সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বিশ্বজোড়া খ্যাতি লাভ করলেও শিকড় ভোলেননি আলী

প্রকাশের সময় : ৬ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : মোহাম্মদ আলী একজন যোদ্ধা ও একজন মানবতাবাদী হিসেবে বিশ্ব ঘুরে বেড়িয়েছেন, কিন্তু সব সময়ই লুইসভিলে নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন। ঢ্যাঙ্গা কিশোর আলী নিজের শহর কেন্টাকিতে তাক লাগানো পায়ের কাজ ও দ্রুত গতিতে ঘুষি ছোঁড়ার মধ্য দিয়ে তাঁর বক্সিং দক্ষতা বৃদ্ধি শুরু করেছিলেন। তিনবারের বিশ্ব হেভিওয়েট মুষ্টিযোদ্ধা চ্যাম্পিয়ন কখনোই তাঁর শিকড়কে ভোলেননি। তিনি বিশ্বের অন্যতম একজন বিখ্যাত ব্যক্তিতে পরিণত হওয়ার পরও পুরনো ওয়েস্টহুড এলাকায় ফিরে আসতেন ও তাঁর হাইস্কুলের সহপাঠীদের সাথে দেখা করতেন।
শূন্য থেকে জীবন শুরু করে রাষ্ট্রপ্রধানদের সাথে করমর্দনকারী মানুষটিকে বিশ্ব যখন শেষ বিদায় জানাচ্ছে তখন আলীর নিজ শহরের প্রতি সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে। অনেক বছর ধরে পার্কিনসন্স রোগে স্থবির হয়ে পড়া আলী শুক্রবার ৭৪ বছর বয়সে আরিজোনার একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। আগামী শুক্রবার বিকেলে লুইসভিলে তাকে ইসলামী রীতি অনুযায়ী দাফন করা হবে। মুহাম্মদ আলী তার কীর্তি রেখে যাওয়ার স্থান হিসেবে নিজ শহরকে নির্ধারণ করেছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন মোহাম্মদ আলী সেন্টার যা তুলে ধরছে তাঁর মানবিক আদর্শ ও বর্ণাঢ্য জীবনের নানা দিক। আলী ও তাঁর স্ত্রী লোনির যুক্তরাষ্ট্রের নানা জায়গায় বাড়ি রয়েছে, কিন্তু তারা সবসময়ই লুইসভিলের বাড়িটি দেখাশোনা করেছেন।
শহরটি তার প্রিয় সন্তানের নাম জড়িয়ে রেখেছে। শহরের কেন্দ্রস্থলে তার নামে একটি সড়ক রয়েছে। টানানো হয়েছে একটি ব্যানার যাতে তাঁর মুখ আঁকা, লেখা ‘লুইসভিলের আলী।’
আলীর আজীবনের বন্ধু ভিক্টর বেন্ডার। বালক বয়স থেকে পরস্পরের সঙ্গী তারা। বেন্ডার আলীর কথা স্মরণ করেন যখন তার নাম ছিল ক্যাসিয়াস ক্লে যে একজন নিষ্ঠাবান অ্যাথলেট হিসেবে ক্লান্তিহীন ভাবে বক্সিংয়ে তার দক্ষতা বৃদ্ধিতে নিয়োজিত থাকত।
তিনি আলীর মানবিক দিকের কথাও স্মরণ করেন যিনি সবসময়ই অন্যদের পাশে দাঁড়াতে চাইতেন।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে এক সাক্ষাতকারে বলেন, শুধু স্বাস্থ্যই তাঁকে পরিবর্তিত করে দিয়েছিল। তাঁর স্বাস্থ্য যখন যথেষ্ট ভালো ছিল তিনি যে কারো সাথে কথা বলতেন। শিশুদের ভালোবাসতেন তিনি। তিনি যে কারো কাছে যেতেন, তাকে ছুঁতেন। কারণ, তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন। কখনো কখনো তাঁর ক্রীড়াশিক্ষকরা তাঁকে বলতেন, দেখ, আমাদের যেতে হবে। আমাদের সিডিউল রক্ষা করতে হবে। তিনি বলতেন, সিডিউলকে আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
রুবি হাইড স্মরণ করেন হেভিওয়েট মুষ্টিযোদ্ধা চ্যাম্পিয়ন একটি খোলা ক্যাডিলাক গাড়িতে করে এলাকায় ঘুরতেন। শিশুরা সবাই লাফিয়ে উঠত গাড়িতে, তিনি তাদের নিয়ে এলাকায় ঘুরে বেড়াতেন। শহরের কর্মজীবী মানুষের এলাকায় আলীর ছোটবেলার বাড়িটি এখনো দাঁড়িয়ে আছেÑ একটি ছোট একতলা বাড়ি। গ্র্যান্ড এভিনিউর উজ্জ্বল গোলাপী রঙের বাড়িটিকে বর্তমান মালিক সংস্কার করেছেন এবং বিশ্বখ্যাতি অর্জনের আগে তার জীবনের স্মৃতিবহ এ বাড়িটি আলীর ভক্তদের পরিদর্শনের জন্য খুলে দিয়েছেন।
জো ফ্রেজিয়ার, জর্জ ফোরম্যান ও সনি লিস্টনের সাথে মহাকাব্যিক লড়াইয়ের নায়ক আলীর বক্সিং জীবন শুরুর পিছনে রয়েছে তার সাইকেল চুরি হওয়ার ঘটনা।
১২ বছর বয়সে তাঁর বাইসাইকেল চুরি হয়। দুঃখ ভরা মন নিয়ে চুরির ঘটনা জানাতে গিয়ে আলীর পরিচয় হয় পুলিশ অফিসার জো মার্টিনের সাথে। তিনি একই সাথে স্থানীয় জিমন্যাসিয়ামে বক্সিং কোচও ছিলেন। আলী তাকে বলেন যে, তিনি চোরটিকে চাবুকপেটা করতে চান। কিন্তু চোরকে বা তাঁর বাইক পাননি তিনি। তবে খুব শিগগিরই মার্টিনের জিমে নিয়মিত যাতায়াত শুরু হয় তাঁর।
বেন্ডলার স্মরণ করেন, তাঁর বাঁহাতি ঘুষি সবসময়ই ভালো ছিল। তিনি লেগে থাকতেন। আলী শীর্ষ শৌখিন মুষ্টিযোদ্ধায় পরিণত হন। লুইসভিল সেন্ট্রাল হাই স্কুলে তাঁর সহপাঠিনী শার্লি স্মিথ বলেন, আলীর সে সময়ের কাজগুলোর মধ্যে ছিল লুইসভিলের রাস্তায় একটি স্কুল বাসের সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা। তিনি বলেন, যখনি বাসটি শিশুদের তুলে নেয়ার জন্য থামত তখনি তিনি আমাদের পেরিয়ে যেতেন। তারপর আমরা তাকে পেরিয়ে যেতাম। বাসের সবাই তার দিকে চেয়ে হাসত ও ঠাট্টা করত। তিনি এ সময় প্রশিক্ষণ নিতেন আর আমরা তাতে মজা পেতাম।
বালক বয়সে আলীর প্রতিবেশী লরেন্স মন্টগোমারি সিনিয়র বলেন, তিনি আলীর সাহসিকতাপূর্ণ কাজ দেখেছেন যার জন্য তাঁকে ‘লুইসভিল লিপ’ বলে ডাকা হত। তিনি তখন আমাকে বলতেন যে তিনি বিশ্বের হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হতে চলেছেন, কিন্তু আমি তাঁর কথা বিশ্বাস করতাম না। আমি তাকে বলতাম, দেখ, মন থেকে এসব দূর করে ফেলাই ভালো। কিন্তু তিনি সফল হন। হাইস্কুল থেকে স্নাতক হওয়ার অল্পদিন পরই ১৯৬০ সালে রোম অলিম্পিকে আলী একটি স্বর্ণপদক লাভ করেন।
স্মিথ আলীকে এক হাসিখুশি সহপাঠী বলে উল্লেখ করেন যিনি খ্যাতিমান হওয়ার পরও বদলে যাননি। তিনি ক্লাসে পুনর্মিলনীতে আলীর ম্যাজিক দেখানোর কথা জানান। তাঁকে চেনার জন্য অন্য কিছুর দরকার হত না। তিনি মোহাম্মদ আলী। আলী ১৯৬৪ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন। ১৯৬০-এর দশকে তিনি লুইসভিল ছেড়ে গেলেও কখনো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেননি।
১৯৬০-এর দশকে আলী যখন নিজ ব্যক্তিত্বে আত্মপ্রকাশ করছিলেন সে সময়টিকে প্রদর্শন করেছে মোহাম্মদ আলী সেন্টার। যেমন আলী অলিম্পিক স্বর্ণপদক জয় করে ফিরে আসার পর লুইসভিলের একটি রেস্টুরেন্টে কালো বলে তাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। আরো রয়েছে নাগরিক অধিকার সমর্থন ও ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আলীর ভূমিকার সব ছবি।
লুইসভিলের মানুষ তাঁকে নিজেদের একজন বলেই দেখেছে। তারা তাঁর মৃত্যুতে শোকার্ত। শহরের বাইরে থেকে আসা লোকজনের সাথে শহরের লোকও আলী সেন্টার ও তাঁর ছোটবেলার বাসস্থান পরিদর্শনে ভিড় করছে।
আলী সেন্টারের বাইরে শোকার্তদের মধ্যে ৭৩ বছরের ফ্রাংক গ্রীন চ্যাম্পিয়নের সাথে তার স্মৃতিচারণ করেন। তিনি হাঁটু মুড়ে বসে আলী ও তাঁর পরিবারের জন্য প্রার্থনা করেন। তিনি আলীর সাথে তোলা তার একটি ছবিও দেখান। গ্রীনের স্ত্রী ছিলেন আলীর সহপাঠিনী।
গ্রীন বলেন, গত কয়েক বছর ধরে তিনি যে অবস্থায় ছিলেন তা সত্যিই দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক। তিনি ছিলেন এক গতিশীল ব্যক্তিত্ব। ধরুন, তিনি একটি অন্ধকার ঘরে ঢুকেছেন। তার জন্য আলো জ্বালাতে হত না। আপনা আপনিই আলো জ্বলে উঠত। তিনি ছিলেন এমনি ধরনের ব্যক্তিত্ব।
শনিবার মেট্রো হলের বাইরে স্মৃতিতর্পণ অনুষ্ঠানে লুইসভিলের মেয়র গ্রেগ ফিশার এ শহরের সাথে আলীর নিবিড় সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, মোহাম্মদ আলী ছিলেন সারা বিশ্বের, কিন্তু তার নিজশহর ছিল একটাই। ‘লুইসভিল লিপ’ সবার সাথে কথা বলতেন, কিন্তু আমরা তাঁকে যেভাবে জানতাম সেভাবে আর কেউ জানত না। এপি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন