যালোচনা বলছে, এ বছর করের বোঝা বেশী চাপতে যাচ্ছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ঘাড়েই। একই সঙ্গে বিনিয়োগ খরার এই সময়েও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ কেন শিল্প স্থাপনে পাওয়া যাবেনা তাও বোধগম্য নয় সংস্থাটির। একই সঙ্গে ব্যাংক ও পুঁজিবাজারের বর্তমান নাজুক পরিস্থিতি বাজেট বাস্তবায়নে বড় চ্যালেঞ্জ।
এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেছেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবের পর অনেকের হাসি কেড়ে নিয়েছে। বাজেট ঘোষণার পর ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি নেই।
তিনি বলেন, এবারের বাজেটের আকার অনেক বড় হয়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা। এ কারণে ব্যবসায়ীসহ সকলের করভার বাড়বে। কারণ বিশাল এ রাজস্ব বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় সকল অর্থ আমাদেরকেই দিতে হবে। আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, সরকারকে মনে রাখতে হবে এ দেশ, দেশের উন্নয়ন ও ব্যবসা সব কিছুই আমাদের। তাই দেশের উন্নয়নে ব্যবসায়ীরা ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে চায়। তবে তা যৌক্তিক হতে হবে। বিশাল অংকের করভার চাপানো হলে ব্যবসায়ীরা বাঁচবে না। আর ব্যবসায়ী না বাঁচলে দেশ ও দেশের মানুষ বাঁচবে না।
মাতলুব বলেন, বাজেটে ব্যবসায়ীদের পক্ষে এফবিসিসিআই সুনির্দিষ্ট করে ৭টি প্রস্তাব দিলেও প্রস্তাবিত বাজেটে তার একটিও খুঁজে পাওয়া যায় নি। বিভিন্ন এসোসিয়েশন থেকে নানা অভিযোগ আসছে। তাদের কোনো প্রস্তাবনা মানা হয়নি। বরং করভার বাড়ানো হয়েছে। এ বাজেট পাস হলে ব্যবসায়ীরা বাঁচবে না।
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে সকল ধরনের রপ্তানির ক্ষেত্রে উৎসে করের হার শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি করলে শিল্পের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হবে। তাই প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখতে পোশাকশিল্পে উৎসে কর ২০১৪-১৫ অর্থবছরের ন্যায় শূন্য দশমিক ৩০ শতাংশ হারে ধার্য করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানায় বিজিএমইএ।
সিদ্দিকুর রহমান বলেন, উৎসে কর বিক্রয়ের উপর কর্তন করা হয়, মুনাফার ওপর নয়। যে কারখানাটি শ্রমিকদের মজুরি দেয়া, বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল পরিশোধ করা, পরিবহনখাতে ব্যয় করাসহ বিভিন্নখাতে ব্যয় করার পর মাত্র ৩ শতাংশ মুনাফা অর্জন করতে পারে, সেই কারখানাটির জন্য ১ দশমিক ৫০ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তন অত্যন্ত কঠিন। অর্থাৎ ৩ শতাংশ মুনাফা হলে এর ওপর প্রদেয় করহার দাঁড়াচ্ছে ৫০ শতাংশ। উদ্বেগের বিষয় যে, গত ৩ বছরে বিভিন্ন কারণে সক্ষমতা হারিয়ে ৬১৮টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আরও ৩১৯টি কারখানা বন্ধ হওয়ার পথে। উৎসে করের বিষয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া হলে আরও অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, এ্যাকর্ড, এ্যালায়েন্স ও ন্যাশনাল এ্যাকশন প্লান-এর মাধ্যমে কারখানাগুলোকে যে রিমেডিয়েশন প্লান দেয়া হচ্ছে, তা বাস্তবায়ন করতে একটি ক্ষুদ্র বা মাঝারী শ্রেণীর কারখানাকে গড়ে ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা খরচ করতে হয়। এই পরিস্থিতিতে ১ দশমিক ৫০ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তন করা হলে শিল্পের বিরাজমান সংকট আরও তীব্রতর হবে। এ শিল্প প্রতিযোগী সক্ষমতা কোনভাবেই ধরে রাখা সম্ভব হবে না।
বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কোনো দিকনির্দেশনা নেই বলে মনে করছে রপ্তানিকারকের সংগঠন এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি)। একই সঙ্গে প্রস্তাবিত বাজেট শিল্প বিকাশে বাধার সৃষ্টি করবে। ইএবি প্রস্তাবিত বাজেট রফতানিমুখী শিল্পের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে স্থবির করে দিবে উল্লেখ করেছে। সংগঠনের সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেছে, আমরা গভীর উদ্বেগ ও বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, বাজেটে শিল্পকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি শিল্পের বিকাশের পথে নিরুৎসাহিতকরণের কিছু পদক্ষেপও রয়েছে। যা রফতানিমুখী শিল্পের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে স্থবির করে দিবে, শিল্পের সক্ষমতা কমে যাবে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে, বিনিয়োগ তথা কর্মসংস্থান সৃষ্টি নিশ্চিতভাবে নিরুৎসাহিত হয়ে উঠবে। এতে বলা হয়, বাজেটে রফতানিখাতে বিশেষ মুদ্রানীতি সম্পর্কে কোনো নির্দেশনা নেই। এদিকে প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়িত হলে আমদানি পণ্যের সঙ্গে প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতায় পড়বে দেশীয় পণ্য বলে উল্লেখ করেছে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশ (আইবিএফবি)। তাদের মতে, বাজেটে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বিভিন্নœ পণ্যের যথাযথ সুরক্ষা দেয়া হয়নি। এতে আমদানি উৎসাহিত ও স্থানীয় শিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। এছাড়া বাজেটে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর চাহিদা ও দাবি উপেক্ষিত। বাজেটে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর চাহিদা ও দাবি উপেক্ষিত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইক্যুইটিবিডি নামক একটি সংস্থা। যদিও আগামী অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে দরিদ্র নারীদের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়ানোয় সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে বেসরকারি সংস্থা ডরপ। বাজেটে মাতৃত্বকালীন ভাতাভোগীর সংখ্যা ৯০ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ লাখে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মইনুল ইসলাম বলেছেন, বাজেট উচ্চাভিলাষী হওয়াটা দোষের নয়, কিন্তু এই উচ্চাভিলাষ যদি বিশ্বাসযোগ্যতার সীমা ছাড়িয়ে যায়, তাহলে অর্থমন্ত্রী মহোদয় হাসির খোরাক হয়ে যেতে পারেন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ঘোষিত বাজেটে গতবারের তুলনায় ৭৬ হাজার ৪০ কোটি টাকা বেশি ব্যয় বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কিন্তু এটি কীভাবে অর্থায়ন করা যাবে, তার বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা নেই।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবাধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, প্রশাসনিক সক্ষমতাকে বিবেচনা না করেই বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। যা বাস্তবায়ন করা যাবে বলে মনে হয় না। একই সঙ্গে প্রতিবছর বাজেটের আকার বাড়ানোর প্রতিযোগিতা চলছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করেন। এবার উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলে বাজেটের আকার ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন